সুন্দরবনের এক প্রান্ত গোসাবার একটি গ্রামের পুরুষদের প্রায় সকলেই রুটি–রুজির সন্ধানে গিয়ে বাঘ–কুমীর–হাঙরের পেটে চলে গিয়েছেন৷ এটা ‘বিধবা গ্রাম’ হিসাবে পরিচিত৷ মাছ–কাঁকড়া ধরে সংসার চালানোর চেষ্টায় এখানকার গরিব–গুর্বো মানুষ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে জলে–জঙ্গলে যান৷ কেউ ফেরেন, বহুজনের মৃতদেহটুকুও ফেরে না৷ সে রকমই সিলিকা খনিতে কাজ করতে গিয়ে তেলেঙ্গানার অসংখ্য পরিবার পুরুষ শূন্য৷
কাজের জন্য সাধারণ মানুষের হাহাকার রাজ্যে রাজ্যে একইরকম৷ তেলেঙ্গানার রঙ্গা রেড্ডি জেলার এলকাট্টা, রঙ্গমপল্লি, চৌওলাপল্লি, কামসানিপল্লি এবং পিরলাগুড়া গ্রাম স্থানীয় মানুষের কাছে ‘বিধবা পল্লি’ হিসাবে পরিচিত৷ এখানকার বেশিরভাগ মহিলা অকালেই তাঁদের স্বামীদের হারিয়েছেন৷ সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে কার্যত বিনা চিকিৎসায় তাঁদের মৃত্যু ঘটেছে৷ এঁদের বেশিরভাগই জনজাতি, উপজাতি, পিছিয়ে পড়া বর্গ বা সংখ্যালঘু অংশের৷
সিলিকোসিস এক ভয়াবহ অসুখ৷ বহুদিন লক্ষণগুলি বোঝা না যাওয়ার কারণে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ও হয় না৷ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাওয়ার আগে এখানকার মানুষ এর প্রতিষেধক হিসেবে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি এক ধরনের চিনির টুকরো ব্যবহার করত৷ স্থানীয় মানুষ একে ‘গুট্টালা বিমারি’ বা ‘পাহাড় থেকে আসা রোগ’ বলে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই রোগের লক্ষণগুলি হল– খর্বাকৃতি হয়ে যাওয়া, কাশি, জ্বর, নীলাভ চামড়া ইত্যাদি৷ সিলিকা ডাস্ট বহুদিন শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে নিতে থাকলে এই সব লক্ষণ দেখা যায়৷ খনিমালিকরা হঠাৎ খনি বন্ধ করে দেয় যখন দেখে শ্রমিকদের প্রায় সকলেই সিলিকোসিসে আক্রান্ত, তাদের দিয়ে কাজ করানো মুশকিল৷ যদিও খনি মালিকদের মুখ্য অথবা রিজিওনাল ইনস্পেক্টরের কাছে বাধ্যতামূলকভাবে খনি বন্ধ করার কারণ এবং কতজন অসুস্থ তার সংখ্যা জানিয়ে নোটিশ দেওয়ার কথা৷ কিন্তু অহরহই তা ভঙ্গ করে মালিকরা৷
মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তিকে ভর করে সিলিকা ডাস্টের মধ্যে সারাদিন কাজ করতে হয় খনি ও পাথর ভাঙার ইউনিটের শ্রমিকদের৷ কোয়ার্টজের স্তূপ থেকে পাথর ভাঙার ইউনিট, সেখানে ১০০০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগেড তাপমাত্রায় ইট পুড়িয়ে ছোট ছোট টুকরোতে ভেঙে তারপর সম্পূর্ণ গুঁড়ো করে তা আয়তক্ষেত্রাকার ছাউনিতে রাখা হয়৷ এই ছাউনি প্রায় যেন একটা মৃত্যুফাঁদ৷ শ্রমিকরা গন্ধহীন সিলিকা গুঁড়ো নিঃশ্বাসের সাথে নিতে থাকে৷ এর ফলে কাশি এবং হাঁপানি শুরু হয়৷ এর পরের পরিণতি সকলেরই প্রায় এক৷ এক হাসপাতাল থেকে আর এক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ছোটাছুটি৷ তারপর বিনা চিকিৎসায় বা পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া৷
যে শ্রমিকরা মালিকের লাভ বাড়াতে নিজেদের জীবন বাজি রাখে, তাদের প্রতি নূ্যনতম দায়িত্ব পালন করে না খনি মালিকরা৷ সরকারও তাদের বাধ্য করার কোনওরকম চেষ্টা করে না৷ কোনও খনির বেশি সংখ্যক শ্রমিক যখন সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয় কিংবা মারা যায়, তখন খনি মালিকরা বলতে থাকে, এই খনি আর লাভের মুখ দেখতে পারছে না৷ এই অজুহাত দিয়ে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়৷ এমনকি খনি বন্ধ করেও দেওয়া হয়৷ কারণ এতে মালিকের লাভ৷ ক্লোজার হলে ন্যায্যত যে পাওনাগুলি শ্রমিকদের পাওয়ার কথা, তা না দিয়ে সামান্য কিছু হাতে ধরিয়ে দিলেই হল৷ ক্ষতিপূরণও দিতে হয় না৷ ১৯৪৭–এর ইনডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউটস অ্যাক্ট এবং ১৯৬১–র খনি আইনকে দু’পায়ে মাড়িয়ে খনি মালিকরা শ্রমিকদের ঠকাচ্ছে৷ সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই৷ তারা এই মালিকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সরকার পুঁজিপতিদেরই স্বার্থরক্ষার প্রতিষ্ঠান৷
চিকিৎসকরা অনেক সময় সঠিকভাবে সিলিকোসিসের কারণ নির্ণয় না করতে পেরে অথবা কখনও কর্তৃপক্ষের চাপের মুখে পড়ে সিলিকোসিসে শ্রমিক মৃত্যুর কথা রিপোর্টে সরাসরি লেখেন না৷ ফলে এই রোগে মৃত্যুতে যে ক্ষতিপূরণ মৃতদের পরিবারের পাওয়ার কথা, তাও তারা পান না৷ ডিরেক্টরেট জেনারেল অব মাইন সেফটি, ডিরেক্টরেট অব ফ্যাক্টরিজ, ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন, বিধানসভা, সংসদ, হাইকোর্ট সহ নানা সরকারি দপ্তর এবং খনি কর্তৃপক্ষের দপ্তরে বারবার দরবার করেও পরিবারের সদস্যরা এক পয়সা ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না৷
খনি শ্রমিকদের পরিবারগুলি ধ্বংসের মুখে৷ খনি মালিকদের শোষণ–বঞ্চনা, চূড়ান্ত অবহেলা এবং সরকারের দায়িত্বহীনতায় বিপন্ন হাজার হাজার মানুষ৷