নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন
আইনের চোখে সকলেই সমান নয়
‘আইনের চোখে সকলেই সমান’– এতদিন আইনের রচয়িতারা এ কথা বললেও এখন আর তাদের পক্ষেও এটা বলার কোনও অবকাশ থাকল না। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পাশ হয়ে যাওয়ার পর আইনগত ভাবেই পরিষ্কার হয়ে গেল, আইনের চোখে সকলেই সমান নয়। এই আইন মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষদের নাগরিকত্ব দেওয়ার পরিপন্থী। এই আইন ভারতের প্রতিবেশী তিনটি দেশ ছাড়া বাকি দেশগুলির ধর্মীয় কারণে নিপীড়িত মানুষদের পুনর্বাসনের বিষয়টি সচেতনভাবে উপেক্ষা করেছে। বাস্তবে সিএএ উৎপত্তিগতভাবেই একটি বৈষম্যমূলক আইন ।
এই আইন পাশ হওয়ার আগেই অবশ্য বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের মধ্যে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, আইনের চোখে সকলেই সমান নয়। যার টাকা আছে বাস্তবে আইনের সুযোগ তার পক্ষেই নেওয়া সম্ভব। বহু গরিব, নিম্ন আয়ের মানুষ চূড়ান্ত বঞ্চিত-নির্যাতিত হয়েও শুধু টাকার অভাবে বিচারালয়ের দ্বারস্থ হতে পারেন না। আবার অনেকে ঘটি বাটি বিক্রি করে বিচারালয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিলেও প্রথম সারির উকিল নিযুক্ত করতে পারেন না। কারণ এঁদের ধার্য ফি দেওয়ার মতো সঙ্গতি তাঁদের নেই। সুপ্রিম কোর্টে বিচারের জন্য যাওয়ার কথা তো এঁরা কল্পনাই করতে পারেন না।
অপরদিকে ধনীরা অর্থের জোরে সবরকম আইনি সুযোগ নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। অতি ধনীরা বহু অপরাধ করেও অর্থের জোরে বিচার প্রক্রিয়াকে তাঁদের অনুকূলে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন এবং করেও থাকেন। এঁরা শুধু কোর্ট নয়, এম এল এ, এমপি, মন্ত্রী সহ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের অর্থের জোরে প্রভাবিত করে নিজ স্বার্থ সিদ্ধ করে থাকেন।
‘আইনের চোখে সকলেই সমান’– একটি মহৎ ঘোষণা। কিন্তু এই ঘোষণা আজ ব্যর্থতায় বা প্রহসনে পর্যবসিত আর্থিক বৈষ্যমের কারণে। ধনী ও গরিবে সমাজ বিভাজনের ফলেই এই ঘোষণা বাস্তব রূপ নিতে পারছে না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার তাই গরিবদের কাছে মূলত অধরা।
‘আইনের চোখে সকলেই সমান’– এই ধারণা পুঁজিবাদই এনেছিল। পুঁজিবাদ তার বিকাশের প্রয়োজনে সামন্তী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে এই ধারণার জন্ম দিয়েছিল। সামন্ততন্তে্রর বিরুদ্ধে কয়েকশো বছরের লড়াইয়ের পর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল নিয়ম হল সর্বাধিক মুনাফা অর্জন। এই নিয়ম সমাজে আর্থিক শোষণ তীব্র করে। ধনী ও গরিবে ফাটল আরও চওড়া করে। ফলে সাম্য, মৈত্রী এবং গণতন্ত্রের যে ধারণা পুঁজিবাদ তার প্রতিষ্ঠা পর্বে তুলে ধরেছিল পরবর্তী কালে সেই ধারণাকেই সে আঘাত করতে থাকে। বাস্তবে পুঁজিবাদের মতো একটা বৈষম্যমূলক সমাজ কোনও স্তরেই সাম্যের ধারণা নিয়ে চলতে পারে না।
শোষণমূলক এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য জনগণের ঐক্য ধ্বংস করাও আজ অবক্ষয়িত পুঁজিবাদের প্রয়োজন। এই পুঁজিবাদের অন্যতম প্রধান রক্ষক-সেবক ভারতীয় জনতা পার্টি ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন বহুকাল ধরে করে চলেছে। সম্প্রতি নাগরিক আইনের মধ্য দিয়ে বিভাজনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাইছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদ রক্ষা পাবে না। কারণ পুঁজিবাদী শোষণ অনিবার্যভাবে শোষণমুক্তির আকাঙক্ষার জন্ম দিয়ে চলেছে। সেই আকাঙক্ষাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শোষিত মানুষের মধ্যে ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি করছে। বৈষম্যের সমাজ দীর্ঘকাল টিকলেও চিরকাল টিকতে পারে না। অর্থনীতিতে সাম্য না এলে আইনের চোখে সকলেই সমান এই ধারণা বাস্তব রূপ পাবে না। শোষক শ্রেণি আজ সমাজপ্রগতির অন্তরায়। আজ আর তার দেওয়ার কিছু নেই। মানবসমাজের অগ্রযাত্রার এই প্রতিবন্ধককে তাই উৎখাত করতেই হবে।