আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে থাকা আমার বিভিন্ন আত্মীয়, পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে পাওয়া গত দু’মাসের নির্বাচনী পরিস্থিতির সংবাদ ও কলকাতার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বিবরণ থেকে যা সংবাদ পেয়েছি, সেই অভিজ্ঞতার আলোতে এবারের লোকসভার নির্বাচনী ফলাফল আমার সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক বলেই মনে হচ্ছে৷ এবারের নির্বাচনী মহাযুদ্ধ যে সিঁড়িগুলি পেরিয়ে এল সেগুলিকে যদি আমরা মোহমুক্ত দৃষ্টিতে বিচার করি তা হলেই এর সত্যতা প্রমাণিত হবে৷
১) গোটা দেশে কোথাও কোনও ‘মোদি ঝড়’ ছিল না৷ সুসংগঠিত সঙঘবাহিনীর যদিও এই তথাকথিত ‘ঝড়’ সৃষ্টির একটা প্রাণপাত পরিশ্রম ছিল৷
২) বরং শুরুতে ছিল মোদি সরকার–বিরোধী গরম হাওয়া৷ তার ইস্যু তথা বিষয়গুলিও খুবই তিক্ততায় ভরা৷ ক) দেশব্যাপী কৃষকদের ঋণ মকুব না করা, ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়া, দাম না পেয়ে ব্যাপক সংখ্যায় বিভিন্ন প্রদেশে কৃষকদের আত্মহত্যা, খ) গত পাঁচ দশকের মধ্যে সর্বাধিক কর্মহীন বেকারের সংখ্যা, গ) নোটবাতিল জনিত বিভীষিকার গভীর ক্ষত, ঘ) ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র উৎপাদকদের উপর জিএসটি’র মারাত্মক আক্রমণ, ঙ) বিজয় মালিয়া–নীরব মোদি সহ আরও বহু ব্যবসায়ীর ব্যাঙ্ক জালিয়াতি ও দেশত্যাগে সরকারি সহায়তা এবং নির্বাচনের কিছুদিন আগেই রাফায়েল দুর্নীতির প্রকাশ– এইসব নিয়েই শ্রী নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহ সহ বিজেপি এবং সঙঘ পরিবার গোটা দেশেই কোণঠাসা ও নাস্তানাবুদ হয়ে গিয়েছিল৷ আর তখনই কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর ব্যাপক নজরদারির অন্যতম জায়গা পুলওয়ামায় রহস্যজনক ভাবে হতভাগ্য একদল সেনানিধনের ঘটনা ঘটে গেল ও বালাকোটে আঘাত হানা হল, যাকে অত্যন্ত নিপুণতায়, দ্রুততার সাথে ব্যবহার করে উপরোক্ত বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে গোটা দেশে যে মোদি–বিজেপি বিরোধী গরম হাওয়া বইছিল, তাকে চাপা দেওয়া হল এবং তারপরেই মোদিমুখী দখিনা হাওয়া বইতে শুরু করল৷
৩) এখানে অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, মোদি বিরোধী বিভিন্ন বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলি কিন্তু উপরোক্ত ৫টি ইস্যু তথা বিষয় নিয়ে আর প্রচারে না গিয়ে মোদিজীর উত্থাপিত দেশপ্রেমের ইস্যুতেই মেতে গেল৷ জনমনের অন্তরের ক্ষোভকে যেন প্রশমিত হতেই সাহায্য করল৷ তার কারণ কি এই যে নির্বাচনসর্বস্ব ও ক্ষমতাপিপাসু দলগুলিও বিজেপি’র মতই কর্পোরেট ধনকুবেরদের তোষণ করে চলে, আর এই সংকটগুলি তো তাদেরই সিস্টেমজাত৷ তাই তাদের চটাবে কে? ফলে মুখে যতই বিরোধিতা করা হোক না কেন, আসলে নির্বাচনের মুখে এই কর্পোরেট ধনকুবেরদের স্বার্থেই ‘মোদি হাওয়া’র গতিবেগ বাড়তে এই সমস্ত তথাকথিত বিরোধী দলগুলির বোকামি বা দায়বদ্ধতা সাহায্য করল৷
৪) কিন্তু এই কল্পিত ঝড় বা বাস্তবিক প্রাণপণ পরিশ্রমে ও বহু অর্থব্যয়ে গড়ে তোলা মৃদুমন্দ মোদি হাওয়া সত্ত্বেও কিন্তু যা পরিস্থিতি ছিল, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার ও ছত্তিশগড়ে বিজেপি’র অতি সামান্যই আসন পাওয়ার কথা৷ গত ডিসেম্বরেই উত্তরপ্রদেশ ও বিহার বাদে বাকি তিনটি প্রদেশেই বিধানসভায় গোহারান হেরেছে বিজেপি৷ এমনকি প্রায় কাছাকাছি সময়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সংসদ আসন গোরক্ষপুর সহ উত্তরপ্রদেশের ৩টি আসনের উপনির্বাচনেও বিজেপি হেরেছে৷ মাত্র এই কয়েক মাসের মধ্যেই কিন্তু এই রাজ্যগুলিতেও ফলাফল যা দেখা গেল, তা অত্যন্ত বিস্ময়কর শুধু নয়, সন্দেহজনকও বটে, যা প্রশাসনিক ম্যানিপুলেশন ছাড়া কোনওমতেই সম্ভব নয়৷ কর্ণাটকেও ভোটপূর্ব জনমত যে অবস্থায় ছিল সেখানেও বিজেপি’র এই ফল বিস্ময়কর৷ বিহার ছাড়া উপরোক্ত প্রদেশগুলির মতোই দক্ষিণ ভারতের একমাত্র এই রাজ্যটিতেই আরএসএস সরকারি প্রশাসনের ভেতরে এমনভাবে আছে, যাদের পক্ষে প্রশাসনিক ম্যানিপুলেশন বা সূক্ষ্ম কলাকৌশলের মাধ্যমে রিগিং করা সম্ভব৷
৫) পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’র জয়ের পিছনে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং সিপিআইএম পরিচালিত পূর্বতন ৩৪ বছরের সরকারের সমস্ত অপকর্মের নকলনবিশির মাধ্যমে মমতা–সরকারের দাপট, চাওয়া পাওয়ার রাজনীতি, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিএম কৃত দৃষ্টান্তের স্থূল প্রয়োগ এবং সর্বোপরি সিপিআইএম নেতৃত্বের মমতা সরকারের পরাজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার আত্মঘাতী কৌশল হিসাবে বিজেপিকে ১২–১৩ শতাংশ ভোট ঢেলে দেওয়া সবই সত্য৷ কিন্তু এখানেও বাছাই করা কিছু কেন্দ্রে প্রশাসনিক ম্যানিপুলেশন কাজ করেনি তা নয়৷ তৃণমূল কংগ্রেস এবারেও যেমন হিসাব কষে ছাপ্পা ভোট দিয়েছে, বিজেপিও (সিপিআইএম–এর কায়দায় এবং নিজস্ব হিটলারি কায়দা শিখে) ছাপ্পা ভোট দিয়েছে – এসবই হয়েছে জায়গা বিচার করে৷
ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের ৬০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে আর কয়েক লক্ষ কোটি কালো টাকায় ভোটবাজ দলগুলির মাধ্যমে ভোট কেনার ব্যবস্থা করে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রকে বাঁচানোর ঢক্কানিনাদ বাস্তবে এক হাস্যকর ভাঁড়ামিতে পরিণত হয়েছে৷ অবশ্য বিশ্বের সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী ও বিকাশশীল ধনতান্ত্রিক দেশেই আজ নির্বাচন ঘিরে কারচুপির ক্ষেত্রে এই পরিণতি দেখা যাচ্ছে৷
আজ দেশের গরিব মধ্যবিত্ত মানুষ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সমস্ত দিক থেকেই মার খেয়ে চলেছে, সরকার পরিবর্তনের কোনও চেষ্টাই তাদের বাঁচাতে পারছে না৷ ফলে হতাশ না হয়ে তাদের উপর আরও নতুন অত্যাচার, নতুন শয়তানি, ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে সরব সচেতন যুক্তি তোলাই আজ গণতন্ত্রকে বাঁচানোর একমাত্র পথ৷ সেই কাজ করবে কোন দল?
সূর্যকান্ত সেন, কলকাতা – ৫