উত্তর ২৪ পরগনা জেলার গোপালনগর নহাটা সারদাসুন্দরী বালিকা বিদ্যামন্দিরের ঘটনা৷ মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্য ৫০ জন ছাত্রীকে নিয়ে যাত্রা শুরু এই রূপকথার৷ ওদের মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসিয়ে পাশ করানোর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে গডে উঠল এক নতুন প্রেরণাদায়ক কাহিনী৷ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা শম্পা পাল, সহ শিক্ষিকা সোহিনী বিশ্বাস, অর্পিতা নাথ, সুজাতা রায়ের মতো অন্যান্য দিদিমণিদের সাহায্য নিয়ে গ্রহণ করেছিলেন এই চ্যালেঞ্জটা৷ ১৭০ জনের ব্যাচে টেস্টে অনুত্তীর্ণ এই ৫০ জনকে পাশ করানোর লড়াইটা শুরু হয়েছিল বিশেষ কয়েকটি কারণে৷ অকৃতকার্যদের বসতে না দিলে অনেকেরই এখানেই পড়াশোনার পরিসমাপ্তি ঘটবে৷ তাছাড়া অধিকাংশ নিম্নবিত্ত পরিবারের এসব মেয়েদের পরিবারের পক্ষ থেকে তড়িঘড়ি বিয়ে দেওয়ারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে একই কারণে৷ এসব ভেবে শিক্ষিকারা এই সংকল্প নিয়েছিলেন যে, যেভাবেই হোক এদের পাশ করার মতো যোগ্য করে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসাতে হবে৷ এজন্য চাই প্রয়োজনীয় যত্ন আর সঠিক পরিকল্পনা৷ অভিভাবকদের ডেকে পাঠানো হল স্কুলে৷ মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হল সকলকে দিয়ে৷ অভিভাবকরা কথা দেন, ছুটির মধ্যেও প্রত্যেক দিন মেয়েকে পড়তে পাঠাবেন স্কুলে৷ আর কোনও গৃহশিক্ষক রাখা চলবে না৷ যা হওয়ার স্কুলের দিদিমণিদের হাত ধরেই হবে৷ বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা হয় ২০ ডিসেম্বর থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি৷ ২৫ ডিসেম্বর, পয়লা জানুয়ারির মতো উৎসবের দিনেও বন্ধ হয়নি বিশেষ প্রশিক্ষণ৷ সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলত বিশেষ তালিম৷ অনেকে অনেক বিষয়ে পিছিয়ে, তাদের এগিয়ে দেওয়ার সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেন দিদিমণিরা৷ শেষ পর্যন্ত সফল হলেন৷ ৫০ জনের মধ্যে ৪৮ জন মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হতে সমর্থ হল৷ দিদিমণিদের সাথে হাসি ফুটল কোয়েল, আসমিনা, বিজ্ঞানী, প্রিয়াংকাদের মুখেও৷
শিক্ষিকাদের প্রশংসা করার কোনও ভাষা নেই৷ টেস্টে ফেল করে তো অনেকেই মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক দিতে পারে না৷ কিন্তু এভাবে কত জনের হাত ধরে টেনে তোলেন মাস্টারমশাই–দিদিমণিরা? শুধু গোপালনগর কেন, শিক্ষকসমাজ চাইলে সারা দেশের চিত্র তো এমন হতে পারে৷ একটা আদর্শকে ভিত্তি করে লক্ষ্য পূরণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে বহু বাধাকে যে এভাবে জয় করা যায় তা এই ঘটনার দ্বারা আরও একবার প্রমাণিত হল৷ এ বাধা–জয় শুধু ওই ছাত্রীদের নয়, এখানে শিক্ষিকারাও একটা জয়ের স্বাদ পেলেন৷ প্রধান শিক্ষিকার কথায়, ‘ফল নিয়ে খুব টেনশনে ছিলাম৷ পরীক্ষা তো ওদের নয়, যেন আমরা দিদিমণিরাই নতুন করে একবার মাধ্যমিকে বসলাম৷’ এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ছাত্রী–শিক্ষিকাদের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হল তাও তো এই সমাজের কাছে এক দুর্লভ সম্পদ আজ গভীর দুঃখের সাথে লক্ষ করছি ছাত্র–শিক্ষকদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা, দুস্তর দূরত্ব যা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা–ভালবাসাকে কেডে নিচ্ছে৷ এমন ঘটনা এ জাতীয় সমস্যা থেকে উত্তরণেরও একটা পথ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে৷ ছাত্র–ছাত্রী এবং শিক্ষক–শিক্ষিকা– দু’পক্ষের এমন উত্তরণ আবার সমাজটাকেও বহু দূর এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে৷ প্রমাণিত হল, গোপালনগরের ওই স্কুলের শিক্ষিকারা শুধু চাকরি করতে আসেননি৷ তাঁরা এসেছেন শিক্ষাদান করতে, জ্ঞানের আলো সমস্ত স্তরে পৌঁছে দিয়ে সমাজের অন্ধকার দূর করতে৷
শিক্ষক সমাজের এমন আচরণ এই সমাজে হয়তো নতুন নয়৷ কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, তার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল আজ শিক্ষক সমাজের অনেকাংশকে এমন এক জায়গায় ঠেলে দিয়েছে যেখানে এ জাতীয় চিন্তা ভাবনা তাঁদের কাছে একরকম ব্রাত্য৷
বিদ্যাসাগরের জন্মের ২০০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে তাঁরই আদর্শের এমন এক ঝলক আমাদের নতুন আশায় উজ্জীবিত করল৷ (সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২/৫/১৯)
গৌরীশংকর দাস,
সাঁজোয়াল, খডগপুর