লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের স্লোগান ছিল ৪২–এ ৪২৷ অথচ প্রায় অর্ধেক আসন দখল করে নিয়েছে বিজেপি৷ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এই উত্থানের পিছনে তৃণমূল ও সিপিএম কারওর ভূমিকাই কম নয়৷ বর্তমানে এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তৃণমূলের অপশাসন, ঔদ্ধত্য, লুটপাটের রাজনীতি মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলছিল৷ সারদা–নারদ সহ বহু দুর্নীতিতে নিমজ্জিত নেতারা৷ পাশাপাশি একের পর এক নির্বাচনে, বিশেষ করে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে হাজার হাজার বুথে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়, প্রার্থী হতে না দেওয়া, ভোট দিতে না দেওয়া, ভোট লুঠ ইত্যাদি সিপিএমের দেখানো পথেই সিপিএমের চেয়ে নগ্নভাবে চলতে থাকে৷ মানুষ ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে৷ এই অবস্থায় তো সিপিএমেরই যা শক্তি এবং তাতে তাদেরই তো বিপন্ন হওয়ার কথা৷ কিন্তু তা হল না৷ কারণ সিপিএমের প্রতি মানুষের কোনও আস্থা নেই, সেই শূন্যস্থান ধীরে ধীরে পূরণ করতে থাকে বিজেপি৷ টাকা দিয়ে, মারদাঙ্গা করে, ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে বিজেপি জায়গা করে নিতে থাকে৷ বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতি আটকাতে তৃণমূলের কোনও ইতিবাচক ভূমিকা ছিল না৷ সেও বিজেপির মতোই হিন্দুত্বের রাজনীতি শুরু করে৷ দু’দলই রামনবমীর মিছিল, হনুমান মন্দির– এসবের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে৷ পাশাপশি মুসলিম ভোটের স্বার্থে তৃণমূল লোকদেখানো ইমাম ভাতা, মোয়াজ্জেম ভাতা চালু করে৷ এতে পশ্চিমবঙ্গের দরিদ্র মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রকৃতই কোনও উন্নতি হওয়ার নয়৷ কিন্তু এই বিষয়কে কেন্দ্র করে তৃণমূল মুসলমান তোষণের রাজনীতি করছে এই ধুয়ো তুলে হিন্দুদের উত্তেজিত করে তোলে বিজেপি৷ পাল্টা তৃণমূল দুর্গাপূজা কার্নিভাল থেকে শুরু করে শ্মশানের পুরোহিতদের ভাতা দেয় হিন্দু ভোটের জন্য৷ এভাবে ধর্মীয় বিভাজনকে হাতিয়ার করে ভোট নিয়ে লড়ালড়ি শুরু হয়৷ এতে রাজ্য জুড়ে বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়াতে সুবিধা হয়ে যায়৷ যার ফলশ্রুতিতেই লোকসভার এই ফল৷
অন্যদিকে সিপিএমের নীতিহীন রাজনীতিও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জমি তৈরি করতে সাহায্য করেছে৷ লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর পাড়ায় পাড়ায় সিপিএম কর্মীদের কোথাও চাপা, কোথাও প্রকাশ্য উচ্ছ্বাস চোখে পড়ার মতো৷ ভোট গণনার পরের দিন বহু অঞ্চলেই সিপিএম নেতারা ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘দিদিমণির পায়ের তলার মাটি এবার আলগা হয়ে যাচ্ছে’ হায় রে সিপিএম হায় রে সিপিএমের বামপন্থা নিজেরা যে কোন অতলে তলিয়ে যাচ্ছে, সে খেয়ালই নেই৷ তৃণমূলকে শিক্ষা দেওয়ার আনন্দেরই প্রতিচ্ছবি সিপিএম কর্মীদের চোখেমুখে পশ্চিমবাংলায় একটা একটা সিটে বিজেপি জিতেছে আর সিপিএম কর্মীদের মন আত্মতৃপ্তিতে ভরে উঠেছে৷ এমনটাই তো তারা চেয়েছিল৷ তারা ঢেলে ভোট দিয়েছে বিজেপিকে৷ সংখ্যার হিসাব বলছে, বিগত লোকসভার তুলনায় প্রায় ২২ শতাংশ ভোট কমে সিপিএম দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশে৷ এখানেও ধর্মীয় মেরুকরণ কাজ করেছে৷মুসলমান সিপিএম ভোট দিয়েছে টিএমসিকে৷ হিন্দু সিপিএম বিজেপিকে৷ চূড়ান্ত অবামপন্থী, সুবিধাবাদী এই ভোট রাজনীতিতে সিপিএম তত্ত্বের মোড়ক লাগিয়েছে৷ বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি হলে তৃণমূল দলটা শেষ হয়ে যাবে, বিজেপির অত্যাচারে তিতিবিরক্ত মানুষ আবার সিপিএমের কাছে ফিরে আসবে৷ এই তত্ত্ব খাড়া করেই তারা বিজেপির শক্তিবৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে৷ বামপন্থার লেশমাত্র কাণ্ডজ্ঞান থাকলে তারা বুঝত যে, আরএসএস–বিজেপির মূল শত্রু বামপন্থা৷
আসলে ২০১১ সালে ক্ষমতা হারানোর যন্ত্রণা আজও তাদের কুরে কুরে খাচ্ছে৷ যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতায় ফেরাটাই মুখ্য– কেন ক্ষমতা চাই, সে চিন্তা গৌণ৷ তাই কখনও কংগ্রেসকে আঁকড়ে ধরে সিট বাড়াবার চেষ্টা৷ কখনও বিজেপিকে ভোট দিয়ে তৃণমূলকে হারিয়ে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় ফিরে আসার স্বপ্নবিলাস৷ এ কি বামপন্থা
বামপন্থার পীঠস্থান এই পশ্চিমবাংলায় জনসংঘ–আরএসএস– মহাসভা–বিজেপি কোনও দিনই জায়গা করতে পারেনি৷ আজ বামপন্থী দলের কর্মী–সমর্থক থেকে নেতা–মন্ত্রীরা দলে দলে বিজেপিতে চলে যাচ্ছে প্রশ্ন জাগে, ৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকে ভোটচর্চা ছাড়া, মার্কসবাদের চর্চা তো ছেড়েই দিলাম, ন্যূনতম বামপন্থার চর্চা হয়েছে কি? আসলে ৩৪ বছরে ‘বামপন্থা’র নাম করেই গণআন্দোলন দমন করা হয়েছে লাঠি–গুলি দিয়ে৷ বামপন্থার নাম করেই অবাধে রিগিং–ছাপ্পা, একের পর এক জনবিরোধী মালিকতোষণকারী সিদ্ধান্ত আর পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি– এই তো হয়েছে ভি পি সিং সরকারকে কেন্দ্রে বিজেপির সাথে একসাথে সমর্থন, ১৯৯০ সালে বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা কর্পোরেশনের ক্ষমতা দখল– এসব তো বামপন্থার নামেই তারা করেছে৷
চিন্তাগত ক্ষেত্রে বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িকতাকে আটকাতে যে যথার্থ বামপন্থার চর্চা প্রয়োজন, তা সিপিএম কোনও দিনই করেনি৷ তাদের লক্ষ্য ও মোক্ষ ভোটে জিতে ক্ষমতায় যাওয়া৷ এই সেদিনও ব্রিগেডে লোক সমাগমে উচ্ছসিত সিপিএম নেতাদের মুখে কিন্তু কোনও আন্দোলনের বার্তা ছিল না৷ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বললেন, ‘দেখবেন, এই ভিড় যেন ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত হয়৷’ মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখেন না তাঁরা, দেখেন এক একটা ভোটার হিসেবে৷ সিপিএমের এই ভোটসর্বস্ব নীতিহীন রাজনীতিই পশ্চিমবাংলায় বিজেপির জমি তৈরি করে দিয়েছে৷
বিজেপি–আরএসএস সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে সমাজকে বিষাক্ত করে তুলছে৷ একে যদি সত্যি সত্যিই আটকাতে হয় তবে চাই উন্নত নীতি–নৈতিকতার আধারে যথার্থ বামপন্থার চর্চা, চাই সংগ্রামী বামপন্থার ঝান্ডাকে হাতিয়ার করে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল অংশের সাধারণ মানুষকে যুক্ত করে তীব্র গণআন্দোলন৷ একমাত্র বিকল্প সেটাই৷ সিপিএমের কর্মীরা ভেবে দেখবেন!