শহর কলকাতার কালীঘাট৷ ১৩ ও ১৫ বছরের দুটি ফুটপাতবাসী মেয়ে সামান্য কিছু পয়সার আশায় মাটি কাটতে গিয়েছিল গঙ্গার ধারে৷ সেখানেই তিনজন তাদের উপর শারীরিক নির্যাতন চালায়, তাদের একজন নাবালক৷ ছোট মেয়েটি মন্দিরে ভিক্ষা করে৷ পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে গেলে মেয়েটির মা’র প্রশ্ন, পুলিশ ওকে রেখে দিলে আমরা খাব কী? শপিং মল, ফ্লাইওভারের আলোকমালায় সাজানো কলকাতার বুকেই এ এক অন্য কলকাতা৷ অভাবের কামড় সেখানে এমনই মর্মান্তিক৷ ডিজিটাল ভারত– ‘বেটি বঁচাও, বেটি পড়াও’–এর সরকারি বিজ্ঞাপনকে এ অন্ধকার ভারত বড় বিদ্রূপ করে৷
রাঁচিতে ভিআইপি জোনের মধ্যে বন্দুক ঠেকিয়ে এক কলেজ ছাত্রীর উপর অত্যাচার চালিয়েছে একদল ধর্ষক৷ হায়দরাবাদে পশুচিকিৎসক তরুণীর নিত্যদিনের যাতায়াতের রাস্তায় তাঁকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অত্যাচার চালিয়েছে একদল নরপশু৷ তারপর গলা টিপে মেরে ২৫ কিলোমিটার দূরে পেট্রল ঢেলে তাঁর দেহ পুড়িয়ে প্রমাণ লোপাট করেছে৷ পরিবারের সদস্যরা দেহ শনাক্ত করেছেন মেয়েটির স্কার্ফ দেখে৷ দুর্বৃত্তরা জেনে উল্লাসে চিৎকার করে উঠবে যে, পুলিশ মৃতের বাবার নিখোঁজ ডায়েরিই নিতে চায়নি৷ অত্যাচারিত, ধর্ষিত নারীর আর্তনাদ প্রতি মুহূর্তে দেশের বাতাসকে ভারী করে তুলছে৷ প্রশ্ন উঠছে– এ কোন সভ্যতা?
ঘটনা বাড়ছে, উদ্বেগজনক ভাবে বেড়ে চলেছে অভিযুক্ত নাবালকের সংখ্যাও৷ কেন? কেন্দ্রে–রাজ্যে যে সরকারই গদিতে বসুক, মহিলাদের নিরাপত্তা এভাবে প্রহসনে পরিণত হচ্ছে কেন? প্রায় প্রতিটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে অভিযুক্তরা মদ্যপ৷ মদ খেলে মানুষ অমানুষ হয়ে যায় – এই সহজ সত্যটা সাধারণ মানুষ, বিশেষত মহিলারা তাঁদের অভিজ্ঞতায় জানেন৷ কিন্তু কোনও সরকারই তা স্বীকার করতে চায় না৷ সরকার মদ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে এবং রাজস্বের লোভে যথেচ্ছ মদের লাইসেন্স দিচ্ছে৷ নেতা–মন্ত্রীদের বক্তব্য, মদ খেয়ে মাতাল না হলেই হল৷ সরকারের প্রশ্রয়ে মদের দোকানে ভিড় বাড়াচ্ছে ছেলে–বুড়ো সকলে৷ সরকারি রাজস্ব চড়চড় করে বাড়ে বছর বছর, সেই হারে বাড়ে খুন–ধর্ষণ, অপরাধমূলক কাজ৷ প্রতি ২০ মিনিটে দেশে একজন নারী ধর্ষিতা হন৷ অত্যাচারিত নারীরা বোবা কান্নায় গুমরে মরে৷ কিন্তু তা ব্যবসায়ীদের মুনাফায় যেমন বাধা সৃষ্টি করে না, তেমনই বেড়ে চলে সরকারের ‘জনপ্রিয়তা’ও
মদ ছাড়াও ছোট থেকেই ‘অপরাধী’হওয়ার নানা উপকরণ সমাজে নাবালকদের সামনে মজুত৷ জনমতের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে যেমন সরকার মদের ঢালাও লাইসেন্স দিচ্ছে, তেমনই পর্নোগ্রাফি এবং ব্লু–ফিল্মের রমরমাও চলছে রাজ্য তথা দেশজুড়ে৷ সর্বত্র নারীদেহ পণ্য৷ তার বিপণন চলছে অবাধে৷ পুরুষ–নারীর সুন্দর স্বাভাবিক সম্পর্ককে কদর্য করে তুলছে এই পুঁজিবাদী সমাজ৷ ভাল–মন্দ, ন্যায়–ন্যায় সংক্রান্ত কোনও মূল্যবোধ শিশু বয়স থেকে গড়ে ওঠার পরিবেশ আজ ক্রমেই বিলীয়মান৷ মহিলাদের সম্পর্কে সম্ভ্রমবোধ গড়ে ওঠার পরিস্থিতিও অনুপস্থিত৷ মহিলা মানেই ভোগের বস্তু, তা যে বয়সেরই হোক– এমন কদর্য ভাবনার চোরাস্রোত বইছে সমাজ অভ্যন্তরে৷ এই অবস্থায় শুধু কিছু আইন করে অত্যাচারের সংখ্যা ও ভয়াবহতা কমানো যেতে পারে না৷ অভিযুক্তদের বেশিরভাগেরই শাস্তি হয় না, কোথাও হলেও তা নামমাত্র৷ প্রশাসনের এই ঢিলেঢালা মনোভাবও এ ধরনের ঘটনার সংখ্যাবৃদ্ধির অন্যতম কারণ৷
ঘরে–বাইরে মহিলাদের উপর অত্যাচারের ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভয়াবহতাও৷ বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতার গদি নিয়ে যে পরিমাণ লড়ালড়ি করে, মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে তার অংশমাত্র সোচ্চার হতে দেখা যায় না তাদের৷ তারাই দুষ্কৃতীদের লালন–পালন করে, প্রশ্রয় দেয় ভোটের স্বার্থে৷ উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে কিশোরী ধর্ষণে অভিযুক্ত বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গারের শাস্তি দূরের কথা, দল থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত করতে চায়নি বিজেপি৷ ওই নির্যাতিত তরুণীর গোটা পরিবার এবং ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীকে পর্যন্ত ট্রাক চাপা দিয়ে খুন করার চেষ্টা চালানো হয়েছে৷ গোয়ার এক বিজেপি সাংসদ নাবালিকা ধর্ষণে অভিযুক্ত৷ সরকার, রাজনৈতিক দলগুলি দুষ্কৃতীদের পক্ষ নেওয়ায় বহু ক্ষেত্রে নির্যাতিত মহিলার পরিবারকেও অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হয়, নিরাপত্তার বদলে জোটে পুলিশি জেরার হয়রানি৷
পরিস্থিতি যে কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষেই অসহনীয় হয়ে উঠছে, অথচ ক্ষমতার মসনদে বসা নেতা–মন্ত্রীরা আশ্চর্যজনকভাবে নীরব৷ এ রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাগুলি নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করে বিবৃতিটুকু দেবার সময় পর্যন্ত পাননি৷ হায়দরাবাদের নারকীয় ঘটনার পর তেলেঙ্গানার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উল্টে নির্যাতিতাকে দায়ী করে বলেছেন, নির্যাতিতা কেন পুলিশকে ফোন না করে তাঁর বোনকে ফোন করছিলেন৷ সারা দেশে নারী নিরাপত্তার যখন বেহাল দশা, তখন কথায় কথায় টুইট করা প্রধানমন্ত্রী মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন৷ প্রবল জনআন্দোলনের চাপে কেন্দ্রীয় সরকার নারী–নিরাপত্তার স্বার্থে ‘নির্ভয়া–ফান্ড’ তৈরি করতে বাধ্য হলেও রাজ্যে রাজ্যে তার টাকা কিছুমাত্র খরচ না হয়ে পড়ে আছে৷ অথচ কেন্দ্র–রাজ্য সরকারের এ সংক্রান্ত কোনও নজরদারি নেই৷ এই নির্লজ্জ, নির্বিকার ঔদাসীন্যই বুঝিয়ে দেয়, ভোটের আগে এরা যতই জনদরদের বুলি আওড়াক, সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষা এমনকি মহিলাদের সম্ভ্রম ও নিরাপত্তা দেওয়ার মতো সভ্যতার ন্যূনতম শর্তটুকু রক্ষার ক্ষেত্রে এদের বিন্দুমাত্র দায়িত্ববোধ বা আন্তরিকতা নেই৷
এ লড়াই তাই জনগণেরই লড়াই৷ দেশের প্রান্তে প্রান্তে ধিক্কার জানিয়ে পথে নেমে আসছেন ছাত্র–যুবক–মহিলা, সর্বস্তরের মানুষ৷ কারও জন্য অপেক্ষা না করে দিল্লিতে পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভে বসে পড়েছেন ছাত্রী অনু দুবে৷ তিনি বলেছেন, ‘আজ ওই তরুণীকে পুড়ে মরতে হয়েছে, কাল আমি এভাবে পুড়ে মরতে চাই না৷’ তিনি বলেছেন, ‘আমি কোনও দিন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করব ভাবিনি, কিন্তু হায়দরাবাদের ঘটনায় আমি চুপ করে থাকতে পারলাম না৷’ দিল্লি পুলিশ তাকে টেনে হিঁচড়ে থানায় নিয়ে গেছে, সেখানে নির্যাতন চালিয়েছে৷ তাতে প্রতিবাদের আগুন আরও ছড়িয়ে গিয়েছে দিকে দিকে৷ রাজধানী দিল্লি সহ রাজ্যে রাজ্যে বিক্ষোভ হয়েছে, হায়দরাবাদে হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভে পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে৷ কলকাতায় ডিএসও–ডিওয়াইও–এমএসএস প্রবল বিক্ষোভ দেখিয়েছে, কালীঘাট থানায় ডেপুটেশন দিয়েছে৷ সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়েছে– সরকারকে অবিলম্বে নারী নিরাপত্তার কার্যকরী ব্যবস্থা করতে হবে৷
ঠিক যেভাবে অনুর মতো কিশোরী রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে একা প্ল্যাকার্ড হাতে সংসদের সামনে ধর্নায় বসেছেন, সেই দৃঢ়তা নিয়ে আজ প্রতিটি মানুষকে এমন প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে৷ ঐক্যবদ্ধভাবে একদিকে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷ অন্যদিকে সরকারগুলিকে বাধ্য করতে হবে– মহিলাদের সুস্থ ভাবে বাঁচার পরিস্থিতি তৈরিতে, দুষ্কৃতীদের দমনে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে৷ দিশাহীন যে উত্ভ্রান্ত যুবকরা, বখাটেরা এমন বর্বরতায় নিজেদের যৌবনকে শেষ করছে, তাদের সামনেও তুলে ধরা দরকার যথার্থ জীবনবোধ কী৷