এই রাজ্যের শিক্ষানুরাগী মানুষ একটু ধন্দে পড়েছেন৷ কয়েকদিন আগে স্কুলশিক্ষার রাজ্য ভিত্তিক মানদণ্ডের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের এক সমীক্ষা রিপোর্টে এই রাজ্যের শিক্ষার যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তার সাথে ১৯ মে প্রকাশিত মাধ্যমিকের ফলাফলে বিপুল সাফল্যের কোনও সঙ্গতি নেই৷ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকাশিত এই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, মাতৃভাষা, অঙ্ক এবং বিজ্ঞানের মূল্যায়নে বিহার, ওড়িশা, আসাম, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশের ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রছাত্রীরা পড়ে আছে অনেক পিছনে৷ কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের এই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, যে পাঁচটি সূচকে স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার পরিমাপ হয়েছে, তার প্রায় সবকটিতেই পিছনে পড়ে আছে পশ্চিমবঙ্গের স্কুলগুলি৷ কেরল, তামিলনাড়ু তো অনেক আগেই এই রাজ্যকে পিছনে ফেলেছে৷ এখন রাজস্থান, হিমাচলপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, হরিয়ানাকে স্পর্শ করাও দূরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
এখন সারা দেশে পশ্চিমবঙ্গের স্থান হয়েছে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ডের সাথে একাসনে৷ কিন্তু এটাই সব নয়৷ স্কুল পরিকাঠামোয় পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্ত নম্বর বিহার, উত্তরপ্রদেশের থেকেও অনেক খারাপ৷ ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের মধ্যে ৩৫ নম্বরে, কেবল মেঘালয়কে এই রাজ্য হারাতে পেরেছে৷ অথচ ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল দান করা এবং কন্যাশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু ছাত্রীকে এককালীন ২৫ হাজার টাকা পাইয়ে দেওয়ার স্কিম নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে শাসক দলের তাবড় তাবড় নেতারা কত আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন৷ কিন্তু তাঁরা একবারও ভেবে দেখেছেন কি এর দ্বারা শিক্ষার মানের কতটা উন্নতি ঘটল? এই প্রকল্পের বিজ্ঞাপনে যে পরিমাণ টাকা খরচ করা হয়েছে, সেই টাকা যদি পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করা হত, তাহলেও হয়তো পরিস্থিতি এতটা খারাপ হত না৷
এ বছরের মাধ্যমিকের পাশের হার দেখে কে বলবে আমাদের রাজ্যে স্কুলগুলিতে পড়াশোনা হয় না৷ তা হলে কি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রকের এই রিপোর্ট পক্ষপাত দুষ্ট? পশ্চিমবাংলাকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা? পশ্চিমবাংলার প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনার আর এক নিদর্শন৷ যদি ধরেও নেওয়া যায় কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রকের রিপোর্ট খানিকটা হলেও পক্ষপাতদুষ্ট, তবুও রাজ্যের মানুষের অভিজ্ঞতা তো এই রিপোর্টের সাথেই মিলে যাচ্ছে৷ তা ছাড়া রিপোর্ট যে তৈরি হয়েছে রাজ্য সরকারের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে!
তা হলে এই ধন্দের নিরসন হবে কী ভাবে? পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রকের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনও ব্যক্তির কাছে এই প্রশ্নের উত্তর অজানা নয়৷ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরীক্ষকদের সাথে কথা বললে আপনিও এর উত্তর পাবেন স্কুলে লেখাপড়ার তদারকিতে যতই গাফিলতি থাকুক না কেন, পরীক্ষায় নম্বর পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মাধ্যমিক বোর্ডের কোনও কার্পণ্য নেই৷ পরীক্ষকদের কাছে খাতা দেখার যে নির্দেশাবলি পাঠানো হয়, তাতে পরিষ্কার বলা থাকে যে, ছাত্রছাত্রীদের ফেল করানোটা পরীক্ষকদের উদ্দেশ্য নয়৷ তাই কোনও ছাত্র সঠিক উত্তর দিতে পেরেছে কি না সেটা বড় কথা নয়, উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছে কি না সেটাই বড় কথা৷ তাই কোনও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেই তাকে কিছু নম্বর দিতে হবে৷ তা ছাড়া কোনও ছাত্র যদি ১৩–১৯–এর মধ্যে নম্বর পায়, তা হলে তাকে ২০ নম্বর দিয়ে দেওয়াটা পরীক্ষকের দায়িত্ব৷ আর ২০ নম্বর পেলেই তো পাশ৷
এখানেই শেষ নয়, যাঁরা উত্তরপত্র দেখছেন তাঁরা স্ক্রূটিনি করে পাঠানোর পর প্রধান পরীক্ষকরা আবার বিশেষ ভাবে স্ক্রুটিনি করেন৷ এখানে নম্বরের অনেক হেরফের হয়ে যায়৷ কারণ এ বছর যিনি প্রধান পরীক্ষক আছেন, তিনি পরের বছর থাকবেন কি না তা এই নম্বরের উপর নির্ভর করে৷ এত বেশি পাশের হারের রহস্য এখানেই৷ নম্বর দেওয়ার এই মারাত্মক প্রবণতা শুরু হয়েছিল বামফ্রন্ট আমলেই৷ রাজ্যের শিক্ষার মানের মাপকাঠি দাঁড় করানো হল মাধ্যমিকে–উচ্চ মাধ্যমিকে পাশের হার৷ সিপিএম ফ্রন্ট সরকারের আমলেই পাশের হার বাড়িয়ে রাজ্যের শিক্ষার মানচিত্র কত উন্নত তা প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে৷ অন্যান্য বহু ক্ষেত্রের মতো এক্ষেত্রেও তৃণমূল সরকার তাদের শুধু অনুসরণই করেনি, ছাড়িয়ে গেছে৷
কিন্তু শিক্ষা নিয়ে এই প্রহসন ও ছেলেখেলা কি চলতেই থাকবে? অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দিয়ে শিক্ষার গোড়ায় কুড়ুল চালানোর যে ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে, তাতে শিক্ষার মানের অবনমন তো স্বাভাবিক৷ তার উপর শিক্ষক নিয়োগে গাফিলতি ও দুর্নীতির ফলে স্কুলগুলোতে উপযুক্ত মান ও সংখ্যায় শিক্ষকের অপ্রতুলতা এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে৷ কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের রিপোর্টে প্রকাশিত রাজ্যের স্কুলগুলোর দৈন্যদশায় যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে তাতে সরকারের নেতা–মন্ত্রীদের সম্বিত ফিরবে কি? না হলে শিক্ষাক্ষেত্রে এক সময় এগিয়ে থাকা পশ্চিমবঙ্গ শেষেরও নিচে নেমে যাবে৷