নভেম্বর বিপ্লব বেকার সমস্যার পুঁজিবাদী অভিশাপকে দূর করেছিল

স্বাধীনতার পর থেকেই বেকার সমস্যায় জর্জরিত ভারতের যুবসমাজ। যত দিন যাচ্ছে, তা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই ভাবেন, বেকার সমস্যার কি সমাধান নেই! এটাই কি ভবিতব্য? অথচ এই দুনিয়াই দেখেছে এমন সমাজব্যবস্থা যা বেকার সমস্যার সমাধানের পথ দেখিয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক সেই সমাজ গঠিত হয়েছিল ১৯১৭-র মহান নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সাময়িক বিপর্যয় দেখে অনেকেই উল্লাসে মেতে বলেছিলেন, এতে সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা এবং পুঁজিবাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হল। পুঁজিবাদ নিজেই তার সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে। এ কথা যাঁরা বলেছিলেন, সেইসব পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদ বুদ্ধিজীবীরা আজ অস্বীকার করতে পারছেন না যে দিনে দিনে সমস্যার গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজ।

 কী পরিস্থিতি আজ ভারতের! দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ সালে ভারতে কর্মক্ষম মানুষের (যাদের বয়স ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে) সংখ্যা ছিল ৯৫ কোটির কিছু বেশি। ওই একই সময় দেশের শ্রমশক্তি অর্থাৎ কর্মরত বা কাজ-খোঁজা মানুষের সংখ্যা ছিল ৪৮ কোটি। ২০২১ সালে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১১৫ কোটি ও ৪২ কোটিতে। অর্থাৎ ওই সময়ে প্রয়োজনীয় নতুন পদ বা চাকরি সৃষ্টি তো হয়ইনি, বরং ছ’কোটি মানুষের কাজ চলে গেছে। কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা দেশে ক্রমাগত বাড়ছে। ২০১৭-’১৮ সালেই দেশে বেকারত্বের হার গত ৪৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।

পুঁজিবাদী অর্থনীতিই বেকার সমস্যার কারণ

শুধু কি সরকারের সদিচ্ছার কারণেই বেকার সমস্যা আজ এই ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে? বিশ্ব সাম্যবাদের দিশারি মহান মার্ক্স দেখালেন, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য শ্রমিককে যে শোষণ করে, সেটাই এক দিকে তার টিকে থাকার শর্ত, অন্য দিকে এই শোষণই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে বার বার সংকটের আবর্তে টেনে নিয়ে যায়। জন্ম দেয় ভয়াবহ বেকার সমস্যার। তিনি দেখিয়েছেন, শ্রমিকের শ্রম চুরি করেই (উদ্বৃত্ত শ্রম) হয় মালিকের লাভ বা উদ্বৃত্ত মূল্য। উদ্বৃত্ত মূল্য যত বাড়ে লাভও তত বাড়ে। মহান নভেম্বর বিপ্লবের রূপকার কমরেড লেনিন ‘গ্রামের গরিবদের প্রতি’ শীর্ষক এক আলোচনায় দেখিয়েছেন, এই উদ্বৃত্ত মূল্য মালিক মূলত চারটি উপায়ে বাড়ায়– (১) কাজে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে, (২) উন্নত যন্ত্রে সাহায্যে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে, (৩) কাজের সময় বাড়িয়ে এবং (৪) মজুরি কমিয়ে। শোষণ তীব্রতর করে মালিকের মুনাফার বহর বাড়লে মজুরের জীবনে দারিদ্র্য বাডে, বাড়ে বেকারত্ব, কমে চাকরির নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব। ফলে ধীরে ধীরে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমতে থাকে। বাজারে বিক্রি কমে। ব্যবসায় সংকট আরম্ভ হয়। এই সংকট থেকে বাঁচতে আবার উপরে উল্লেখিত পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এইভাবে পুঁজিবাদ এক সংকট থেকে বাঁচতে আর এক গভীর সংকটে পড়ে। যেটা সে সমাধান করতে পারে না, সংকট ক্রমাগত তীব্রতর হয়। উপরন্তু উন্নত বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সাহায্যে ক্ষমতাসম্পন্ন উৎপাদন যন্ত্র্র ব্যবহারে বৃহৎ পুঁজি প্রতিযোগিতাকে তীব্রতর করে, উৎপাদন খরচ কমিয়ে ছোট ও মাঝারি পুঁজিকে ধ্বংস করে। এদের উপর নির্ভরশীল মানুষ কর্মচ্যুত হয়। ফলে বাজার সংকট আরও বাড়ে। এর সঙ্গে তাল রেখে বাড়ে বেকার বাহিনী।

একদিকে উৎপাদনের ক্ষমতার সীমাহীন বৃদ্ধি, অন্যদিকে জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশের ক্রয়ক্ষমতার অবনতি– এই দুইয়ের অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে যা ঘটে তা দেখাতে গিয়ে লিয়নটিয়েফ তাঁর ‘মার্ক্সীয় অর্থনীতি’ বইয়ে একটা বাস্তব চিত্র তুলে ধরলেন। সেটি হলঃ

 ‘‘এক খনি মজুরের ছেলে তার মাক্সকে জিজ্ঞাসা করছে,

‘আগুন জ্বলছে না কেন মা, বড়ো ঠান্ডা যে’?

– আমাদের কয়লা নেই বাবা।

– কেন কয়লা নেই মা?

– তোমার বাবা যে বেকার, তাই আমাদের কয়লা কেনার টাকা নেই।

– কিন্তু বাবার চাকরি কেন নেই মা?

– অনেক কয়লা মজুত রয়েছে যে বাবা।’’

এই হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। ৭৫ বছরের পুঁজিবাদী শাসনে ভারতবর্ষের পরিস্থিতিটা অদ্ভূত ভাবে মিলে যায়। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উৎপাদনের উদ্দেশ্য হল সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন। তাই এই অর্থনীতির সামগ্রিক পরিকল্পনা রচিত হয় কীভাবে মুনাফার হার আরও বাড়ানো যায় সে দিকে লক্ষ রেখে। তাই পৃথিবীর সমস্ত পুঁজিবাদী দেশে বেকার সমস্যা ক্রমাগত বাড়তেই থেকেছে। নব্বইয়ের দশকে বিশ্বায়নের নয়া আর্থিক নীতি আসার পর মালিকী শোষণের হার বাড়তে থাকে, শ্রমিক শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ইঞ্জিন বলে কথিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকার সমস্যা এমন ভয়াবহ যে, আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ময়দানে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে কখনও সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ভরতুকি, খাদ্য কুপন ইত্যাদি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হচ্ছে। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে বেকারদের শান্ত করতে হচ্ছে। সারা বিশ্বে সরকারি বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে যন্ত্রীকরণ হচ্ছে, চলছে ব্যাপক শ্রমিক ছাঁটাই, বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কাজের সময়। ফলে মালিকের মুনাফা বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বেকার বাহিনী। মহান মার্ক্সবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন– আজ পুঁজিবাদের অবাধ বিকাশের আর সম্ভাবনা নেই। এর মধ্যে শিল্প কিছু হচ্ছে না বা বাজার অল্পবিস্তর সম্প্রসারণ হচ্ছে না এমন নয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার বাজার সংকট দেখা দিচ্ছে। পাঁচটা কারখানা হচ্ছে তো দশটা বন্ধ হচ্ছে। যতটুকু উৎপাদিকা শক্তি রয়েছে তারও পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না। চলছে ছাঁটাই, লে-অফ-লকআউট-ক্লোজার। পুঁজিবাদী নিয়ম মেনে উৎপাদন বাড়তি হয়ে যাচ্ছে। গুদামে পণ্য জমে যাচ্ছে। সমস্ত দেশেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অভাব। পণ্য বিক্রির বাজার নেই। ফলে বাজার সম্প্রসারণ তো দূরের কথা তা আরও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। এই অবস্থায় ব্যাপক শিল্পায়ন করে কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। ফলে বেকার বাড়ছে হু হু করে।

নভেম্বর বিপ্লবের আগে রাশিয়ার অবস্থা

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে রাশিয়ার পরিস্থিতিও একই রকম ভযঙ্কর ছিল। গরিব চাষি, শ্রমিক সহ বৃহত্তর অংশের জনগণ দ্রুত ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। হাজার হাজার দারিদ্র্যপীড়িত অসহায় গ্রামীণ কৃষক ভিড় করছিল শহরে কাজের খোঁজে। তীর্থের কাকের মতো একটা কাজের আশায় ঘন্টার পর ঘন্টা হয় তারা কারখানার গেটে দাঁড়িয়ে থাকত আর না হয় বাজারে অথবা বড়লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াত যে কোনও শর্তে যে কোনও ধরনের কাজের জন্য। পুঁজিবাদের সবচেয়ে ভালো সময় রাশিয়ার প্রধান শিল্পকেন্দ্রগুলিতে বেকার সংখ্যা ছিল ১০ লক্ষ। গ্রামীণ বেকার, অর্ধবেকারদের বিপুল সংখ্যা ছিল এর বাইরে। লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজের খোঁজে অন্য দেশে চলে যাচ্ছিল। এই বেকার বাহিনীর বাইরে জমিতে বাঁধা ছিল প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ, যাদের শ্রম দানের অন্য কোনও জায়গা ছিল না। ফলন মার খাওয়ায় প্রায় ৩ কোটি মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছিল।

১৯১৭ সালের নভেম্বরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে অবস্থা আরও করুণ হয়ে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা, শিশু সোভিয়েতকে খতম করতে চোদ্দটি রাষ্ট্রের যৌথ আক্রমণ ইত্যাদির কারণে পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। কৃষিক্ষেত্র বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বেকার সমস্যা ভয়াবহ রূপ নেয়। ১৯১৮ সালে রাশিয়ায় নথিভুক্ত বেকার ছিল ১৫ লক্ষ ১২ হাজার ৪৫৫ জন। কাজ পাওয়া অসম্ভব ভেবে জনগণের একটা বড় অংশ নাম নথিভুক্ত করাত না। এই সমস্ত কিছু সামলে মহান লেনিনের নেতৃত্বে শুরু হল বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনের কাজ।

যেভাবে সমাজতন্ত্র দূর করেছিল বেকার সমস্যা

সমাজতন্ত্র উৎপাদন যন্ত্রের উপর ব্যক্তি মালিকানার অবসান ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে চলে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের লক্ষ্য ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন নয়, ক্রমাগত উৎপাদন বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে দেশের প্রতিটি মানুষের বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজন পূরণ করা। কেন্দ্রীয় প্ল্যানিং কমিশন দেশের মোট উৎপাদিত কাঁচামাল, মোট শ্রমিকের সংখ্যা, ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যা, উৎপাদন যন্ত্রের পরিমাণ হিসাব করে তারপর পূর্ববর্তী বছরে বা বছরগুলিতে কোন জিনিস কী পরিমাণে তৈরি হয়েছিল, কোন জিনিসের চাহিদা কেমন, আগামী দিনে কোন কোন দ্রব্য কতটা পরিমাণে প্রয়োজন হতে পারে ইত্যাদি সব কিছুর ভিত্তিতে একটা খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করত। এরপর সেই খসড়া পরিকল্পনাকে ভিত্তি করে তৃণমূল স্তর থেকে সমগ্র দেশকে, দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা, মত-বিনিময়, সে সবের সংযোজন-বিয়োজন করে তৈরি হত মূল পরিকল্পনা। আইনসভা সেই পরিকল্পনা অনুমোদন করার পর তা কার্যকর হত। এর চেয়ে বড় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বিশ্বে কোনও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র নিতে পারেনি তাই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতে প্রতিটি পরিকল্পনা হয়ে উঠত জনগণের নিজের বিষয় আর তাই তার রূপায়ণ হত নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের বিপুল অগ্রগতি সারা বিশ্বের মানুষকে আকর্ষণ করে। বেশ কিছু পুঁজিবাদী দেশের শাসকরা এই আকর্ষণ দেখে আতঙ্কিত হয়ে ‘পরিকল্পিত’ অর্থনীতির কথা বলতে থাকে। না হলে নিজের দেশে সামাজতন্ত্রের জন্য মানুষের আকাঙক্ষা বাড়বে। সে জন্য ভারতেও স্বাধীনতার পর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কথা আসে। কিন্তু তা যেহেতু পরিচালিত হত পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়ম ও লক্ষ্য অনুযায়ী, তাই পুঁজিপতিদের মুনাফা বৃদ্ধি ছাড়া দেশের সার্বিক বিকাশের মাধ্যম হয়ে উঠতে পারেনি কোনও পরিকল্পনাই। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় যে সব গোলমাল দেখা যায়, পরিকল্পিত অর্থনীতির জন্য সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় সোভিয়েত রাশিয়াতে তা দেখা যায়নি। সম্পদ যা তৈরি হত তার একটা অংশ শিক্ষা, চিকিৎসা, উৎপাদন যন্ত্রের পরিমাণ বৃদ্ধি, রাস্তাঘাট তৈরি সহ সরকার চালাবার অন্যান্য বিষয়ে ব্যয় করে বাকিটা জনসাধারণের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হত। এ জন্য সমাজতন্ত্রে কখনও জিনিস বিক্রি না হয়ে পড়ে থাকত না। একই ভাবে না খেতে পেয়ে বা বিনা চিকিৎসায় মানুষ মারাও যেত না।

সামাজিক মালিকানা ও জনগণের প্রয়োজনের ভিত্তিতে উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পিত অর্থনীতি প্রয়োগের কারণে কখনও বাজার সংকট দেখা দিত না, শ্রমিকও কখনও বেকার হত না। এ জন্যই ১৯২৯-৩৩ এই সময়কালে সমস্ত পুঁজিবাদী দেশে যখন প্রবল বাজারসঙ্কট চলছে, চলছে লে-অফ, লকআউট, শত শত কারখানা বন্ধ হচ্ছে, তখন সোভিয়েত রাশিয়ার মানুষ দিনরাত কাজ করেও গোটা দেশের জনগণের চাহিদা মেটাবার প্রয়োজনে উৎপাদন আরও বাড়িয়ে চলেছিল। একটার পর একটা নতুন কারখানা খোলার প্রয়োজন তখন তাদের সামনে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সর্বোচ্চ মুনাফার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় বলে যন্ত্রের ব্যবহারে ছাঁটাই শ্রমিক আর বেকারের সংখ্যা বাড়ে। পুঁজিবাদে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় মূলত উৎপাদন খরচ কমানোর লক্ষ্যে। তাই যত প্রযুক্তি আসে, তত শ্রমিকের দুর্দশা বাড়ে। উৎপাদনের ক্ষমতা বাড়লেও বাস্তবে উৎপাদন ক্রমাগত বাড়তে পারে না। কারণ বাজারে চাহিদা না থাকায় আগে উৎপাদিত হওয়া পণ্য জমে থাকে। ফলে মুনাফা কমার আশঙ্কায় মালিকরা শ্রমিক ছাঁটাই করে।

এর ঠিক বিপরীত হচ্ছে সমাজতন্ত্র, যেখানে প্রযুক্তি কাজে লাগে উৎপাদন বাড়াতে, মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে। ফলে কর্মসংস্থান বেড়েই চলে। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার সেই প্রযুক্তি শ্রমিকের শ্রমই শুধু লাঘব করেনি সাথে সাথে শ্রম সময় হ্রাস করেছে। বিপ্লবের মাত্র ছয় বছর পর ১৯২৩ সালে শ্রমসময় কমে হয়ে গিয়েছিল দিনে ৭ ঘণ্টা এবং এরপর ১৯৩৭-এ ৫ ঘণ্টা। ফলে কারখানায় শিফট বাড়ল, কর্মসংস্থান বাড়ল মজুরি বৃদ্ধি পেল। এভাবেই যে সময়ে পুঁজিবাদী দুনিয়ায় বেকার সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল, সেই সময়ে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় শ্রমিকের অভাবে কারখানা আর বাড়ানো যাচ্ছিল না। ১৯৩১-এর মধ্যে বেকার সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান করে ফেলেছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন।

সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের মালিকানা থাকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সর্বহারা শ্রেণির হাতে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মতো জনকয়েক পুঁজিপতির হাতে নয়। তাই কয়েক শতক ধরে পুঁজিবাদ যে সমস্যার সমাধান করতে পারেনি, ভারতে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে যে সমস্যা ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছে, সেই বেকার সমস্যা বিপ্লবের মাত্র ১২ বছরের মধ্যে সমাজ থেকে দূর করে ফেলেছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্র। ফলে, মালিকের মুনাফার উদ্দেশ্যে পরিচালিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যত দিন টিঁকে থাকবে, সমাজের আর পাঁচটা অন্যান্য সমস্যার মতো বেকার সমস্যাও বাড়তেই থাকবে। এর মধ্যে কাজের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হলে, শূন্যপদে নিয়োগে সরকারকে বাধ্য করতে না পারলে বাঁচার কোনও পথ নেই। আর তার জন্য প্রয়োজন দেশজোড়া তীব্র গণআন্দোলন যা পরিচালিত করতে হবে শুধুমাত্র চাকরির দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নয়, এই শোষণমূলক ব্যবস্থাকে উৎখাতের লক্ষ্যেও।