মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পদের জন্য গুজরাট হাইকোর্টের সবচেয়ে সিনিয়র বিচারপতি আকিল আব্দুল হামিদ কুরেশির নাম কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম৷ প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ–এর পাঠানো এই নাম (১০ মে, ২০১৯) বিজেপি সরকার অগ্রাহ্য করে মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের বিচারপতি রবিশঙ্কর ঝাকে অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ করেছে৷
সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতি কে হবেন, সেটা ঠিক করার অধিকার কলেজিয়ামেরই৷ তাহলে কলেজিয়ামের সুপারিশ অনুযায়ী বিচারপতি হামিদ কুরেশিকে কেন প্রধান বিচারপতি করা হল না? সরকার এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি৷ তবে কারণটা অনুমান করা শক্ত নয়৷ কারণ বিচারপতি হামিদ কুরেশি দু’টি মামলায়, নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গুজরাট সরকার ও অমিত শাহর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন৷ সোহরাবুদ্দিন ভুয়ো সংঘর্ষ মামলায় অমিত শাহকে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠিয়েছিলেন এবং গুজরাট লোকায়ত নিয়োগ মামলায় সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন (তথ্যসূত্র : দ্য স্টেটসম্যান, ১ জুন, ২০১৯)৷ বিচারপতি হামিদ কুরেশি সরকারের অনুগত হননি৷ ন্যায়বিচারের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন৷ যোগ্যতার মানের নিরিখে সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম যাঁকে প্রধান বিচারপতি পদে নির্বাচিত করেছে সরকার নিয়ম নীতির বাইরে গিয়ে তা অগ্রাহ্য করছে বারবার৷ ভোটে নির্বাচিত সরকার যখন ক্ষমতার জোরে বেপরোয়া হয়ে নিয়ম ভাঙে তখন সংসদীয় গণতন্ত্রে আইনের বড় দুর্দিন নেমে আসে৷ আবারও তার প্রমাণ পাওয়া গেল ২০১৯–এর এপ্রিল মাসে৷
আইনজীবী উৎসব সিং বাইন এক হলফনামায় সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে ‘গ্যাং অফ ফিকসার্স’–এর কথা উল্লেখ করেছিলেন৷ অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে মামলার শুনানির দিন ও বিশেষ বেঞ্চ ঠিক হচ্ছে৷ এই হলফনামার শুনানির সময় বিচারপতি অরুণ মিত্র, বিচারপতি আর এফ নরিম্যান এবং বিচারপতি দীপক গুপ্তা বলেন, ‘শত শত কোটি টাকার বিনিময়ে মামলার শুনানির দিন ঠিক হচ্ছে’৷ আজ বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের রাজনীতিতে যেমন মূল্যবোধ–ন্যায়নীতির কোনও বালাই নেই, তেমনি তার ন্যায়ালয়েও মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয়৷ অবস্থা এমন রূপ নিয়েছে যে বিচারপতিরাও বলতে বাধ্য হচ্ছেন, টাকাই সব৷ টাকা দিয়ে বিচারও কেনা যায়৷ টাকার বিনিময়ে যেমন মালিকের পণ্য বাজারে বিক্রি হয়, মুনাফা ঘরে ওঠে তেমন আজ বিচারও টাকার জোরে কিনে নিতে পারে ধনীরা৷ বুর্জোয়ারা তাদের ‘মহান’ ন্যায়বিচার নিয়ে যে মোহ সমাজমননে তৈরি করেছিল, এই হলফনামার শুনানির সময় তার মুখোশ যেন খসে পড়ল৷ খোদ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা প্রশ্ন করেন, ‘এ দেশের ধনী এবং ক্ষমতাবানরা কী মনে করেন, তাঁরা আড়াল থেকে সুপ্রিম কোর্টকে (রিমোট কন্ট্রোল) নিয়ন্ত্রণ করবেন? বলেন, ‘আমরা এখন প্রতিদিনই বেঞ্চ ফিক্সিং–এর কথা শুনছি৷’
বিস্ময়কর যে, শীর্ষ আদালতের বেঞ্চের এই ভয়ঙ্কর মন্তব্যের পরেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যিনি ভারত সরকারকে ‘স্বচ্ছ’ এবং ‘দুর্নীতি মুক্ত’ বলে দাবি করেন, তিনি সম্পূর্ণ নীরব থাকলেন যেন সুপ্রিম কোর্টে কিছুই হয়নি, কোনও ঝড় ওঠেনি আইনমন্ত্রকও প্রধানমন্ত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে মূক–বধির সেজেছে৷
আইনজীবী বাইন–এর হলফনামার শুনানির দিন কোর্ট দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তের জন্য অবসপ্রাপ্ত বিচারপতি এ কে পট্টনায়ককে দিয়ে ওয়ান ম্যান তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল৷ এখন বলা হচ্ছে, কিছু পুলিশ অফিসার, সুপ্রিম কোর্টের ‘বেঞ্চ ফিক্সিং’ এবং কোর্ট অর্ডার বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি হচ্ছে তা রুখতে নিচুতলার কর্মীদের প্রতি নজর রাখবে৷ (তথ্যসূত্র : দ্য স্টেটসম্যান, ৮ জুলাই, ২০১৯)
শুধুমাত্র নিচুতলার কর্মীরাই নাকি কোর্ট অর্ডার পাল্টে দিয়ে শিল্পপতি অনিল আম্বানিকে বাঁচিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল তাই সুপ্রিম কোর্টের দু’জন স্টাফকে বরখাস্ত করেছে কোর্ট৷ এ এক বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত৷ এত বড় দুর্নীতির সাথে প্রশাসনের এবং ক্ষমতাবান রাজনীতিকদের কেউ যুক্ত নেই, অনিল আম্বানির কোনও দায় নেই– এ কথা কী বিশ্বাসযোগ্য? বুর্জোয়া বিচারের ভাষায় এরই নাম হল ন্যাচারাল জাস্টিস
গণতন্ত্র, ন্যায়বিচারের মিষ্টি কথার আড়ালে নিচুতলার কর্মচারী, শোষিত জনসাধারণ বেশিরভাগ সময় ন্যায়বিচারে বঞ্চিত হয়, অবিচারের শিকার হয়৷ তাই দেখা যায় জেল–হাজতে যারা পাঁচ বা দশ বছর বিনা বিচারে পড়ে আছে, যাদের ফাঁসির সাজা হয়েছে, তাদের মধ্যে সমাজের উঁচুতলার, ক্ষমতাবানদের, অনিল আম্বানিদের কেউ নেই৷ যেন তারা আইন ভাঙে না, জঘন্য অপরাধ করে না এটাই হল সংসদীয় গণতন্ত্রের মুখ৷ বাকিটা মুখোশ৷ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে আছে পুঁজিপতি শ্রেণি, উৎপাদনের শক্তি শ্রমিক–চাষি আছে রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে৷ স্বাভাবিক কারণে তারা ন্যায়বিচারেরও বাইরে৷ ‘আইন আইনের পথে চলবে’ কথাটি যে আজকের এই পুঁজিবাদী সমাজে একটা কথার কথা, তা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও সামনে এল৷ আইন আজ অর্থশক্তির বশীভূত, বশীভূত রাষ্ট্রশক্তির কাছেও৷ যত দিন যাচ্ছে ফ্যাসিবাদী এই প্রবণতা বেড়ে চলেছে৷