বিশ্ববিদ্যালয়ে কী পড়ানো হবে তা ঠিক করার দায়িত্ব কার? সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের, নির্দিষ্ট করে বললে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলেরই নয় কি? সারা সভ্য দুনিয়ার রীতি এটাই৷ কোনও দেশে গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকলে এর অন্যথা কোনও মতেই হতে পারে না৷
কিন্তু দেখা গেল ভারতে বিজেপি জমানা অন্য কথা বলে৷ এখানে বিজেপি–আরএসএস এবং তাদের অনুগামীরাই শেষ কথা৷ তাই ১৬ জুলাই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকদের উপর তাণ্ডব চালাল আরএসএস এবং বিজেপির ছাত্র সংগঠন এবিভিপি৷ উপাচার্যের ঘরে সিলেবাস সংক্রান্ত বৈঠকে ঢুকে তারা অধ্যাপকদের মারধোরের হুমকি দিয়ে দাবি জানায়, ইংরেজি সাহিত্যের সিলেবাসে গুজরাট দাঙ্গা সংক্রান্ত ছোট গল্পে যে আরএসএস বিরোধী কথা আছে তা কেটে দিতে হবে৷ সাহিত্যের সিলেবাসে জাতপাতের বিরুদ্ধে কোনও পাঠ রাখা চলবে না৷ আরও দাবি আধুনিক ইতিহাসের সিলেবাসে বামপন্থী আন্দোলন সংক্রান্ত অধ্যায় বাদ দিতে হবে৷ শিল্প বিপ্লব সংক্রান্ত আলোচনায় মার্কস এঙ্গেলস–এর নাম বাদ দিতে হবে৷ শেষপর্যন্ত উপাচার্য এবং বিজেপি প্রভাবিত কিছু অধ্যাপক অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলকে বলেন, এবিভিপির দাবি অনুসারেই সিলেবাস ঠিক করতে হবে (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১৭ জুলাই)৷ এমনিতে উপাচার্যের ঘরে ছাত্রদের ঢোকা প্রায় অসম্ভব করে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ৷ কিন্তু বিজেপির ছাত্রসংগঠন বলে কথা, কোনও নিয়ম কি খাটতে পারে বিজেপি জমানায় দিল্লির মতো জায়গায় উপাচার্য হওয়ার একটাই যোগ্যতা, আরএসএসের বশংবদ হতেই হবে৷ এভাবেই বিজেপি শিক্ষাকে নিজেদের পকেটে পোরার চেষ্টা করছে৷ শিক্ষাকে তাদের ‘হিন্দুরাষ্ট্রের’ অ্যাজেন্ডার পথে চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে চিন্তাবিহীন কিছু ভক্ত তৈরির কারখানা বানানোর জন্যই তারা বেছে নিয়েছে ইতিহাস, সাহিত্যের মতো মানববিদ্যার সিলেবাসকে৷ এর আগে বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চে এমনই ‘ভক্ত’দের পাঠিয়ে তারা বৈদিক রকেট চালিয়েছে, স্টেম সেল থেরাপি মহাভারতের আবিষ্কার ইত্যাদি সব হাস্যকর কল্পনার ঝুড়ি উপুড় করে ভারতকে সারা বিশ্বের কাছে উপহাস্যাস্পদ করে তুলেছে৷
ঠিক এই লাইনেই হেঁটে সম্প্রতি মহারাষ্ট্রের নাগপুরে ‘রাষ্ট্রসন্ত তুকাদোজি মহারাজ নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ (আরটিএমএনইউ) ইতিহাস অনার্সের সিলেবাসে ‘জাতি গঠনে আরএসএসের ভূমিকা’ নিয়ে একটি অধ্যায় ঢোকাতে চায়৷ কোন জাতি? আরএসএস তো ভারতীয় জাতি গঠনের ধারাটাকেই অস্বীকার করে আমাদের এই দেশে বিশাল এক ভৌগোলিক ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মানুষ ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে অর্থনৈতিক আদানপ্রদান, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত নৈকট্য ইত্যাদির পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জাতীয়তার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল৷ তার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে ভারতীয় জাতি৷ কিন্তু আরএসএসের আরাধ্য সাভারকর বলেছেন, যে ধর্মীয় গোষ্ঠীর অধ্যাত্মিক চেতনার কেন্দ্র যেখানে অবস্থিত তারা সেই দেশের জাতির অংশ৷ অর্থাৎ মুসলিম, খ্রিস্টান, পারসি ইত্যাদি ধর্মের উৎস যেহেতু অন্য কোনও দেশ, তাই এই সমস্ত ধর্মাবলম্বীরা ভারতীয় নন৷ অথচ জাতি গঠনের বৈজ্ঞানিক ধারণা বলছে, ধর্ম জাতি গঠনের নির্ণয়ক শক্তি কোথাও হয়নি৷ রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ভারতীয় নবজাগরণের সমস্ত মনীষী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীরা বলেছেন, ধর্ম–বর্ণ–জাতপাত নির্বিশেষে এই ভারতীয় জাতি গঠনের কাজে অবদান আছে সকলের৷ এমনকী হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রবক্তা বিবেকানন্দ পর্যন্ত বলেছেন, মুসলমানরা বিদেশি এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল৷ তাহলে আরএসএসের পক্ষ থেকে কোন জাতির কথা বলা হচ্ছে? প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার দেখিয়েছেন, আরএসএসের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার ধারণার পথেই বিশ্ব হিন্দু মহাসভা ব্রিটিশের হাতে ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করার অস্ত্র তুলে দেয়৷ এই রাস্তাতেই শক্তি পায় মুসলিম লিগের পাকিস্তান গঠনের দাবি৷ তিনি বলেছেন, ‘‘মুসলিম লিগ সাভারকরের ওই বক্তব্যকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে হৃদয়ঙ্গম করেছিল৷’’(স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম) এই নাকি জাতীয়তার ধারণা জাতীয়তাবাদের নামে আরএসএসের হাত ধরে কোন ভারতকে চিনবে এ দেশের ছাত্ররা? সে ভারত রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষচন্দ্রের স্বপ্ণের ধর্মীয় হানাহানি মুক্ত, জাতপাতের অভিশাপমুক্ত আধুনিক ভারত নয়, সে ভারত হবে আরএসএস–বিজেপির ধর্মীয় বিদ্বেষের ঘাঁটি
কেমন জাতীয়তাবাদী আরএসএস? তাদের গুরু গোলওয়ালকর সাহেব তাঁর বই ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ বইতে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলেছেন৷ ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলিতে তাদের আর এক নেতা বিডি সাভারকর সমস্ত রাজকর্মচারীর কাছে আবেদন করেছিলেন, সরকারের প্রতি অনুগত থাকার৷ একাধিকবার ব্রিটিশের স্বরাষ্ট্র দপ্তর তাদের নোটে জানিয়েছে, সংঘ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেয়নি বরং অনুগত থেকেছে৷ ১৯৩৯ সালে ভিডি সাভারকর গোপনে ভাইসরয়কে জানান যে, ‘‘ব্রিটিশ ও হিন্দুদের পরস্পর বন্ধু হওয়া উচিত৷’’এই যাদের ইতিহাস, তারা আজ মহান জাতীয়তাবাদী বনে যাবে শুধু গায়ের জোরে? আরএসএস এদেশে আধুনিক সংবিধানের বদলে ‘মনুস্মৃতি’–র আইন চালু করার দাবি করে৷ তাদের ভাষায় বর্ণাশ্রম প্রথা অর্থাৎ শূদ্রদের ব্রাহ্মণ–বৈশ্য ইত্যাদিদের পায়ের নিচে রাখার প্রথাটাই বৈজ্ঞানিক৷ তাদের আদর্শ অনুসারে মেয়েদের যথার্থ স্থান রান্নাঘর, তাদের কর্তব্য হল পুরুষের সেবা আর পুত্র সন্তানের জন্ম দেওয়া৷ এই নীতি মেনে চলতে হবে আজকের ভারতকে? আরএসএস ত্রিবর্ণ জাতীয় পতাকার বদলে তাদের গেরুয়া ঝান্ডাকেই ভারতীয় পতাকা বলে প্রচার করে৷ সে কথাও তাহলে মেনে নিতে হবে তো? যে সমস্ত শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এই অপচেষ্টার প্রতিবাদ করেছেন তাঁদের বেশ কয়েকজনের প্রাণ গেছে এই স্বঘোষিত হিন্দুত্বের ঠিকাদার বাহিনীর হাতে৷ তবে আশার কথা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তাও থামেনি৷ বহু বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ প্রতিবাদে সামিল হচ্ছেন৷ যার একেবারে সাম্প্রতিক সংযোজন নাট্যকার এস রঘুনন্দনের সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান৷ তিনি সাহিত্য অ্যাকাডেমিকে চিঠি লিখে বলেছেন দেশে যে যুক্তি–বিজ্ঞান–মুক্তচিন্তা ধ্বংসকারী এবং শ্বাসরোধকারী পরিবেশ চলছে এর মধ্যে পুরস্কৃত হতে তাঁর অন্তরাত্মা সায় না৷
প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ১৭ জুলাই বিবৃতিতে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত করেছেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অশোক মিশ্র৷ ১৯ জুলাইয়ে অপর একটি বিবৃতিতে নাগপুরের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনারও প্রতিবাদ করেছেন তিনি৷ এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে এআইডিএসও৷