ভোটের আগে উত্তরপ্রদেশে গিয়ে সাফাই কর্মীদের পা ধুয়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী৷ সেই ছবি প্রচারও করেছিলেন ব্যাপক ভাবে৷ অথচ তাঁর বড় সাধের গুজরাটে সাফাই কর্মীদের অবস্থা কী? ১৫ জুন ভদোদরায় এক হোটেলে সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করতে গিয়ে ৭ জন সাফাই কর্মীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে৷ কেন এই মৃত্যু? একি নিছক দুর্ঘটনা? বাস্তবে, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে নিদারুণ ভাবে সামনে চলে এসেছে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবন নিয়ে ভোটবাজ নেতাদের চরম উদাসীনতার চিত্র৷
যারা আমাদের বাড়ির চারপাশটাকে সাফসুতরো করে তোলেন, নর্দমা পরিষ্কার করে রোগজীবাণুর হাত থেকে আমাদের রক্ষা করেন, সুস্থ–সুন্দর–পরিষ্কার নাগরিক জীবন গড়ে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন, তাঁদের জীবনে মেলে না কোনও আলো, কোনও স্বচ্ছতা৷ শুধু শিক্ষালোকের অভাব নয়, দারিদ্রের অন্ধকার নয়, মৃত্যুর কালো ছায়া তাদের ঘিরে থাকে সর্বদা৷ তারা অতি বড় দায়িত্ব পালন করেও সমাজের চোখে অতি তুচ্ছ বলেই গণ্য হন৷
তাই, মান্ধাতা আমলের কায়দায় দড়ি–বালতি সম্বল করেই বিষাক্ত গ্যাসপূর্ণ সেপটিক ট্যাঙ্কে নামতে হয়েছিল ভদোদরার সাফাই কর্মীদের৷ ছিল না কোনও গ্যাস মুখোশ৷ একজন দড়ি ধরে নিচে নামার কিছুক্ষণ পর তার কোনও সাড়া না পেয়ে আর একজন নিচে নামেন৷ এভাবে একে একে সহকর্মীদের বাঁচাতে সাত সাতটা প্রাণ চলে যায় বিষাক্ত গ্যাসের কবলে৷
মৃতদের পরিজন ও স্থানীয় মানুষ সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন, বিজেপি সরকারের স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পের কর্মসূচির এই কি নমুনা? বিজেপি তো একথা বলতে পারবে না যে, গুজরাটে বিরোধী দলের সরকার, তারা কাজ করছে না রাজ্যে তারাই দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতাসীন৷ তাহলে পুরসভার নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি করা হয় না কেন? কেন সাফাই কর্মীদের কাজে থাকে না কোনও নিরাপত্তা? আধুনিক নানা প্রযুক্তির আবিষ্কার হলেও তা সাফাই কর্মের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় না কেন? সাফাই–এর মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রকে কেন অবহেলা করা হয়?
বাস্তবে খুবই গরিব ঘরের, সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষ সাফাইয়ের কাজ করেন৷ তাঁদের খুবই কম পারিশ্রমিকে চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করা হয়৷ মালিক বা পৌর কর্তৃপক্ষ তাঁদের শ্রম লুটে নেয়, অথচ কোনও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে না৷ অন্যান্য সুবিধাও পান না তাঁরা৷ শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও ওই ভয়ঙ্কর বিষাক্ত গ্যাসপূর্ণ নালায় ঢুকে তাঁদের পরিষ্কারের কাজ করতে হয়৷ ঘন্টার পর ঘন্টা নোংরা, বিষাক্ত পচা–গলা জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে অমানুষের মতো কাজ করতে বাধ্য হন তাঁরা৷ এঁদের সমস্যা নিয়ে প্রশাসন, সরকার চরম উদাসীন৷ আজ শুধু এক হোটেল মালিকের দিকে আঙুল তুলে দায় এড়াতে পারবে কি বিজেপি? মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণির সরকার এতটাই দায়িত্বহীন যে মৃতদের পরিবারকে কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে চেয়েছে৷
শুধু গুজরাটে নয়, সারা দেশে অসংখ্য সাফাই কর্মী একইভাবে প্রাচীন পদ্ধতিতে কাজ করতে বাধ্য হন৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজের খ্যাতি প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপনে যা খরচ করেন, অন্তত তার একাংশ দিয়ে এঁদের সমস্যা মেটান, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করুন৷ দেশের মানুষ মর্যাদার সাথে সুস্থ পরিবেশে কাজ করতে চায়৷
এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) এবং এ আই ইউ টি ইউ সি–র এক প্রতিনিধিদল গুজরাট রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড তপন দাশগুপ্তের নেতৃত্বে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান৷ তাঁরা মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখতে মৃতদের পরিবারের সাথেও কথা বলেন৷ এরপর তাঁরা রাজ্য মানবাধিকার কমিশন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে একটি রিপোর্ট দেন৷ দল এবং শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীকে নিম্নলিখিত দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি দেওয়া হয় : ১৷ সরকারকে প্রত্যেক মৃত সাফাই কর্মীর পরিবারকে ন্যূনতম ২০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, ২৷ হাইওয়ের হোটেলগুলির লাইসেন্স প্রথা চালু করতে হবে, ৩৷ লাইসেন্স নেওয়া ও পুনর্নবীকরণের সময় হোটেল কর্তৃপক্ষ পাঁচ বছরে সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কারে বরাদ্দ টাকা খরচ করেছে কিনা তা প্রশাসনকে অবশ্যই নজরে রাখতে হবে৷ এর সাথে হোটেল কর্তৃপক্ষকে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা, পরিচ্ছন্নতাজনিত নিরাপত্তার ব্যবস্থা এবং প্রতি বছর তার নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে, ৪৷ সাফাই কর্মীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে নালা–নর্দমা–সেপটি ট্যাঙ্ক সহ যে কোনও রকম সাফাই অভিযানের সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উপস্থিত থাকতে হবে৷ এ ধরনের সাফাই কর্মসূচিতে জেলাশাসক দপ্তরের নজরদারি রাখতে হবে, ৫৷ দমকল কর্মীদের যথাযথভাবে ট্রেনিং দিতে ও উপযুক্ত করে তৈরি করতে হবে, যাতে তারা এই ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে, ৬৷ সাত যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য দায়ী হোটেল মালিক সহ যারা এই ধরনের অপরাধমূলক অবহেলার জন্য অভিযুক্ত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে৷