জনস্বার্থে টাকার অভাব, মন্ত্রী–বিধায়কদের বেতন–ভাতা বেড়েই চলেছে

একবার বিধায়ক–সাংসদ হতে পারলে সারাজীবন মিলবে বেতন, ভাতা, পেনশন সহ আরামে দিন কাটানোর যাবতীয় সুবিধা৷ শুধু নিজে নন, পরিবার পরিজনও তা ভোগ করবেন৷ অথচ যাদের ভোটে বিধায়ক বা সাংসদ হলেন, তাদের ঘরে উনুন জ্বলে কি না, খাবার জোটে কি না খোঁজ রাখেন না এই জনপ্রতিনিধিরা৷ তাই বিধানসভায় বা সংসদে জনজীবনের মৌলিক সমস্যাগুলো নিয়ে সোচ্চার হতে, বিতর্ক করতে এই জনপ্রতিনিধিদের দেখা যায় না৷ বহু জনবিরোধী  বিল বিনা বিতর্কেই পাশ হয়ে যায় কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে৷ জনপ্রতিনিধিরা বেশি সক্রিয় থাকেন নিজেদের বেতন–ভাতা বাড়াতে৷ সম্প্রতি রাজ্য বিধানসভায় সেটাই দেখা গেল৷

ক’দিন আগে রাজ্য বিধানসভায় মন্ত্রী–বিধায়কদের ভাতা বৃদ্ধির ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ ১১ জুলাই এ সংক্রান্ত বিলও বিধানসভায় পাশ হয়ে গেল৷ এতে শাসক বা বিরোধী কোনও দলের বিধায়ককেই তিলমাত্র বিরোধিতা করতে দেখা গেল না৷ সবাই একজোট৷ মুখ্যমন্ত্রী মন্ত্রী–বিধায়কদের মাসিক ভাতা বাড়িয়ে যথাক্রমে এক লক্ষ বত্রিশ হাজার ও এক লক্ষ ষোল হাজার টাকা করার ঘোষণা করলেন৷

রাজস্ব নেই এই অজুহাতে সমস্ত উন্নয়নমূলক প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দে টানাটানি, তখন মুখ্যমন্ত্রী সরকারি কোষাগার থেকে বিধায়কদের ভাতার জন্য বছরে বাড়তি ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করে দিলেন অনায়াসে৷ মন্ত্রী–বিধায়করা কি খুব ‘গরিব’, তাদের সংসার চলে না? তাছাড়া রাজনীতি করে সংসার চালাবেন ভেবে কি তাঁরা রাজনীতিতে এসেছিলেন? রাজনীতি তা হলে কার জন্যে? নিজের জন্যে, নাকি দেশের কোটি কোটি সাধারণ দরিদ্র নিরন্ন মানুষ, তাদের জন্য? মন্ত্রী বলে, বিধায়ক–সাংসদ বলে, নিজেদের হাতে ক্ষমতা আছে বলে আজ তাঁরা নিজেদের ভাতা–বেতন বাড়িয়ে নিলেন, আর দেশের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ, নিরন্ন মানুষ, বেকারি–মূল্যবৃদ্ধি যাদের প্রতিদিনের মুখের গ্রাসটুকুও কেড়ে নিচ্ছে, তাদের দুরবস্থা দূর হবে কী করে?

দেশের মানুষকে আজ তাদের জবাব দিতে হবে, রাজনীতিকে তাঁরা কী হিসাবে দেখেন– দেশসেবা না আখের গোছানোর উপায়৷ যদি রাজনীতি মানে দেশসেবা হয়, তবে কোনও মানুষকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফেলে রেখে নিজেদের স্বার্থ গুছিয়ে নেওয়ার মধ্যে কোথায় দেশ? কোথায় দেশের মানুষ? সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘দেশসেবা কথার কথা নয়, দেশ আর দেশসেবক এর মাঝে আর কিছু থাকবে না৷ ….’’ এই সব মন্ত্রী–বিধায়করা বলবেন, এ ধারণা পরাধীন ভারতের, এখন দেশ স্বাধীন৷ কিন্তু স্বাধীন দেশে কি মানুষের দারিদ্র ঘুচে গেছে, শিক্ষা–স্বাস্থ্যের দাবি মিটেছে? মহিলারা মর্যাদার সাথে বাঁচতে পারছে? মানুষের বেঁচে থাকার মতো কাজ জুটছে?

সকলেই জানেন, এগুলির কোনওটিই মেটেনি৷ তাহলে স্বাধীন ভারতেও রাজনীতির উদ্দেশ্য হওয়া উচিত তো মানুষের উপরোক্ত দাবিগুলি মেটানোর দাবিতে লড়াই করা৷ যে রাজনীতিকরা ক্ষমতায় গিয়ে আগে নিজেদের মাইনে বাড়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাঁরা কী করে মানুষের দাবিতে লড়াই করবেন? এই জন্যই, দশকের পর দশক চলে গেলেও দেশের মানুষের নূ্যনতম দাবিগুলি আজও মিটল না৷ এইজন্যই প্রতি পাঁচ বছরে এমএলএ–এমপি–মন্ত্রী সম্পদের পরিমাণ লাফিয়ে বেড়ে যায়৷ আর সাধারণ মানুষের অবস্থা খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়৷ রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্যটাকেই এঁরা আজ গুলিয়ে দিচ্ছেন৷

শাসক দলের বিধায়ক–মন্ত্রীরা শুধু নয়, বিরোধী দল কংগ্রেস–সিপিএম–বি বিধায়করাও নানা বাক্যছটার আড়ালে বিধায়কদের এই ভাতাবৃদ্ধিকে দু’হাত তুলে স্বাগত জানিয়েছেন৷ এ ক্ষেত্রে কোনও মতপার্থক্য নেই এই সমস্ত দলগুলির বিধায়ক–মন্ত্রীরা নির্বাচনে জেতার জন্য জনগণের প্রতিনিধি বলে নিজেদের দাবি করলেও জিতে যাওয়ার পর আর জনগণের দিকে ফিরেও তাকান না৷ তারা ঠাণ্ডাঘরে ঠাণ্ডা মাথায় দেশের আসল শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে কাজ করতে গিয়ে জনগণের সর্বনাশের নানা কৌশল নিতে থাকেন এবং নানা জনবিরোধী সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেন৷ কারণ, এই ক্ষমতালোভী দলগুলি সবই শোষকের পক্ষে৷ ক্ষমতায় থাকুক বা গদিচ্যুত হোক, এরা শোষক শ্রেণির তথা পুঁজিপতি শ্রেণিরই দল৷ নিজেদের আখের গোছাতে, স্বজনপোষণ করতে তারা ক্ষমতার গদিতে বসেন৷ স্বাভাবিকভাবেই শোষিত গরিব মানুষের জন্য তাদের ছিটেফোঁটা দরদও নেই৷

শোষিত শ্রেণি তথা শ্রমিক শ্রেণির দলের বিধায়করাই একমাত্র জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন৷ তাই তারা ভাতা বৃদ্ধির প্রতিবাদ করেন৷ দাবি করেন, স্বাস্থ্য–শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াক সরকার, বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করুক৷ এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের প্রাক্তন বিধায়ক কমরেড দেবপ্রসাদ সরকার বিধানসভার অভ্যন্তরে বারবার ভাতাবৃদ্ধির বিরোধিতা করেছেন৷ পরবর্তী সময়ে বিধায়ক তরুণ নস্কর ও জয়কৃষ্ণ হালদারও ভাতা বৃদ্ধির বিরোধিতা করেছেন৷ পার্লামেন্টে ৫৪৩ জন সাংসদ যাদের সিংহভাগই কোটি কোটি টাকার মালিক, তাদের কেউ এর বিন্দুমাত্র বিরোধিতা করলেন না৷ একমাত্র এস ইউ সি আই (সি)–র সাংসদ তরুণ মণ্ডল সাংসদদের বেতন ও ভাতা বৃদ্ধির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন৷ তার জন্য এঁদেরকে অন্য সাংসদ–বিধায়কদের অনেক বিদ্রূপ শুনতে হয়েছে৷ সাংসদের অ্যাকাউন্টে বর্ধিত বেতন–ভাতা এসে গেলে সেই বর্ধিত অর্থ সাংসদ তরুণ মণ্ডল নিজ সংসদীয় ক্ষেত্র জয়নগরে জনসাধারণের শিক্ষা–চিকিৎসা খাতেই খরচ করেছেন৷ আজকের যুগে জনপ্রতিনিধির সংজ্ঞা বদলে গেলেও দলের শিক্ষায় শিক্ষিত, শোষিত শ্রেণির চেতনায় উব্ধুদ্ধ এই বিধায়ক–সাংসদরা অর্থলোভ, ক্ষমতার লোভের পরোয়া না করে জনহিতেই নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন৷ আজ সেই প্রতিবাদের কন্ঠ কোথায়?

 নিজেদের আখের গোছানো ওই বিধায়করা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন কি? তাদের নির্বাচিত করার আগে মেহনতি মানুষকে তা ভাবতে হবে বৈকি৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা)