বাজারে আলু–পেঁয়াজ থেকে শুরু করে সবজির আগুন দাম৷ একটা বাঁধাকপি ৫০ টাকা, ফুলকপি ৪০, বেগুন ৭০ টাকা কেজি, জ্যোতি আলু এক কেজি ২২–২৫ টাকা, এমনকি লঙ্কা একশো গ্রাম ৮–১০ টাকা৷ বিপর্যস্ত মানুষ বাজারে গিয়ে নাজেহাল, থলেহাতে শুধু ঘুরছেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত৷ ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জিনিসটুকু কিনে উঠতে পারছেন না৷ খাবার–পাতে তরকারির পরিমাণ কমতে কমতে প্রায় শূন্যে ঠেকেছে৷ কী ভাবে দিন চালাবেন, সন্তান–পরিজনের মুখে পেটভরা খাবার তুলে দেবেন– এই দুশ্চিন্তা রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের৷ অথচ কী কেন্দ্র, কী রাজ্য সব সরকারই নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে৷
এই ভয়ঙ্কর মূল্যবৃদ্ধির কারণ কী? এ বছর কি ফসল কম ফলেছে? আলুর ফলন কি কম হয়েছে? সাম্প্রতিক বুলবুল ঝড়ে কয়েকটি জেলায় ফসলের ক্ষতি হলেও গোটা রাজ্যে তো বিশেষ প্রভাব পড়েনি৷ বাস্তবে ফলনের ঘাটতি নয়, দামবৃদ্ধির পিছনে রয়েছে ফড়ে, আড়তদার, মহাজনদের কারসাজি আর তাদের মাথার উপরে থাকা সরকার ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত৷ তারাই বিপুল পরিমাণে কৃষিজ পণ্য চাষিদের কাছ থেকে কম দামে কিনে মজুত করে রাখে৷ চাষির খেতে নতুন আলু কিছুদিনের মধ্যেই উঠে যাবে৷ অথচ এখনও হিমঘরগুলিতে বিপুল পরিমাণ আলু জমে রয়েছে৷ মানুষ অবাক হয়ে দেখছে,হিমঘর খালি করার মেয়াদ ১৫ দিন বাড়িয়ে দিল সরকার৷ ফলে মজুতদাররা অল্প অল্প করে আলু বাজারে ছেড়ে দাম চড়া রাখছে৷ যে আলু চাষিরা ৩–৪ টাকা কেজি দরে বেচতে বাধ্য হয়েছে, সেই আলু বাজারে ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে৷ বিপুল মুনাফা ঘরে তুলছে মজুতদার, আড়তদার আর ফড়েরা৷ মার খাচ্ছে ক্ষুদ্র চাষি ও গরিব–মধ্যবিত্ত সাধারণ ক্রেতার দল৷
এই বিপর্যয় সামাল দিতে যেখানে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা, ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন’ প্রয়োগ করে কালোবাজারিদের গ্রেপ্তার করার কথা, সেখানে দেখা যাচ্ছে, দুই সরকারই অদ্ভুত ভাবে নীরব৷ কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নেতা–মন্ত্রীরা ব্যস্ত গণতন্ত্রের সমস্ত রীতিনীতি পায়ে দলে যে কোনও উপায়ে গদি দখলের ষড়যন্ত্রে, কিংবা গোটা দেশে এনআরসি চালু করার হুমকি দিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে৷ পাশাপাশি, রাজ্যের তৃণমূল সরকারের অবস্থাও অন্যরকম কিছু নয়৷ গত ১৩ নভেম্বর মূল্যবৃদ্ধি রোধ সহ জনজীবনের ১১ দফা দাবিতে এসইউসিআই(সি)–র নবান্ন অভিযানে বিপুল জনসমাগম লক্ষ করার পরপরই মুখ্যমন্ত্রী দামবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে টাস্ক ফোর্সকে বাজারে ঘুরতে বললেন৷ এক শুভ সকালে মিডিয়া সঙ্গে নিয়ে টাস্ক ফোর্সের আধিকারিকরা কলকাতার কয়েকটি বাজারে গিয়ে কিঞ্চিৎ হম্বিতম্বিও করে এলেন৷ সংবাদমাধ্যমে ফলাও প্রচার হল৷ মানুষ ভাবল এবার দাম কমবে৷ বাস্তবে দেখা গেল, গোটাটাই একটা প্রহসন৷ টাস্ক ফোর্সের কর্তারা যতক্ষণ বাজারে, ততক্ষণ সামান্য কম দামে বিক্রিবাটা চলল৷ তাঁরা বেরিয়ে যেতেই আবার যে কে সেই৷ প্রশাসন কি এ কথা জানে না? তাহলে কেন সরকার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দিচ্ছে না? কেন পুলিশ–প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে না বাজারে বাজারে আচমকা হানা দিয়ে পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখার ও ব্যবস্থা নেওয়ার? কেন সরকারে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে সক্রিয় হচ্ছেন না?
শুধু তাই নয়৷ মূল্যবৃদ্ধির পিছনে আসল কলকাঠি নাড়ে যে ফড়ে–মজুতদাররা, তাদের শাস্তি দিচ্ছে না কেন সরকার? আসলে বেআইনি মজুতদার ও কালোবাজারিদের সাথে সরকারি দলগুলোর আঁতাঁত বহু দিনের৷ বরাবর এরা এসব দলকে বিপুল টাকা জুগিয়ে আসছে৷ এই টাকার জোগান বন্ধ হয়ে গেলে নির্বাচনী প্রচারের আকাশছোঁয়া খরচের টাকা আসবে কোথা থেকে তাছাড়া অন্যান্য রাজ্যের মতো এ রাজ্যেও ফড়ে–দালালরাই বহু জায়গায় শাসক দলের ছোট–বড় কর্তা৷ এ হেন উপকারী বন্ধুদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের বেআইনি মুনাফালুট চৌপাট করে দেওয়া চলে কি? সেই কারণেই তাদের এই নিষ্ঠুর নীরবতা৷ জনজীবন মূল্যবৃদ্ধির আঁচে পুড়ে যাক, সমস্যায় জর্জরিত হয়ে শেষ হয়ে যাক, বছর বছর ফসলের দাম না পাওয়া আত্মঘাতী চাষির সংখ্যা বাড়তে থাকুক– এসবে সরকারি নেতা–মন্ত্রীদের কিছু যায় আসে না৷
এই অবস্থায় এসইউসিআই(সি)–র দাবি, অবিলম্বে মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকারকে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে৷ ফড়ে–দালাল–মজুতদার রাজ নির্মূল করতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন সহ সমস্ত আইন কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করতে হবে৷ সর্বোপরি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করে চাষিদের কাছ থেকে উপযুক্ত মূল্যে সরকারকেই ফসল কিনতে হবে৷ এই দাবিগুলি আদায়ে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে জনগণকে একজোট হওয়ার আবেদন জানিয়েছে এসইউসিআই (সি) দলের রাজ্য নেতৃত্ব৷