গবেষণার সুযোগ সংকুচিত করছে নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি

২৭-২৯ নভেম্বর নয়া দিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে দশম সর্বভারতীয় ছাত্র সম্মেলন। এই সম্মেলন নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার ডাক দেওয়া হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষার উপর বহুবিধ আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। যেমন উচ্চশিক্ষায় গবেষণার সুযোগ সংকোচন। যদিও এই শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, ‘‘বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলিতে গবেষণার উপর কম জোর দেওয়া হয় এবং প্রতিযোগিতামূলক কর্পোরেট রিসার্চ ফান্ডিংয়ের অভাব রয়েছে’’ (জাতীয় শিক্ষানীতি, ৯.২.এইচ., পৃষ্ঠা ৩৩)। অর্থাৎ বেসরকারি শিক্ষা-ব্যবসায়ী ধনকুবের গোষ্ঠীর ফান্ডিং-ই পারে দেশের গবেষণা ক্ষেত্রে আর্থিক সমস্যা দূর করতে। সোজা কথায় সরকার দেশের উচ্চশিক্ষায় ফান্ডিং না করে, সেই ঘাটতি মেটাতে বেসরকারি কোম্পানিগুলিকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে।

সরকারি নীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রথমত আইআইটি, আইআইএসইআর-এ গবেষণা করার ফি বৃদ্ধি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত বিভিন্ন ফেলোশিপ এবং স্কলারশিপ যথা মৌলানা আজাদ ন্যাশনাল ফেলোশিপ ফর মাইনরিটিস, সংখ্যালঘুদের জন্য প্রাক-মাধ্যমিক স্কলারশিপ বাতিল করা হয়েছে। তৃতীয়ত, বিভিন্ন ফান্ড বা অনুদান ছাঁটাই করে ‘ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ (এনআরএফ) গঠন করে তাকেই প্রধান ফান্ডিং সংস্থা করা হয়েছে। চতুর্থত, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির উপর জিএসটি ৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১৮ শতাংশ করা হয়েছে। পঞ্চমত, পঞ্চগব্য, জ্যোতিষশাস্ত্র, সরস্বতী নদী সন্ধান, সংস্কৃত ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা ইত্যাদি অপবিজ্ঞান বা অনৈতিহাসিক বিষয়ে প্রভূত অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। ষষ্ঠত, গবেষণা ক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চ-শিক্ষা সংস্থায় যে নিজস্ব প্রবেশিকা ব্যবস্থা ছিল তার অবসান ঘটিয়ে সিইউইটি বা নেট-এর মতো কেন্দ্রীয় প্রবেশিকা চালু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার অস্বীকার করা হয়েছে। সপ্তমত, স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) পর্বে পিএইচডি-র সমকক্ষ দ্বিতীয় কোনও ডিগ্রি রাখা যাবে না এই অজুহাত দিয়ে এম-ফিল কোর্স বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অষ্টমত, গবেষকদের সাপ্তাহিক চার থেকে ছয় ঘণ্টা বাধ্যতামূলক শিক্ষণ বা অন্যের গবেষণা-কাজে সাহায্যদানের নির্দেশ দিয়ে তাদের উপর বোঝা চাপানো হয়েছে ইত্যাদি।

এর পাশাপাশি, ইউজিসি খসড়া ‘ইন্সটিটিউট ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান, ২০২২’-এর মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কমানোর পরিকল্পনা করেছে। গত বছর (২০২৩) জুন মাসে বিজেপি নেতৃত্বাধীন হরিয়ানা সরকার রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ‘স্ব-নির্ভর’ ঘোষণা করে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আর্থিক দায় অস্বীকার করে। তীব্র প্রতিবাদের পর সরকার ওইপরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আসে। কিন্তু হরিয়ানা সহ সকল রাজ্যে এটাই সরকারের লক্ষ্য। এমনকি, শিক্ষা সম্প্রসারণের নামে কলেজগুলিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনমুক্ত (ডিসঅ্যাফিলিয়েন্ট) করে স্নাতক পর্বের পরেই পিএইচডি শুরু করার পথ খোলা হয়েছে। এতে গবেষণার মান কী হবে সেটা সহজেই অনুমেয়।

বহু প্রচারিত এনআরএফ-এর অবস্থা কী? এনআরএফ সংস্থাকে শুধুমাত্র পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য ৫০,০০০ কোটি টাকা দেওয়া হবে। অর্থাৎ বছরে মাত্র ১০,০০০ কোটি টাকা। এই অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। এনআরএফ-এর গঠন দেখলে স্পষ্ট হবে যে এটি শাসক দলের অঙ্গুলিহেলনে চলবে এমন একটি আমলাতান্ত্রিক সংস্থা যার কাঠামো সরকার ও কর্পোরেট–যৌথ অংশীদারিত্বে গঠিত হবে। এর গভর্নিং বডির সভাপতি হবেন প্রধানমন্ত্রী এবং দু’জন সহসভাপতির একজন হবেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী, দ্বিতীয় জন শিক্ষামন্ত্রী। বাকি সদস্যরা হয় আমলা, আর না হয় কোনও সংস্থার সচিব। ২৫ জন সদস্যের মধ্যে ৫ জন নানা ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধি। মাত্র দু’জন সদস্য বিজ্ঞানীদের মধ্য থেকে এবং একজন সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত হবেন। ফলে এটা পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় যে এই ফান্ডিং সংস্থা কাদের স্বার্থ দেখবে।

জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে এনআরএফ-এর ৭০ শতাংশ অর্থ আসবে প্রাইভেট সেক্টর থেকে। ফলে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় আগামীতে বেসরকারি সংস্থার হাত যে দীর্ঘ হবে সেটি খুব স্পষ্ট। ওই নীতিতে বলা হয়েছে সরকারি এবং বেসরকারি দুই ধরনের সংস্থাই সমানভাবে এনআরএফ-এর গ্রান্ট বা মঞ্জুরি পাবে। সোজা কথায় এর ফলে জনগণের ট্যাক্সের টাকা বেসরকারি মালিকের পকেটে ঢুকবে।

মোদি সরকার দেশের মানুষকে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’-র স্বপ্ন দেখাবে, ‘মেক-ইন-ইন্ডিয়া’ স্লোগান তুলবে, আর বাস্তবে অর্থ বরাদ্দের সময় মুঠো খুলবে না। গবেষণায় অর্থের ঘাটতির কথা বলে দেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করার জন্য আমন্ত্রণ জানাবে। দেশ-বিদেশের পুঁজিপতিরা ঠিক এটাই চায়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিকাঠামো ব্যবহার করে, দেশের মেধা করায়ত্ত করে তারা নিজেদের লাভের রাস্তা প্রশস্ত করবে।

ছাত্র-সংগঠন এআইডিএসও এবং অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটি, ইন্ডিয়া মার্চ ফর সায়েন্স অর্গানাইজিং কমিটি সহ বিভিন্ন বিজ্ঞান সংগঠন দাবি করেছে শিক্ষাখাতে জিডিপি-র ৬ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে। এই দাবিতে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, জেএনইউ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ব়্যাভেনশ বিশ্ববিদ্যালয়, গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়, এমডিইউ (হরিয়ানা) সহ দেশের অগ্রগণ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি থেকে গবেষক তথা ছাত্রছাত্রীরা দিল্লিতে দশম ছাত্র সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবে।