বিহারে শিশুমৃত্যুর মিছিল। দেশজুড়ে তুমুল বিক্ষোভ

মজফফরপুর যেন মৃত্যু উপত্যকা, হেলদোল নেই সরকারের

 

২৪ জুন সারা ভারত প্রতিবাদ দিবসে কলকাতায় রাজভবনের সামনে তুমুল বিক্ষোভ।

আবারও সন্তানহারা মায়ের বুক ভাঙা কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে বিহারের মজফফরপুরের আকাশ–বাতাস৷ অ্যাকিউট এনসেফেলাইটিস সিনড্রোম রোগে আক্রান্ত হয়ে সে রাজ্যে ২০ জুন পর্যন্ত ১৫৬টি শিশুর অকালমৃত্যু ঘটেছে৷ এর মধ্যে শুধু মজফফরপুর জেলাতেই মারা গেছে ১২২ জন৷ যদিও বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন এত শিশুর মৃত্যুর প্রধান কারণ সীমাহীন দারিদ্র এবং তার ফলে অপুষ্টি, রোগ নয়৷ প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যু সংখ্যা৷ মানুষ আতঙ্কিত, কোথায় গিয়ে থামবে এই মৃত্যু মিছিল ইতিমধ্যে রাজ্যের ১৬টি জেলা এই রোগে আক্রান্ত৷ দেড় শতাধিক শিশুর মৃত্যুতেও রাজ্যে ক্ষমতাসীন জেডিইউ–বিজেপি জোট সরকারের বিশেষ হেলদোল আছে বলে বোঝা যাচ্ছে না৷ বস্তুত দেখে মনে হয়, সরকারই যেন রোগাক্রান্ত হয়ে পঙ্গু, অথর্ব হয়ে পড়েছে!

এনসেফেলাইটিসের আক্রমণ বিহারে নতুন নয়৷ গত কয়েক বছর ধরে এই রোগের জেরে বিহারে শিশুমৃত্যু লেগেই রয়েছে৷ এই রোগ প্রতিরোধে সরকার কী ভূমিকা নিয়েছে? ১৫৬টি শিশু প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করল সরকার কিছুই করেনি৷ মজফফরপুরে ১০৩টি হেলথ সেন্টারের ৯৮টিতেই কোনও ডাক্তার নেই, অনেকগুলিতে নার্সও নেই৷ একটি মাত্র কমিউনিটি হেলথ সেন্টার, সেখানেও ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী হাতে গোনা৷ জেলা হাসপাতালে আইসিসিইউ নামে যে ওয়ার্ডটি আছে সেখানে আদৌ কোনও শিশু বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত নেই, বেশিরভাগ সময় অক্সিজেনের সরবরাহটুকুও থাকে না৷ ৪৫ডিগ্রি গরমে ওয়ার্ডগুলিতে সামান্য একটা সিলিং ফ্যানেরও অভাব৷ রোগীর পরিজনদের ওষুধ থেকে শুরু করে অক্সিজেনের সিলিন্ডার সবই কিনে আনতে হচ্ছে৷ জলের অভাব ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে৷ একে নরক ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় কি এর সাথে যুক্ত হয়েছে তোলাবাজি, মৃতদেহের ময়না তদন্তের পর ২৫০০ টাকা করে চাওয়া হচ্ছে৷

কলকাতায় রাজভবনে

প্রশ্ন ওঠে, মজফফরপুর জেলাতেই মৃত্যুর সংখ্যা এত বেশি কেন? এর কারণ ভয়াবহ দারিদ্র৷ দু’বছর আগে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে যত শিশু এনসেফেলাইটিসে মারা গিয়েছিল, সকলেই ছিল অতি দরিদ্র পরিবারের৷ মজফফরপুরেও তাই৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, পুষ্টির নিরিখে মজফফরপুরের অবস্থা আফ্রিকার বহু  দেশের তুলনায় খারাপ৷ এই অঞ্চলে ৬ মাস থেকে ২ বছর বয়সী শিশুদের ৯২ শতাংশের পুষ্টি জোটে না৷ ৪০ শতাংশের বেশি শিশুর ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম৷ ৫৬ শতাংশ শিশু রক্তাল্পতার শিকার৷ মৃত শিশুদের বেশিরভাগই রাতে কিছু না খেয়েই শুতে গিয়েছিল৷ কারণ বাড়িতে এই দুধের শিশুগুলিকে দেওয়ার মতো একটা রুটির টুকরোও তাদের বাবা–মায়ের কাছে ছিল না৷ বিহার সরকারের সোস্যাল অডিটেই দেখা যাচ্ছে এই পরিবারগুলির বেশিরভাগের মাসিক আয় যৎসামান্য৷ কোনও কোনও পরিবারের আয় মাসে মাত্র ৮৫০ টাকা৷ আর অধিকাংশের পারিবারিক আয় মাসে ৪৫০০টাকার মধ্যে৷ ফলে এই দুর্মূল্যের বাজারে শিশুসন্তানকেও দুবেলা পেটপুরে খেতে দিতে অপারগ এইসব দরিদ্র পরিবার (টাইমস অফ ইন্ডিয়া ২৪ জুন, ২০১৯)৷ মজফফরপুরে বিপুল পরিমাণে লিচু চাষ হয়৷ দরিদ্র পরিবারের শিশুরা গাছ থেকে কখনও কাঁচা, কখনও আধপাকা লিচু খেয়ে দিন কাটায়৷ চিকিৎসকদের মতে, লিচুতে এমন একটি রাসায়নিক থাকে যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে দেয়৷ অভুক্ত শিশুদের যকৃতে সঞ্চিত গ্লাইকোজেন প্রায় ছিলই না৷ ফলে লিচুর রাসায়নিকের প্রভাবে তাদের শরীরে এমন একটি বিষাক্ত ‘নিউরোটক্সিন’ তৈরি হয় যা মস্তিস্কের ক্ষতি করে৷ ফলে দৃশ্যত মৃত্যুর কারণ এনসেফেলাইটিস হলেও প্রকৃত কারণ অপুষ্টি, যার দায় সম্পূর্ণ রূপে বর্তায় স্বাধীনতার ৭৫ বছরের উৎসব করতে চলা তথাকথিত প্রজাতান্ত্রিক ভারত রাষ্ট্রের কর্ণধারদের উপরেই৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার শুনতে পাচ্ছেন কি?

কলকাতায় রাজভবনে

কিন্তু এতদসত্ত্বেও এই মৃত্যু কি অনিবার্য ছিল? চিকিৎসকরা বলছেন, একেবারেই নয়৷ রোগের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত শরীরে গ্লুকোজের জোগান দিতে পারলেই বাঁচানো যেত শিশুদের অধিকাংশকে৷ কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে জেলা হাসপাতাল কোথাও গ্লুকোজ,  ওআরএস, স্যালাইনের পর্যাপ্ত জোগান ছিল না৷ এ তথ্য আবার প্রমাণ করে সরকারি নেতা–মন্ত্রী আর আমলাদের অপরাধমূলক ঔদাসীন্যের বলি হয়েছে এতগুলি শিশু৷ এই সব অপরাধীদের শাস্তি হবে না কেন? শিশুহত্যাকারী এই অমানবিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন তাই দেশ জুড়ে ফেটে পড়া দরকার৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা)