(৫ এপ্রিল উত্তর চব্বিশ পরগণার ব্যারাকপুরে কমরেড সদানন্দ বাগলের স্মরণসভায় সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ যে বক্তব্য রাখেন তা প্রকাশ করা হল। প্রকাশের সময় তিনি দু-একটি পয়েন্ট যোগ করে দেন)।
কমরেড সভাপতি ও কমরেডস,
কমরেড সদানন্দ বাগলের মৃত্যুর ঘটনা প্রত্যক্ষ করা, তারপর স্মরণসভায় আমার বলতে আসা– এ আমার কাছে অভাবনীয় ছিল। আমাদের শিক্ষক মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ একটা অমূল্য শিক্ষা রেখে গেছেন, কোনও নেতা বা কর্মীর মৃত্যু যতই বেদনাদায়ক হোক, তা আমরা কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখব। তিনি বলেছেন, বিপ্লবীদের কাছে নিছক শোকপ্রকাশের, নিছক হৃদয়াবেগের কোনও মূল্য নেই– যদি বিপ্লবী না বোঝে যে ঘটনায় সে ব্যথা পেল, তার যথার্থ তাৎপর্য তাকে বিপ্লবী জীবনে কী করতে বলে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমরা যে কোনও কমরেডের স্মরণসভার আয়োজন করি। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে কমরেডকে আমরা হারালাম, তিনি নেতা হোন বা কর্মী হোন, তাঁর বিপ্লবী জীবনের সংগ্রামবহুল নানা ঘাত-প্রতিঘাতে কী ভাবে মহান মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে হাতিয়ার করে ভূমিকা পালন করেছেন এবং সেই ভূমিকা থেকে আমরা যারা জীবিত, তারা কী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি তার চর্চা করা।
কমরেড সদানন্দ যে যুগে পার্টির সাথে যুক্ত হন, সেই যুগ সম্পর্কে এখনকার বহু কর্মীই জানেন না। আপনারা জানেন, কমরেড শিবদাস ঘোষ ৬ জন সহকর্মী নিয়ে এক ঐতিহাসিক প্রস্তুতির অতুলনীয় সংগ্রাম চালিয়ে এই দল গঠন করেন ১৯৪৮ সালে। আমি দলে যুক্ত হই ১৯৫০ সালে। সদানন্দ যুক্ত হন ১৯৫৩ সালে, তখন তিনি স্কুলের ছাত্র। যতদূর আমার মনে পড়ে, তৎকালীন সময়ের আমি এবং কমরেড সাধনা চৌধুরী, যিনি এখন অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী– এই দু’জন এখন জীবিত। এর কিছুদিন বাদে কমরেড অসিত ভট্টাচার্য যুক্ত হন। আপনারা শোক প্রস্তাবে শুনেছেন, কমরেড সদানন্দ বাগলের এই দলে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে কমরেড রতন ভৌমিক নামের একজন কমরেড, যাঁর নাম এই হাউসের কেউই হয়তো জানেন না, তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি জয়নগরের ময়দা অঞ্চলের কর্মী ছিলেন। দারিদ্রের কারণে জুট মিলে কাজ করতে উত্তর ২৪ পরগণার জগদ্দলে আসেন।
সেই সময় দক্ষিণ ২৪ পরগণায় কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে কমরেডস শচীন ব্যানার্জী, সুবোধ ব্যানার্জী, ইয়াকুব পৈলান, রবীন মণ্ডল সহ আরও অনেকের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। তারই ভিত্তিতে দক্ষিণ ২৪ পরগণা দলের একটা শক্তিশালী ঘাঁটি হিসাবে গড়ে উঠেছিল। এরই প্রভাবে প্রভাবিত কমরেড রতন ভৌমিক এখানে আসেন কর্মসূত্রে এবং সংগঠনের কাজ শুরু করেন। সেই সময়ে পার্টির বিস্তারে এই ধরনের বহু কমরেডের অনেক সংগ্রাম, বহু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, যাঁরা আজ বর্তমান কমরেডদের কাছে অজ্ঞাত। তখন অবিভক্ত ২৪ পরগণা, পার্টির কাজের জন্য দুই ভাগে বিভক্ত ছিল– উত্তর এবং দক্ষিণ। এটা রাজনৈতিক বিভাগ ছিল। উত্তর ২৪ পরগণায় প্রথম কাজ শুরু হয়েছিল আগরপাড়া এলাকায়, যেখানে ব্রিটিশ শাসন চলাকালীন কমরেড শিবদাস ঘোষ পুলিশের নজর এড়াতে আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করতেন। ওখানকার বেশ কিছু যুবককে তিনি যুক্ত করেছিলেন। তার মধ্যে কমরেড সনৎ দত্ত, ভবতোষ দত্ত এবং আরও অনেকে ছিলেন। পরবর্তীকালে কমরেড তাপস দত্ত, আমাদের দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্বতন সদস্য ও কলকাতায় ক্ষুদিরাম মূর্তির ভাস্কর, তিনি এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে আসেন। আবার এখানেই ফুটপাতে হকারি করতেন কমরেড যোগেন মণ্ডল, হাবড়ার কমরেডরা এখনও হয়তো তাঁর নাম জানেন। তিনি পরে হাবড়ায় গিয়ে ফুটপাতে একটা বাঁশের দোকান করেন। স্কুলের ছাত্ররা তাঁর দোকানের সামনে দিয়ে যেত, তিনি তাদের সাথে কথাবার্তা বলে ধীরে ধীরে তাদের আকৃষ্ট করেন এবং তার মধ্য দিয়ে অনেক যোগাযোগ সৃষ্টি হয়। আমি সেই সময় সেখানে প্রায়ই যেতাম। এইভাবেই পার্টি বিভিন্ন জায়গায় বিস্তার লাভ করেছে। তখন আমাদের কর্মীসংখ্যা মুষ্টিমেয় হলেও প্রত্যেক কমরেড নতুন যোগাযোগ বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। এমন এমন কমরেড আছেন পার্টির বিস্তারে যাদের ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য। তাঁদের নাম, তাঁদের ভূমিকার কথা অনেক কমরেডই হয়তো জানেন না। এই কমরেড রতন ভৌমিকই এই এলাকায় আমাকে প্রথম ডেকে আনেন। তিনিই সদানন্দদের সাথে আমার যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। খুব সম্ভবত আতপুর স্কুলের ছাত্র ছিল। সেখানেই প্রথম কথাবার্তা হয় এবং স্কুল গেটে আমাকে দিয়ে মিটিং করানো হয়। পরে আর একটা মিটিং হয়, সেখানে কমরেড তাপস দত্ত ও আমি দু’জনে এসেছিলাম। এই ভাবে এরা দলের সাথে ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকে। কিছুদিন পরে ভাটপাড়ায় অসিত রায় নামের একজন নিজে পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং পার্টির কাজকর্মে উদ্যোগ নেন। কিন্তু এই কঠিন সংগ্রাম ফেস করতে না পেরে কিছুদিন বাদে তিনি নিষ্ক্রিয় হয়ে যান, যদিও তাঁর মামাতো বোন কমরেড ইন্দ্রাণী হালদার সক্রিয় কর্মী হিসাবে থেকে যান। এর কিছুদিন বাদে কমরেড কমল ভট্টাচার্য পার্টির সাথে যুক্ত হন।
সদানন্দ যখন দলে যুক্ত হন, তিনি একা আসেননি। তাঁর সাথে জীবন কুণ্ডু, ডালিম দে, পীযূষ মুখার্জী, মনোতোষ, তার পদবী আমার মনে নেই, এরা এক ঝাঁক ছাত্র একসাথে দলে এসেছিলেন। এঁদের একটা গ্রুপ ছিল। আমি নিয়মিত যেতাম, এদের নিয়ে বৈঠক করতাম। একবার পয়সার অভাবে ট্রেনে টিকিট কাটতে পারিনি। কাঁকিনাড়া স্টেশনে চেকার আমাকে ধরে। সদানন্দরা স্টেশন মাস্টারকে বোঝায়। তিনি সহানূভূতির সাথে বিষয়টি দেখেন এবং বলেন, যখন পারবেন টিকিট কাটবেন, না পারলে আমাকে জানাবেন। এইভাবে আমাকে সেখানে যাতায়াত করতে হত। সেদিন আমাদের খাওয়ার সংস্থান, থাকার সংস্থান কিছুই ছিল না। আজকের মতো মোবাইল ফোনের সুবিধাও সেদিন ছিল না। পুরনো অফিসে একটা ফোন ছিল শুধুমাত্র। ফলে ফোনের যোগাযোগও কার্যত ছিল না। এখানে এলেই একমাত্র এদের সাথে কথা হত। বহুদিন আমি ভাটপাড়া অফিসে এসেছি। কথাবার্তা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে নানা বিষয় নিয়ে। আমি আমার তখনকার উপলব্ধি অনুযায়ী যতটা পেরেছি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এখনকার ছাত্র-যুবক কর্মীদের আমি বলি, তোমরা কত ভাল বক্তৃতা দাও, আমি তো এরকম বক্তৃতা দিতে পারতাম না। তা হলে আমি কী ভাবে কাজ করতাম? কমরেড অসিত ভট্টাচার্য রয়েছেন, উনি বলতে পারবেন, আমি কেমন আলোচনা করতাম। প্রচুর তত্ত্বকথা আমি জানতাম না। শুধু একটা জিনিস মনের মধ্যে কাজ করত, যে ভাবেই হোক, ছাত্রদের কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার দ্বারা অনুপ্রাণিত করতে হবে, গভীর ভালবাসার সাথে তাদের আকৃষ্ট করতে হবে। তারপরে কী বলেছি, কী বুঝিয়েছি, এ সব কথা আজ আর মনে নেই।
স্কুল শেষ করে সদানন্দ নৈহাটি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে বহুদিন থেকেই ছাত্র ব্লকের ইউনিয়ন ছিল। এ রাজ্যে তখন অবিভক্ত সিপিআই-এর বিরাট প্রভাব সত্তে্বও তাদের ছাত্র সংগঠন এআইএসএফ এই কলেজে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না। তাদের নেতা দীনেশ মজুমদার আমাদের অ্যাপ্রোচ করেন এবং স্টুডেন্টস ইউনিয়ন ইলেকশনে আমরা যুক্তভাবে ফাইট করি। এই ফাইটের ভিত্তিতে এআইএসএফ প্রেসিডেন্ট এবং আমরা জেনারেল সেক্রেটারি পদ পাই। সদানন্দ প্রথম জেনারেল সেক্রেটারি হন এবং পরপর বেশ কয়েকবার আমাদের সংগঠন থেকে জেনারেল সেক্রেটারি হয়। যখন ডিএসও গঠিত হয়, সেই সমাবেশে কালীধন ইনস্টিটিউশন, যেখানে পার্টিতে যুক্ত হওয়ার আগেই রাজনীতিতে আমার হাতেখড়ি হয়েছিল, সেখানকার কিছু ছাত্র, তখন আমি কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, কলেজের কিছু ছাত্র, কমরেড বাদল পালের নেতৃত্বে উল্টোডাঙার কিছু ছাত্র আর কমরেড সদানন্দ বাগলের নেতৃত্বে উত্তর ২৪ পরগণার কিছু ছাত্র উপস্থিত হয়েছিল। এই নিয়েই ডিএসও-র প্রথম সম্মেলন হয়। এ ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য। প্রতিষ্ঠা সম্মেলনেই তিনি ডিএসও-র রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ওই জেলায় এবং পরবর্তীকালে রাজ্যের বাইরেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। আমি লক্ষ করেছি, সদানন্দ ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানপিপাসু। প্রথম থেকেই বিভিন্ন প্রশ্ন করে করে সমস্ত বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিনি বুঝতে চাইতেন।
আপনারা অনেকেই জানেন, আমাদের দল যখন গড়ে উঠছিল, আমাদের শক্তি খুবই সীমিত ছিল। মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত পার্টি এবং মহান মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থন নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সিপিআই এ দেশে তখন প্রবল শক্তিশালী। ঠাকুর পরিবারের সৌমেন ঠাকুরের হাতে গড়া আরসিপিআই, নেতাজি প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড ব্লক, স্বদেশি আন্দোলনের বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির শক্তির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আরএসপি, ‘শ্রমিকদের নিয়েই একমাত্র পার্টি গড়ে উঠবে, এর মধ্যে কোনও মধ্যবিত্ত থাকবে না’– এই বক্তব্যের ভিত্তিতে মূলত ডক শ্রমিকদের নিয়ে বলশেভিক পার্টি, কয়েক হাজার শ্রমিককে নিয়ে ইউনিয়ন করা ডেমোক্রেটিক ভ্যানগার্ড পার্টি– এই সব পার্টিগুলিরই তখন ছিল বিরাট শক্তি। বলশেভিক পার্টির নেতা সীতা শেঠের এই জগদ্দল, শ্যামনগরে খুবই প্রভাব ছিল সেই সময়ে। অন্য দিকে আমরা ১৫-২০ জন লোক নিয়ে মিছিল করেছি, ১০০-১৫০ লোক নিয়ে মিটিং করেছি। কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্যে আপনারা পেয়েছেন, ওঁকে কত ব্যঙ্গবিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছে, তাঁর ছাত্র হিসাবে আমাদেরও সহ্য করতে হয়েছে, সদানন্দকেও এই সব সহ্য করতে হয়েছে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) দলকে গ্রহণ করা, কর্মী হিসাবে লাগাতার কষ্টসহিষ্ণু সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া কত কঠিন ছিল! কমরেড সদানন্দ বাগল সেই দুঃসাধ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং আমৃত্যু বিপ্লবী ঝান্ডা বহন করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম দিকে কমরেড সদানন্দের মনের মধ্যে প্রশ্ন আসত, সোভিয়েট পার্টি, চিনের পার্টি আমাদের কেন সমর্থন করে না, এই ক’জন লোক নিয়ে আমরা কী করতে পারব, ইত্যাদি। সেই সময় এই প্রশ্নগুলি অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। আমি যখন এখানে আসতাম, তখন এই সব নানা প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হত। এমন দিন গেছে যে আলোচনা করতে করতে শেষ ট্রেনও ধরতে পারিনি। ওর বাড়িতে আমার যাওয়ার উপায় ছিল না, কারণ ওর বাড়ি তখন ছিল পার্টিবিরোধী। ফলে ওকে নিয়ে আমাকে এক ঠোঙা মুড়ি খেয়ে স্টেশনেই রাত কাটাতে হয়েছে। আমি এতে অভ্যস্ত ছিলাম, কিন্তু সদানন্দ অভ্যস্ত ছিল না। সে জন্য ওকে এইসব নিয়ে মন খারাপ করতে কখনও দেখিনি। এইভাবে ভাটপাড়া, শ্যামনগরে পার্টি ও ডিএসও সংগঠন গড়ে ওঠে। এই ভাটপাড়ায় কমরেড শিবদাস ঘোষ কয়েকবার রাজনৈতিক ক্লাস করেছেন, ডিএসও সম্মেলনে ভাষণ দিয়েছেন। এখানেই কৃষক ও খেতমজুর সম্মেলনে ১৯৬০ সালে তাঁর ঐতিহাসিক আলোচনা ‘মার্ক্সবাদ ও মানব সমাজের বিকাশ প্রসঙ্গে’। তখন পার্টির টেপ রেকর্ডার কেনার সামর্থ ছিল না। স্থানীয় এক যুবকের রেকর্ডারে রেকর্ড করে সেখান থেকেই পরে সংগ্রহ করা হয়। এই সম্মেলনের প্রস্তুতিতে সদানন্দের বিশেষ ভূমিকা ছিল।
সদানন্দ বাগলকে সংগঠন গড়ার জন্য কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে, এই সব কখনও বলতে হয়নি। তিনি নিজের উদ্যোগেই কাজ করে গেছেন। দিবারাত্র পরিশ্রম করেছেন। তাঁর পিতা ছিলেন চটকল শ্রমিক। তিনি জগদ্দলের শ্রমিক বস্তিতে চরম দারিদ্র প্রত্যক্ষ করেছেন। এই দারিদ্রপীড়িত শোষিত শ্রমিক ও জনগণের প্রতি তাঁর গভীর দরদবোধ তখনই গড়ে ওঠে এবং পরবর্তীকালে দলের শিক্ষায় সেই দরদী মন আরও শক্তিশালী হয়। তিনি ডিএসও-র কাজ করতে করতে নিজের থেকেই শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতেন। এই ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের নানা জায়গায় তিনি বহু লোককে পার্টিতে যুক্ত করেছেন, কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার দ্বারা অনুপ্রাণিত করেছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন। প্রয়াত কমরেড দীপঙ্কর রায় নরেন্দ্রপুর স্কুলের শিক্ষকের দ্বারা যেমন অনুপ্রাণিত হয়েছেন, আবার সদানন্দ বাগলেরও তাঁর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। প্রয়াত শিক্ষক নেতা কমরেড রতন লস্করকেও যুক্ত করার ক্ষেত্রে সদানন্দ বাগলের ভূমিকা ছিল।
এখানে একটা কথা আমি বলে যেতে চাই যে, পাবলিকের সাথে মেশা ছিল তাঁর স্বাভাবিক গুণ। এটা কোনওদিন তাঁকে সার্কুলার দিয়ে বা নির্দেশ দিয়ে বলতে হয়নি। প্রথম থেকেই এটা তাঁর একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল। যেখানেই থাকতেন, সেখানকার লোকজনের সাথে মিশতেন। এবং তাঁর এই মেশার মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে পার্টির বক্তব্য চলে যেত, পার্টির প্রতি জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারতেন– এটা আমি দেখেছি। কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে হোক, ক্লাবের অনুষ্ঠানে কিংবা বাড়ির কোনও উৎসবে হোক, তিনি গেলে সেখানে লোকজনের সঙ্গে যে শুধু মিশতেন তাই নয়, তাঁর কথাবার্তার মধ্য দিয়ে, গল্প করার মধ্য দিয়ে তাঁদের মধ্যে পার্টির চিন্তা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। তাঁর ব্যাগে সবসময় পার্টির পত্রপত্রিকা, গণদাবী থাকত। লোকজনের সাথে কথা বলতে বলতে যখনই সুযোগ পেতেন, গণদাবী বা পার্টির বইপত্র তাদের দিতেন। ট্রেনে কোথাও যাওয়ার সময়েও সহযাত্রীদের সাথে কথা বলতে বলতে তাঁদের কাছে পার্টির বক্তব্য পৌছে দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
পরবর্তীকালে যখন তিনি শ্যামনগরে চলে আসেন, একটা সাইকেল নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়াতেন, কমরেডদের বাড়ি যেতেন, তাদের খোঁজ নিতেন, এমনকি সাধারণ মানুষের বাড়ি গিয়ে গিয়েও তিনি খোঁজ নিতেন। বিরোধী দলের লোকদের সাথেও তিনি যোগাযোগ রক্ষা করতেন, তাঁদের সাথে আলাপ-আলোচনা করতেন। ফলে মতপার্থক্য থাকলেও বিরোধী দলের লোকদেরও তাঁর প্রতি একটা গভীর আকর্ষণ ছিল, শ্রদ্ধাবোধ ছিল। প্রায় সকলেরই বিপদে আপদে ছুটে যেতেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি এই এলাকায় একজন জননেতা হিসাবে গড়ে উঠেছিলেন। তিনি যে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পরবর্তীকালে সেই স্কুলেরই হেড মাস্টার হন। কিন্তু দলের কাজের প্রয়োজনে সেই হেড মাস্টারের চাকরি কন্টিনিউ করেননি। এমন নয় যে পার্টি তাঁকে করতে বারণ করেছিল, তিনি নিজেই পার্টির কাছে এসে বলেছেন, আমার এখন যা দায়িত্ব, তাতে এই কাজ করা চলে না। আমার পরে যে আছে, তাকে এই দায়িত্ব দিই। সে-ও পার্টি কমরেড। সে তো শুনে চমকে উঠেছে। বলেছে, আমি কী করে সামলাব! সদানন্দ বলেছেন, তোমাকে আমি সাহায্য করব, কিন্তু তুমি দায়িত্বটা নাও। তাকে হেড মাস্টার করে সদানন্দ জেলা পার্টির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।
সেই সময় এবিটিএ ছিল দলমত নির্বিশেষে শিক্ষকদের সংগঠন। কিন্তু সিপিএম ধীরে ধীরে এবিটিএ-র নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে অন্য দলগুলিকে কোণঠাসা করতে থাকে। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যাতে কোনও ভাবেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আর কাজ চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে সেই সংগঠনে ভাঙন ধরে এবং এসটিইএ গঠিত হয়। এসটিইএ-র প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে আমাদের দলের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রয়াত সদস্য কমরেড তপন রায়চৌধুরীর সঙ্গে সদানন্দ বাগলের নামও উল্লেখযোগ্য। এই সংগঠন গড়ে তোলার জন্য সদানন্দ সমগ্র পশ্চিমবাংলায় ঘুরেছেন, স্কুলে স্কুলে যোগাযোগ করেছেন, শিক্ষকদের বুঝিয়েছেন, তাঁদের সংগঠনে যুক্ত করেছেন, এসটিইএ-র আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। শোকপ্রস্তাবে আরও অনেকগুলি সংগঠনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে (যেমন পরিবহণ যাত্রী কমিটি, সিপিডিআরএস) যেগুলি সবই রাজ্যস্তরের সংগঠন। প্রত্যেকটি সংগঠন গড়ে ওঠার পিছনে তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে পার্টি তাঁকে যেসব জায়গায় পাঠিয়েছে, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, পুরুলিয়া, বীরভূম বা বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনী কাজে তিনি যেসব জায়গায় গিয়েছেন, সর্বত্রই সেখানকার লোকের মধ্যে একটা ছাপ ফেলে এসেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও হিন্দিভাষী এলাকায় তিনি গেছেন। কোনও দিন তাঁর মুখে শুনিনি যে আমার এই অসুবিধা আছে, আমি পারব না। তিনি ১৯৫৪ সালের শিক্ষক আন্দোলন, ১৯৫৫-র গোয়া মুক্তি আন্দোলন, ১৯৫৬-র বাংলা-বিহার সংযুক্তি বিরোধী আন্দোলন, ১৯৫৯-এর খাদ্য আন্দোলন, ১৯৬৬-র খাদ্য আন্দোলন থেকে শুরু করে সিপিএম শাসনকালে ভাষাশিক্ষা আন্দোলন, বাসভাড়া বৃদ্ধিবিরোধী আন্দোলন, মূল্যবৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন এ সব প্রত্যেকটি আন্দোলনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এখানে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আমি বলতে চাই। কমরেড সদানন্দ ফ্যামিলি লাইফে থাকলেও তাঁর বৃদ্ধ বাবা-মার প্রতি কী অ্যাপ্রোচ হবে, স্ত্রীর প্রতি কী অ্যাপ্রোচ হবে, তাঁর একটি অসুস্থ ভাই ছিল, তার প্রতি অ্যাপ্রোচ কী হবে, শিক্ষক হিসাবে যে টাকা রোজগার করেছেন সেই টাকার প্রতি অ্যাপ্রোচ কী হবে– অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি নেতৃত্বের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে পার্টির গাইডেন্স নিয়ে চলেছেন। শ্যামনগর এলাকায় পার্টির কোনও সেন্টার ছিল না। কিন্তু সেন্টার লাইফে না থাকলেও তাঁর পারিবারিক জীবনটা ছিল মোর দ্যান এ সেন্টার লাইফ। তাঁর স্ত্রীও পার্টির কর্মী ছিলেন, যদিও তিনি এখন অসুস্থ। এই হাউসে আমি বলতে চাই যে, সদানন্দ বাগলের রক্ত-মাংস-মজ্জায় পার্টি মিশে ছিল এবং তিনি ছিলেন খুবই দৃষ্টান্তমূলক একটি চরিত্র।
কমরেড কমল ভট্টাচার্য যখন ব্যারাকপুরের পার্টি ইনচার্জ, তাঁর সহকর্মী হয়ে তাঁরই অধীনে সদানন্দ কাজ করেছেন। কমরেড কমল ভট্টাচার্যের ছিল ধীর-স্থির-সতর্ক পদক্ষেপ, অন্য দিকে সদানন্দ বাগলের ছিল বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। কর্মপ্রক্রিয়া নিয়ে দু-জনের মাঝে মাঝে মতবিরোধ হত। কিন্তু কখনও খুব তর্কবিতর্ক হয়েছে বলে শুনিনি। কমল ভট্টাচার্যের খুব অভিমান হত। হয়তো একদিন সদানন্দ পার্টি অফিসে গেছেন, কমল ভট্টাচার্য ভাল করে কথা বলছেন না। সদানন্দও চেষ্টা করে যাচ্ছেন কী করে কথা বলানো যায়। মাঝখানে থাকতেন কমরেড ইন্দ্রাণী হালদার। তিনি ইতিমধ্যেই কমরেড কমল ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেছেন। তিনিও অধিকাংশ সময়েই সদানন্দ বাগলের পক্ষেই থাকতেন। এই রকম চলত মাঝেমধ্যেই। কিন্তু আপনারা জেনে অবাক হয়ে যাবেন, কমরেড সনৎ দত্তকে যখন অসুস্থতার জন্য জেলা সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দিতে হচ্ছে, নতুন জেলা সম্পাদক ঠিক করতে হবে, সেই কর্মীসভায় বেশ কিছু কমরেড জেলা সম্পাদক হিসাবে কমরেড কমল ভট্টাচার্যের নাম প্রস্তাব করেন। আমি সেই সভায় ছিলাম। কমরেড কমল ভট্টাচার্য সেই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, আমার থেকে কমরেড সদানন্দ বাগল সংগ্রামে অনেক এগিয়ে, জেলা সম্পাদক তাঁরই হওয়া উচিত। অর্থাৎ কমরেড সদানন্দ বাগল সম্পর্কে কমরেড কমল ভট্টাচার্যের মনে গভীর শ্রদ্ধাবোধ গড়ে উঠেছিল। এই ছিল তখনকার দিনের কমরেডদের পারস্পরিক সম্পর্ক। সেই সময়ে অল্প সংখ্যক কর্মী হলেও কমরেডদের মধ্যে খুবই আবেগপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
আপনারা জানেন, আমাদের দলকে কমরেড শিবদাস ঘোষ গড়ে তুলেছিলেন মার্ক্সবাদকে ভারতবর্ষের মাটিতে নতুনভাবে সৃজনশীল প্রয়োগের দ্বারা। এই সৃজনশীল প্রয়োগ করতে গিয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ মার্ক্সবাদের জ্ঞানভাণ্ডারে কিছু অবদানও রেখেছেন যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সর্বহারা সংস্কৃতি এবং সর্বহারা সংস্কৃতির ভিত্তিতে উন্নত নীতিনৈতিকতা। ফলে আমাদের দলটা একটা পরিবারের মতো। অন্যান্য দলের মতো শুধু কিছু মিছিল-মিটিং, ভোটের প্রচার, চাঁদা তোলা, পত্র-পত্রিকা বিক্রি– এ রকম নয়। কমরেড শিবদাস ঘোষ দলের প্রত্যেকটি কর্মীকেই মূল্যবান সম্পদের মতো গণ্য করতেন, আমাদেরও সেইভাবেই তিনি শিখিয়েছেন। আজকের দিনে যখন সমস্ত পরিবার ভাঙছে, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, চূড়ান্ত স্বার্থপরতা, নৈতিকতার অবনমন ঘটছে, এমনকি বৃদ্ধ বাবা-মাকে রাস্তায় বের করে দিচ্ছে, বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে, সম্পত্তির লোভে খুন করছে, সেই পরিস্থিতিতে কমরেড শিবদাস ঘোষের অমূল্য শিক্ষার ভিত্তিতে আমরা একটা অন্য রকমের ঐক্যবদ্ধ পরিবার গড়ে তুলছি একে অন্যের সাথে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও। সেখানে কোনও ধর্ম-বর্ণ-জাতের প্রশ্নই নেই। এ ক্ষেত্রে কেউ এগিয়ে, কেউ মাঝখানে, কেউ পিছিয়ে। যে যতটা এই শিক্ষাকে আয়ত্ত করছে পেরেছে, সে ততটাই তার জীবনে এটা প্রয়োগ করতে পারছে।
কমরেডস, আজ ভারতবর্ষে ২৫টি রাজ্যে আমাদের দলের কাজ চলছে। কোনও পরিচিত কমরেডের মৃত্যু হলে আমরা যে ব্যথা পাই, অন্য কোনও রাজ্যে দলের যে কোনও কর্মী বা নেতার মৃত্যু ঘটলে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের অপরিচিত হলেও আমরা সেই ব্যথাই পাই। শুধু তাই নয়, মহান স্ট্যালিনের মৃত্যুতেও আমরা সেই ব্যথা পেয়েছি যে ব্যথা আমরা আমাদের মহান শিক্ষক কমরেড শিবদাস ঘোষের মৃত্যুতে পেয়েছি। আমরা কমরেড ঘোষের ঘনিষ্ঠ ছিলাম, ফলে আবেগ একটু বেশি ছিল– এইটুকুই পার্থক্য। আবার মহান মাও সে তুং-এর মৃত্যুতে, ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধারা যখন আক্রান্ত হচ্ছে, আত্মাহুতি দিচ্ছে, আমাদের প্রাণে একই ব্যথা জাগত আন্তর্জাতিকতাবাদী হিসাবে। আমরা এই শিক্ষাই পেয়েছি এবং আজকের দিনে যারা নতুন কর্মী, তাদেরও এই শিক্ষার ভিত্তিতেই নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। সদানন্দ বাগলও এই শিক্ষার ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিলেন।
সদানন্দ বাগলের চরিত্রের আর একটি বৈশিষ্টের কথা আমি এখানে বলতে চাই। দলের বিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁর এতসব কাজ, এত যোগাযোগ, তাঁর এই ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও আমি এই করেছি, ওই করেছি– এই সব কথা কর্মীদের সামনে তো নয়ই, আমাদের সামনেও আমি কোনও দিন বলতে শুনিনি। এই শোকপ্রস্তাবে যে বলা হয়েছে, যে কোনও জুনিয়র কর্মী তাঁর কাছে অকপটে দ্বিধাহীন ভাবে তার মতভেদ এমনকি তাঁর সম্পর্কে সমালোচনা ব্যক্ত করতে পারত– তা একেবারে সঠিক। সমালোচনা সঠিক হলে তিনি গ্রহণ করতেন, না হলে সেই কমরেডটিকে বুঝিয়ে বলতেন। জুনিয়র কোনও কর্মী কোথাও ভাল কাজ করছে দেখলে বা জানতে পারলে তিনি খুবই উৎসাহিত করতেন। কাজের সমস্যা হলে বা ব্যর্থ হলেও আমি কোনও দিন তাঁর মুখে কখনও দুশ্চিন্তার ছাপ, বিষণ্নতার প্রভাব লক্ষ করিনি। সদানন্দর সাথে আমার অত্যন্ত অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। দীর্ঘদিন তিনি আমার সহকর্মী ছিলেন। ডিএসওতে আমার নেতৃত্বে কাজ করেছেন, আমি সম্পাদক, উনি কমিটির সদস্য। আবার পরবর্তীকালে দলের রাজ্য কমিটিতেও আমি সম্পাদক, উনি রাজ্য কমিটির সদস্য। তাঁর সাথে আমার ছিল দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আমি দেখেছি বিপ্লবী জীবনকে তিনি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গেই নিয়েছিলেন। এটা প্রায় সময়েই তাঁর রসসঞ্জাত আলোচনার মধ্যে প্রকাশ পেত। যে কোনও দায়িত্ব পালনে মনপ্রাণ ঢেলে মগ্ন হয়ে কাজ করতেন। যে কোনও নেতা-কর্মী তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তাঁরা সকলেই তাঁর এই চরিত্রের মাধুর্যে আকৃষ্ট হয়েছেন।
আর একটা ঘটনাও এখানে বলা দরকার, তিনি কোন পোস্টে আছেন, তাঁকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কি না– এ সব নিয়ে তাঁর কোনও মাথাব্যথা ছিল না। যখন রাজ্যের বৃহত্তর দায়িত্বের জন্য তাঁকে জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে বলা হয়, তিনি কোনও আপত্তি করেননি এবং পরবর্তী জেলা সম্পাদককে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। যতদিন পেরেছেন, বাইরের কাজ করেও ওই জেলায় সময় দিয়েছেন। আবার যখন খুবই অসুস্থ ও অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন, পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসের প্রাক্কালে রাজ্য কমিটির সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন। তার পরও যত দিন চলৎশক্তি ছিল কমরেডদের অনুপ্রাণিত করতেন। এলাকায় যোগাযোগ রক্ষা করতেন। যতক্ষণ কথাবার্তা বলতে পারতেন কমরেডরা দেখা করতে গেলেই শুধু পার্টির কাজকর্মের খবরাখবর নিতেন। চোখে যখন দেখতে পেতেন না, কমরেডদের বলতেন পার্টির বইপত্র বা গণদাবী পড়ে শোনাতে।
ফলে কমরেডদের আমি বলব, আজ শুধু এই মাল্যদান বা শোকপ্রস্তাব গ্রহণ– এমন আনুষ্ঠানিক অর্থে কেউ এই স্মরণসভাকে নেবেন না। যিনি প্রয়াত, তাঁকে আমরা আর ফিরে পাব না। আগামী দিনে আরও অনেক কমরেড প্রয়াত হবেন, আমরাও থাকব না। আপনাদের মধ্যে যাঁরা বৃদ্ধ, তাঁরাও থাকবেন না। কিন্তু পার্টি থাকবে, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা থাকবে, কমিউনিজমের লড়াই থাকবে। শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের ক্ষেত্রেও কমরেড শিবদাস ঘোষ মার্ক্সবাদকে উন্নত এবং বিকশিত করে যে গাইডলাইন উপস্থিত করেছেন, সমসাময়িক অনেক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তা আজও প্রাসঙ্গিক। আবার কিছু কিছু নতুন সমস্যা দেশে আসছে, বিদেশেও আসছে, মার্ক্সবাদের শিক্ষা অনুযায়ী আমাদের সেইগুলি সমাধানও করতে হচ্ছে।
এই দলের শক্তিবৃদ্ধির উপরেই ভারতবর্ষের শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি সংগ্রাম, পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লবী সংগ্রামের সফলতা নির্ভর করছে। বহুদিন আগেই মহান লেনিন বলে গেছেন বিশ্বপুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ মুমূর্ষু, আজ সে মৃত্যুশয্যায়। ফলে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের যাই সঙ্কট হোক, এই আন্দোলনের আরও অগ্রগতি ঘটাতে হবে। এই যে এখন শুল্ক নিয়ে দেশে দেশে আমেরিকার হুমকি, তা মৃতপ্রায় পুঁজিবাদেরই আর্তনাদ। কারণ আমেরিকা চরম সঙ্কটগ্রস্ত। সে তার বাজার রক্ষা করার জন্য এবং অন্যের বাজার গ্রাস করতে লড়াই চালাচ্ছে। এখন ট্রেড ওয়ার, ইকনমিক ওয়ার চলছে। এটা সশস্ত্র যুদ্ধেও পরিণত হতে পারে। তার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু অত্যাচারিত-নিপীড়িত শ্রমিক শ্রেণিও দেশে দেশে মাথা তুলছে। আমেরিকাতেও সাত মাস ধরে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন হয়েছে। আবারও এখন ট্রাম্প বিরোধী আন্দোলন চলছে। তুরস্কে আন্দোলন চলছে। এই সব আন্দোলন প্রমাণ করে যাচ্ছে শ্রমিক শ্রেণি আজও মরে যায়নি। আরবে আরব স্প্রিং অভ্যুত্থান ঘটল। এ রকম দেশে দেশে নানা আন্দোলন চলছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক ধর্মঘটের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিপ্লবী নেতৃত্ব নেই। যথার্থ মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের আজকের পরিস্থিতি অনুযায়ী যে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রয়োজন, যা একমাত্র কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতেই হতে পারে, এরই ভিত্তিতে এই সংগ্রামগুলি পরিচালিত হলে এই সঙ্কটগ্রস্ত পুঁজিবাদকে পরাস্ত করে বিপ্লবী আন্দোলন বহু দূর যেতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে চিনের বিপ্লব, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে একটা বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। আবার কতকগুলি কারণে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটেছে। তারও ব্যাখ্যা আমরা মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের শিক্ষা থেকে পাই। এগুলি আগেও আমরা আলোচনা করেছি, এখনও করছি। এর ভিত্তিতে এ দেশের মানুষকেও সচেতন সজাগ করতে হবে, বিশ্বের শ্রমিক আন্দোলনের সামনেও আমাদের চিন্তাকে পৌঁছে দিতে হবে। তার জন্য বিপ্লবী দলকে শক্তিশালী করতে হবে, তার জন্য প্রয়োজন কমরেড সদানন্দ বাগলের মতো অসংখ্য এই ধরনের বিপ্লবী নেতা যাঁরা সারা জীবন সমস্ত রকম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন।
আমার একটা দুঃখ থেকে গেছে, কমরেড সদানন্দ হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে কমরেড রূপম আমাকে ফোনে তাঁর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল। তিনি কাঁদছিলেন, অস্পষ্ট কথা। আমি ভেবেছিলাম, একবার দেখতে আসব। কিন্তু আসতে পারলাম না। আর হাসপাতালেও ডাক্তাররা আমাকে যেতে দেন না, যাতে রোগাক্রান্ত না হই। তাই কমরেড সদানন্দ বাগলের সাথে আমার শেষ দেখা হল না– এই দুঃখটা আমার থেকে গেল।
যাই হোক, কমরেডদের কাছে আমার আবেদন, এই চরিত্র থেকে শিক্ষা নিয়ে আপনারা এই স্মরণসভা থেকে ফিরে যাবেন। এই অনুষ্ঠানই যেন শেষ না হয়। মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে কমরেড সদানন্দ বাগল যে ভাবে আজীবন সংগ্রাম করেছেন, তার থেকে শিক্ষা নিয়ে আপনারা যারা যে জায়গায় আছেন, আরও অধিকভাবে অগ্রসর হবেন, দলকেও শক্তিশালী করবেন। না হলে আজকের এই স্মরণসভার কোনও প্রয়োজন নেই।
আমি বিশ্বাস করি এবং আপনারাও সকলেই আমার সাথে এক মত হবেন এবং সেই ভাবেই আপনারা কমরেড সদানন্দ বাগলের চরিত্র থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন, বিপ্লবী নেতা-কর্মী হিসাবে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করবেন– এই কথা বলেই আমি আবার কমরেড সদানন্দ বাগলকে লাল সেলাম জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ১৮ এপ্রিল ২০২৫ এ প্রকাশিত