নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর (১৭) — মাইকেল ও বিদ্যাসাগর

নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর

ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এই মহান মানবতাবাদীর জীবন ও সংগ্রাম পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে৷

(১৭)

মাইকেল ও বিদ্যাসাগর

ছাত্রাবস্থা থেকেই দরিদ্র অসহায় নিপীড়িত মানুষের প্রতি বিদ্যাসাগরের অকৃত্রিম দরদবোধের পরিচয় পাওয়া যায়৷ স্কুলে পড়ার সময়ে, যখন নিজে বাড়িতে চরকা–কাটা মোটা সুতোর তৈরি পোষাক পরতেন তখন, নিজের বৃত্তির টাকায় গরিব সহপাঠীদের জন্য ভাল পোষাক কিনে দিতেন৷ নিজে যখন দু’বেলা পেট ভরে খেতে পেতেন না তখনও ওই বৃত্তির টাকায় ক্ষুধার্ত সহপাঠীদের জন্য ভাল টিফিনের ব্যবস্থা করতেন৷ সহপাঠীরা অসুস্থ হলে তাদের চিকিৎসা–পথ্য এবং প্রয়োজনে তাদের সেবা–শুশ্রুষার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতেন৷ ছোটবেলা থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি যে কত শত রোগীর সেবা করেছেন তার হিসাব নেই৷ এক দুরন্ত বালক এইভাবে ছোট থেকেই সহূদয় ও সেবাপরায়ণ যুবকে এবং ক্রমে এক মানবতাবাদী আদর্শের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন৷ ঘটনাক্রমে শেষজীবনে বিদ্যাসাগরের ঋণের পরিমাণ হয়েছিল বিপুল৷ এই বিপুল ঋণের একটি পয়সাও তাঁর নিজের প্রয়োজনে ছিল না৷ অন্যকে সাহায্য করতে গিয়েই তিনি ধার করেছিলেন৷ কিন্তু ঋণের বোঝা মাথায় থাকেলেও, আর্থিক সাহায্য করা দরকার এমন, কাউকে কখনও তিনি বিমুখ করেননি৷ এরই সূত্রে বেরিয়ে আসে বিদ্যাসাগরের অতুলনীয় এবং অবিস্মরণীয় চরিত্রের আরও নানা দিক৷

একথা প্রায় সকলেই জানেন যে, বাংলা কাব্য–সাহিত্যের অমিত্রাক্ষর ছন্দের স্রষ্টা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদেশে গিয়ে যখন অর্থকষ্টে চরম বিপদে পড়েছিলেন তখন একমাত্র বিদ্যাসাগরই গভীর মমতায় তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন৷ মাইকেল ছিলেন অসাধারণ কাব্য–প্রতিভার অধিকারী৷ তাঁর প্রতিভার বিশিষ্টতাকে সেসময় যথার্থভাবে বুঝেছিলেন বিদ্যাসাগর৷ বাস্তবে, মাইকেল নিছক প্রতিভাবান কবি ছিলেন না, অদৃষ্ট–নির্ভরতা ছেড়ে ব্যক্তিকে আপন বলে বলীয়ান হয়ে ওঠার পক্ষে এবং নারীর উপর সামন্ততান্ত্রিক অকথ্য নিপীড়নের বিরুদ্ধে নবজাগরণের যে চিন্তা, কাব্যে তাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন মাইকেল৷ এই মাইকেলকে বিদ্যাসাগর চিনেছিলেন৷ তাই মূল্যবান প্রতিভা হিসাবে তাঁকে যেকোনও বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য বিদ্যাসাগর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন এবং সেটা যে–ভাবে করেছিলেন তাও অত্যন্ত বিরল এবং স্মরণযোগ্য৷

দু’জনে ছিলেন প্রায় দু’জগতের মানুষ৷ কিন্তু দু’জনেই দু’জনের সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল হয়ে উঠেছিলেন৷ প্রথম দিকে মাইকেলের অমিত্রাক্ষর ছন্দ বিদ্যাসাগরের বিশেষ পছন্দ হয়নি৷ কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর ধারণায় পরিবর্তন আসে এবং এই ছন্দের বিশেষ তাৎপর্য তিনি অনুধাবন করেন৷ এতে মাইকেল অত্যন্ত খুশি এবং আশ্বস্ত হয়েছিলেন৷ ১৮৬২ সালে এক বন্ধুকে চিঠিতে তিনি লেখেন “You will be pleased to hear that the great Vidyasagar is almost a convert to the new poetical creed and is beginning to treat the ‘apostle’ who has propagated it with great attention, kindness, and almost affection!” এবং ওই বছরই প্রকাশিত তাঁর ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যটি বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করেন৷ সেই উৎসর্গপত্রে রয়েছে বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর সুগভীর শ্রদ্ধার পরিচয়৷ এক বন্ধুকে চিঠিতে তিনি লেখেন”I have dedicated the work to our good friend the Vidyasagar. He is a splendid fellow! I assure you. I look upon him in many respects as the first man among us. …His admiration is honest, for he is above flattering any man”

ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য পরিবারকে রেখে ইংল্যান্ডে গিয়ে মাইকেল অর্থকষ্টের সম্মুখীন হন৷ যাবার আগে তিনি তাঁর সম্পত্তির বিনিময়ে যে টাকা পয়সা পাওয়ার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন, কিছুদিন পর তা আর পাননি৷ বহু চেষ্টা করেও দেশের পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে কোনও সাহায্য তিনি পেলেন না৷ ১৮৬৩ সালে তাঁর পরিবার কোনওক্রমে ইংল্যান্ডে পৌঁছয়৷ মাইকেল তখন কার্যত অথৈ জলে পড়ে যান৷ পাই–পয়সা বাঁচাবার জন্য তিনি ইংল্যান্ড ছেড়ে ফ্রান্সে গিয়ে উঠলেন৷ কিন্তু সেখানে খরচ–খরচা কিছুটা কম হলেও টাকার তো প্রয়োজন৷ বারবার চিঠি লিখছেন দেশে অথচ কেউ কোনও সাড়া দিচ্ছে না৷ অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, অবিলম্বে তাঁকে দেনার দায়ে ফরাসি সরকারের জেলে যেতে হবে এবং সে অবস্থায় পরিবারকে আশ্রয় নিতে হবে কোনও অনাথাশ্রমে৷ এই চরম সংকটে অবশেষে মাইকেল স্মরণ করলেন বিদ্যাসাগরকে৷ চিঠি লিখলেন তাঁকে৷ তারপর শুরু হল উত্তরের জন্য প্রতীক্ষা৷ তারই মধ্যে একদিন স্ত্রী এসে দাঁড়ালেন মাইকেলের পাশে৷ চোখ তাঁর ভেজা৷ মাইকেলকে বললেন, ‘ছেলেমেয়েরা মেলায় যেতে চায়, কিন্তু আমার হাতে আছে মাত্র ৩ ফ্রাঁ (ফরাসি মুদ্রা)৷ ভারতবর্ষের এই লোকগুলো আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার কেন করছেন বলো?’ মাইকেল তখন আশ্চর্য প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছেন, ‘আজকে ডাক আসার দিন৷ আমি বলছি আজকে একটা খবর পাবই৷ কারণ, এবার আমি যাঁর কাছে আবেদন জানিয়েছি তাঁর ব্যক্তিত্বে আছে প্রাচীন ঋষির জ্ঞান ও প্রতিভা, ইংরেজের কর্মশক্তি আর বাঙালি মায়ের কোমলতা৷’ এই কথপোকথনের কিছুক্ষণ পর সত্যিই ডাক এল৷ ১৫০০ টাকা মাইকেলকে পাঠিয়েছেন বিদ্যাসাগর৷

এরপর টাকার প্রয়োজনে মাইকেল দেশে তাঁর সম্পত্তি বন্ধক রাখার কথা ভাবলেন৷ বিদ্যাসাগর চিঠি লিখে তাঁকে সম্পত্তি বন্ধক রাখতে নিষেধ করলেন এবং আরও ২,৪৯০ ফ্রাঁ পাঠিয়ে দিলেন৷ কিন্তু এই টাকা জোগাড় করতে গিয়ে বিদ্যাসাগরকে বড় রকমের ঝুঁকি নিতে হয়েছিল৷ এরপরে বিদ্যাসাগরকে লেখা চিঠিতে দেখা যাচ্ছে, মাইকেল আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে অবিলম্বে যদি তিনি অন্তত ৩০০০ টাকা বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে না পান তাহলে ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে ব্যারিস্টারি পরীক্ষার লেখাপড়া শুরু করতে পারবেন না৷ এর কয়েকদিনের মধ্যে মাইকেল আরও একটি চিঠি লেখেন বিদ্যাসাগরকে এবং এই চিঠিতে তিনি ৮০০০ টাকা অত্যন্ত উদগ্রীব ভাষায় চেয়ে পাঠান৷ সম্ভবত, এই সময়েই বিদ্যাসাগর ৮০০০ টাকা ধার করেছিলেন নিজের দায়িত্বে৷ মাইকেল ইংল্যান্ডে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়ছেন৷ মাইকেল যে বিদেশে থাকার বাকি সময়টা নিয়মিতভাবে বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে টাকা পেয়েছেন তাঁর পরবর্তী চিঠিগুলিতে তার উল্লেখ আছে৷ এভাবে মাইকেল যখনই তাঁর সাহায্য চেয়েছেন, বিদ্যাসাগর ততবার এগিয়ে এসেছেন, কোনওবার তাঁকে বিমুখ করেননি৷

ব্যারিস্টারি পাস করার পর মাইকেলের অনুরোধে বিদ্যাসাগর তাঁর জন্য কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটে একটি ভাল বাড়ি ভাড়া করে, তাঁর উপযুক্তভাবে সাজিয়ে রেখেছিলেন৷ কিন্তু মাইকেল গিয়ে উঠলেন এক দামী হোটেলে৷ মাস দুয়েক পর হাইকোর্টে কাজে নিযুক্ত হওয়ার ব্যাপারে মাইকেল ফের বিপদে পড়লেন৷ হাইকোর্ট তাঁর character and good repute সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য সুপারিশ–পত্র পাঠাতে নির্দেশ দিল৷ তখন তিনি আবার সেই বিদ্যাসাগরকেই স্মরণ করলেন৷ বিদ্যাসাগর তখন কলকাতায় ছিলেন না৷ মাইকেল লিখলেন, বিদ্যাসাগর যেন হয় দ্রুত কলকাতায় চলে আসেন অথবা তাঁকে একটি প্রশংসাপত্র পাঠিয়ে দেন৷ মাত্র দু’মাস আগে মাইকেলের আচরণে বিদ্যাসাগর যে আহত বা রুষ্ট হয়েছিলেন তার কোনও ছাপ তাঁর ব্যবহারে প্রকাশ পেল না৷ দ্রুত সমস্ত ব্যবস্থা করে এক উপযুক্ত প্রশংসাপত্র তিনি মাইকেলকে পাঠিয়ে দিলেন৷ এটা পেয়েই মাইকেল হাইকোর্টে কাজ শুরু করতে পেরেছিলেন৷

এরপরও বারবার বিপদে একমাত্র বিদ্যাসাগরকেই মাইকেল স্মরণ করেছেন৷ বিদ্যাসাগর প্রত্যেকবার তাঁকে সাহায্য করেছেন৷ ১৮৬৬ সালের ডিসেম্বর মাসে এক দুর্ঘটনার ফলে বিদ্যাসাগর যকৃতে গুরুতর আঘাত পান৷ তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে৷ মাইকেলের জন্য নিজ দায়িত্বে যে টাকা তিনি ধার করেছিলেন, মাইকেল দেশে ফিরে তা শোধ দেবেন, এমনই কথা ছিল৷ কিন্তু কোনও টাকা মাইকেল ফেরৎ দিতে পারলেন না৷ বিদ্যাসাগর তাঁকে চিঠি লিখে টাকা ফেরতের ব্যাপারে জানালেন৷ সে চিঠি পেয়ে মাইকেল বিচলিত হয়ে উত্তরও দিলেন কিন্তু টাকা দিতে পারলেন না৷ তখন বিদ্যাসাগর ঋণ শোধ করার জন্য তাঁর প্রিয় সংস্কৃত প্রেসের দুই–তৃতীয়াংশ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলেন৷ এরপর মাইকেল আবার বিদ্যাসাগরকে লিখছেন, তিনি যেন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে আদালতে বিচারপতি পদের জন্য তাঁর নাম সুপারিশ করেন৷ ‘‘আমি জানি আপনি ব্রহ্মণ হলেও দুর্বাসার বংশধর নন৷ আমি যত অন্যায় করি না কেন, আপনার হৃদয়ের স্পর্শলাভে আমি বঞ্চিত হব না৷ যদিও ঘটনাচক্রে সেসময় বিচারপতির প্রয়োজন না থাকার কারণে সে চাকরি তাঁর হয়নি৷ ১৮৭০ সালে ব্যারিস্টারি ছেড়ে দিয়ে হাইকোর্টে প্রিভি–কাউন্সিল আপীলের অনুবাদ বিভাগে পরীক্ষকের পদে যোগ দেন মাইকেল৷ এখানে তাঁর মাসিক আয় ছিল প্রায় দেড় হাজার টাকা৷ কিন্তু তাতে তাঁর জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসেনি৷ বরং প্রচুর খরচের কারণে আরও ধারদেনায় ডুবতে থাকলেন তিনি এবং ফের বিদ্যাসাগরের শরণাপন্ন হলেন (১৮৭২ সাল)৷ বিদ্যাসাগর এই একবার মাত্র আর তাঁকে টাকা দিতে পারলেন না৷ গভীর দুঃখ পেলেন কিন্তু তিনি নিজেই তখন বিপুল ঋণভারে জর্জরিত৷ বছর খানেক পর মাইকেল মারা গেলেন৷ মৃত্যুর পর তাঁর অস্থিরক্ষা এবং স্মৃতিচিহ্ণ প্রতিষ্ঠার একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়৷ উদ্যোক্তারা যখন বিদ্যাসাগরের কাছে গেলেন, চোখের জল ফেলে বিদ্যাসাগর তাঁদের ফিরিয়ে দিলেন এই বলে যে, ‘প্রাণপণ চেষ্টা করে যার প্রাণ রাখতে পারিনি, তার হাড় রাখার জন্য আমি ব্যস্ত নই৷ (চলবে)

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১৫ সংখ্যা)