চরম দারিদ্রের কবলে বিশ্বের ১১০ কোটি মানুষ

সেই কবে শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন সমাজের সব হারানো মানুষদের কথা– ‘নিরুপায় দুঃখময় জীবনে যারা কোনও দিন ভেবেই পেলে না, সমস্ত কিছু থেকেও তাঁদের কেন কোনও কিছুতেই অধিকার নেই।’ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘এই সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে, ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা’। একদিন সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর হবে, সমস্ত মানুষ সুস্থ জীবনের অধিকার পাবে, স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা। কিন্তু আজ প্রায় এক শতক পার করে বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে একেবারে প্রথম দিকে উঠে আসছে ভারতবর্ষ। গোটা বিশ্বেই বাড়ছে সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা, টিকে থাকার মরণপণ যুদ্ধই যাদের জীবনের একমাত্র সত্য।

বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচকে (মাল্টি ডাইমেনশনাল পভার্টি ইনডেক্স) দারিদ্র মাপা হয় পুষ্টি, শিক্ষা, পানীয় জল, বাসস্থান, রান্নার জ্বালানি সহ সুস্থ জীবনযাত্রার জন্য আবশ্যিক মোট দশটি বিষয়ের ভিত্তিতে। এর মধ্যে অন্তত তিনটি থেকে যারা বঞ্চিত, এই সূচক অনুযায়ী তাঁরাই দরিদ্র বলে বিবেচিত হবেন। ইউনাইটেড নেশন’স ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংস্থা এই বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচকের যে সাম্প্রতিক তালিকা তৈরি করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের ১১০ কোটি মানুষ তীব্র দারিদ্রের শিকার, যার অর্ধেকেরও বেশি আঠেরোর গণ্ডি পেরোয়নি। একশো দশ কোটি অর্থাৎ সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ ভারতের মোট জনসংখ্যার চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে নেই পৃথিবীর ‘অতি দরিদ্র’ মানুষের সংখ্যা। বিশ্বের ৮৩ কোটি মানুষের যথাযথ শৌচাগার ব্যবহারের সুযোগ নেই, ৮৯ কোটির কোনও ঘরবাড়ি নেই, প্রায় ১০০ কোটির কাছে পৌঁছায় না রান্নার জ্বালানি, এমন সব তথ্য উঠে এসেছে এই সমীক্ষায়।

দারিদ্রে ধুঁকতে থাকা মানুষের প্রায় অর্ধেক আছেন মাত্র পাঁচটি দেশে, যার মধ্যে ভারত একেবারে প্রথম– এ দেশে এমন মানুষের সংখ্যা ২৪.৪ কোটি। বাকি ভারতীয়রা, যারা এই সূচকে ‘অতি দরিদ্র’ তালিকার বাইরে রয়ে গেলেন, তাঁরা কেমন ‘সুখে’ আছেন, আন্দাজ পাওয়া যায় আরেকটি সাম্প্রতিক তথ্যে চোখ রাখলে। দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ সম্পদ আছে ওপরতলার ১ শতাংশের হাতে, প্রায় ৮০ শতাংশ সম্পদ আছে ওপরের ১০ শতাংশের হাতে, আর নিচের তলার ৫০ শতাংশের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশ। অর্থাৎ যাদের রক্ত জল করা পরিশ্রমে গড়ে উঠছে সম্পদের পাহাড, তারাই পড়ে আছে সমাজের একেবারে তলানিতে। তাঁদের জন্য কাজ নেই, কাজ থাকলেও ন্যূনতম সুরক্ষা নেই। তাঁদের পুষ্টিকর খাদ্য নেই, রোগ হলে চিকিৎসা নেই, ভদ্রস্থ একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, শিক্ষার সুযোগ নেই। প্রতিদিনের কাগজ খুললেই এই মানুষগুলোর দেখা পাওয়া যায় অজস্র টুকরো খবরে। কেউ খিদের জ্বালায় সন্তানকে বেচে দিচ্ছেন, কেউ অসুস্থ পরিজনকে খানাখন্দে ভরা রাস্তা দিয়ে দড়িতে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বহু মাইল দূরের হাসপাতালে, কেউ কাজ হারিয়ে বা ঋণের দায়ে সপরিবারে আত্মহত্যা করছেন। আরও কত মানুষ কত ভাবে যে দারিদ্রসীমার নিচে নেমে যাচ্ছেন, কত শিশু-কিশোরের ভবিষ্যৎ তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে, তার হিসাব নেই।

যুদ্ধ-সংঘর্ষের সাথে দারিদ্রের সম্পর্কের জরুরি তথ্যও উঠে এসেছে এই সমীক্ষায়। বিশ্বের ১১২টি দেশের ওপর করা এই সমীক্ষার তথ্য বলছে, ১১০ কোটি দরিদ্র মানুষের ৪৫.৫ কোটিই বাস করেন যুদ্ধ বিধবস্ত, সংঘর্ষে দীর্ণ দেশগুলোয়। ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সংঘর্ষ বেড়ে গেছে বহুগুণ, অজস্র মানুষের প্রাণহানি ঘটছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘরবাড়ি হারাচ্ছেন, পৃথিবী জুড়ে জীবন ও সম্পদের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে’, বলেছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের ওই সংস্থার এক সচিব। সবকিছু জানার পরেও তাহলে যুদ্ধ কেন? কেন ইউএনও, ইউনিসেফের মতো সংস্থার নাকের ডগা দিয়ে বছরের পর বছর চলতে পারছে ইউক্রেন এবং প্যালেস্টাইনের ওপর এই প্রাণঘাতী হামলা? কোন অপরাধে প্যালেস্টাইনের হাজার হাজার নারী, ফুলের মতো শিশু শেষ হয়ে যাচ্ছে বোমার আঘাতে? ইজরায়েলের রাষ্ট্রপ্রধানরা প্যালেস্টাইনের মানুষদের সম্পর্কে চরম অবমাননাকর উক্তি করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন কী করে? আমাদের ভারতবর্ষ কার স্বার্থে খুনি ইজরায়েলের সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলছে?

একদিকে যখন বেকারি, অনাহার, দারিদ্র, শিশুমৃত্যু ক্রমশ বাড়ছে তখন আমাদের দেশে আম্বানি-আদানির মতো শিল্পপতিরা ‘অর্থনীতির সুবাতাস’ অনুভব করে প্রীত হচ্ছেন। ভারত সহ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশের শাসকরা একের পর এক যুদ্ধ বাধিয়ে গণহত্যা করছে কোনও দেশরক্ষার স্বার্থে নয়, মুমূর্ষু পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে যুদ্ধের বাজারের টোটকা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। একদিন যে গণতন্ত্রে ‘জনগণের দ্বারা জনগণের জন্য এবং জনগণের’ হয়ে ওঠার প্রতিশ্রুতি ছিল, একের পর এক সমীক্ষা, তথ্য, পরিসংখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আজকের পুঁজিবাদী বিশ্বের ‘গণতন্ত্রে’, সেই জনগণের তিলমাত্র স্থান নেই, অধিকার নেই।