জনমন-জনমত

সার্থক ভেজা

 

বাঁকুড়ার গ্রাম থেকে সমাবেশে এসেছিলেন বেশ কিছু চাষি৷ অন্য সকলের মতো তাঁরাও বৃষ্টিতে ভিজেগিয়েছেন৷ ‘আপনাদের অসুবিধা হয়নি তো ?’ জিজ্ঞেস করতেই বললেন, রোদে পুড়ে জলে ভিজে কাজ করাই আমাদের চিরকালের অভ্যেস৷ কিন্তু আজকের ভেজাটা আমাদের সার্থক হল৷

পাল্টা স্রোত

সমাবেশের প্রচার চলছে এলাকায় এলাকায়৷ প্রচার শুনে বাঁকুড়ার একটি এলাকায় স্থানীয় বামপন্থী এক শিক্ষক এগিয়ে এসে কর্মীদের বললেন, রাজ্যে যে একটা চোরাস্রোত বইছে তা সবাই জানে৷ কিন্তু পাল্টা আর একটা স্রোত যে বইয়ে দেওয়া যায়, সেটা আপনারা দেখিয়ে দিলেন৷

ইচ্ছে করে সবটাই দিই

পুরুলিয়া শহরে ঠেলা গাড়িতে ঘুগনি বিক্রি করেন যুবক শীতল বাউরি৷ বাবা রিক্সাচালক৷ মা পরিচারিকা৷ নভেম্বর বিপ্লব কর্মসূচির জন্য ৬০০ টাকা চাঁদা দিয়েছেন তিনি৷ কী করে দিলেন এতগুলি টাকা? প্রতিদিন ঘুগনি বিক্রি করে যা লাভ হয় তার থেকে কোনও দিন পঞ্চাশ, কোনও দিন একশো টাকা স্থানীয় কর্মীকে ডেকে তাঁর হাতে তুলে দেন৷ কর্মীটি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সংসার চলবে কী করে? উত্তরে শীতল বললেন, আমার তো ইচ্ছে করে রোজগারের সব টাকাই পার্টিকে দিয়ে দিই৷ কিন্তু সংসার আছে তো৷ আশেপাশে তাঁর মতো গরিব সাত জন দোকানদারকে শীতল সমাবেশের গুরুত্ব বুঝিয়ে নিয়ে এসেছিলেন৷ প্রত্যেকেরই তিন দিনের রুজি বন্ধ হয়েছে৷ পরোয়া করেননি তাঁরা৷

আর কীসে দেবো?

সিপিএমের পুরুলিয়া জেলার জোনাল স্তরের নেতা৷ সরকারে থাকার সময়ে যথেষ্ট দাপুটে বলে পরিচয় ছিল৷ রাজনৈতিক ভাবে এস ইউ সি আই (সি)–র মোকাবিলায় বহু তৎপরতা দেখিয়েছেন৷ মাঝে বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেছে৷ দলের এক পরিচিত কর্মী এবার গিয়ে বললেন, দাদা, সমাবেশের জন্য কিন্তু চাঁদা দিতে হবে৷ বললেন, তা কী করে হবে, আমি তো অন্য দল করি৷ কর্মীটি বললেন, আপনাদের দল তো নভেম্বর বিপ্লব শতবার্ষিকী নিয়ে কিছু করছে না৷ আমরা তো সারা বছর নানা কর্মসূচির শেষে কলকাতায় বিশাল সমাবেশ করছি, তার জন্য কেন দেবেন না কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আচ্ছা, একটু ভাবি৷ সমাবেশের আগের দিন প্রবল বৃষ্টির মধ্যে যখন কর্মীরা ট্রেনে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন হঠাৎ কর্মীটিকে ফোন, কোথায় আছো? জেনে নিয়ে বললেন, একবার স্টেশনের বাইরে এসো৷ দেখা হতে বললেন, অনেক ভাবলাম৷ একবার ভাবলাম দেবো না৷ তারপর ভাবলাম, এই কর্মসূচির জন্য যদি টাকা না দিই, তবে আর কীসে দেবো৷ পাঁচশো টাকা কর্মীটির হাতে দিয়ে বললেন, ফিরে এসে দেখা কোরো৷

দরকার আরও ভাল ভাল লোক

পুরুলিয়া জেলার এক সময়ে বামপন্থী শাসক দলের কয়েক বারের বিজয়ী বিধায়ক৷ এবার পরাজিত হয়েছেন৷ এবার কর্মীরা গিয়ে চাঁদা চাইলেন৷ চাঁদা দিয়ে কর্মীদের বললেন, মানুষ চাঁদা আপনাদের ঠিক দেবে৷ এর জন্য ভাববেন না৷ এখন আপনাদের দরকার অনেক ভাল ভাল লোক৷ সেই লোকদের খুঁজে বের করুন৷ শেষে বললেন, সমাবেশের পরে একবার আসবেন৷

পেলাম তৃপ্তি

উত্তর দিনাজপুরের এক শিক্ষক, একদা সরকারি বাম দলের জেলা কমিটির সদস্য৷ নভেম্বর বিপ্লব শতবার্ষিকী সমাবেশের প্রচারে তাঁর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলে তিনি বলেন, আপনাদের এই কর্মসূচির কথা শুনে কী যে ভাল লাগছে সে কথা কী বলব আপনারা মার্কস এঙ্গেলস লেনিন স্ট্যালিনের ছবি দিয়ে যে গেট তৈরি করেছেন তার তলা দিয়ে হাঁটার সময় মনটা আনন্দে তৃপ্তিতে ভরে যায়৷ আমরা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকেও এমন জিনিস হয়নি৷ তারপর সাধ্যমতো চাঁদা দিয়ে বললেন, যোগাযোগ রাখবেন৷

বৃষ্টি এঁদের আটকাতে পারে না

১৭ তারিখ দুপুরে ট্যাক্সি করে পার্ক স্ট্রিট থেকে ধর্মতলার দিকে আসতে চাইছিলেন এক ভদ্রলোক৷ কিন্তু কোনও গাড়ি পাচ্ছিলেন না৷ সব গাড়ির চালকই বলছেন, ‘‘ওদিকে যাওয়া যাবে না, বড় মিটিং আছে৷’’ ভদ্রলোক বললেন, ‘‘দূর দূর এই প্রবল বৃষ্টিতে কীসের মিটিং’’ ট্যাক্সি চালকের উত্তর, দাদা, এটা এস ইউ সি পার্টির মিটিং৷ ঝড়–বৃষ্টি–তুফান কোনও কিছুই এদের আটকাতে পারে না৷’’

দাম দিতে হবে না

সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দু’জন স্বেচ্ছাসেবক শিল্পীদের খাবার দেওয়ার জন্য প্লাস্টিক ব্যাগ কিনতে গেছেন পাশের একটি ছোট্ট দোকানে৷ প্রায় শ–দুয়েক টাকার ব্যাগ কেনার সময় দোকানদার যখন জানতে পারলেন যে এরা এস ইউ সি আই (সি) দলের লোক তখন বললেন, ‘‘কী বিরাট সভা করেছেন আপনারা৷ সেই খবরই তো কাগজে পড়ছি৷’’ কর্মীটি দাম দিতে গেলে দোকানদার বললেন, ‘‘এই একটা দলই তো আমাদের জন্য লড়ে৷ কোনও দাম দিতে হবে না, নিয়ে যান৷’’

এই স্বেচ্ছাসেবকরাই তালতলা বাজারে ৪০০ ডিম কিনে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন, এতোগুলো ডিম কোথায় সিদ্ধ করবেন৷ তাঁদের বুকে পার্টির ব্যাজ দেখে দোকানদার বললেন, ‘‘আমায় দিয়ে যান, ব্যবস্থা করে দিচ্ছি৷’’ একজন স্বেচ্ছাসেবক সিদ্ধ করার খরচ জানতে চাইলে দোকানদার বললেন, ‘‘কিচ্ছু খরচ–টরচ লাগবে না৷ আরে, আমরা তো পুরো অবাক হয়ে গেছি৷ যাকে আমরা ছোট পার্টি ভাবি আজ তার আসল চেহারা দেখলাম৷ মনটা সত্যিই ভরে গেল৷’’

আদর্শই শক্তি

১৮ নভেম্বর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাঠে পুদুচেরির আকুপাংচার চিকিৎসক এ জয়লক্ষ্মী, আইনের ছাত্রী রুথরা সহ বেশ কিছু জন খোঁজ করছেন ছাত্র, ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের নেতাদের৷ এঁদের অনেকেই ছেড়ে এসেছেন সিপিএম দল৷ একটাই আর্জি– আমাদের রাজ্যে চলুন৷ সংগঠন করতে হবে৷ আমরা বুঝেছি এটাই সঠিক পার্টি৷ ১৭ নভেম্বরের সমাবেশ সেটাই আমাদের আবার দেখিয়ে দিল৷ দেখিয়ে দিল, এমএলএ–এমপি নয়, আদর্শই আসল শক্তি৷

নতুন মানুষ

উত্তরাখণ্ডের রেশমা পলিটিক্যাল সায়েন্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী৷ শ্রীনগর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের দরমুলা গ্রামে তাঁর মাকে গল্প বলেছেন সমাজতন্ত্রে মেয়েদের উন্নত জীবনের৷ এই গ্রামে ২–৩ জনের বেশি মেয়ে কলেজে পড়েনি৷ ছোটতেই বেশিরভাগের বিয়ে হয়ে যায়৷ তেমন গ্রামের মেয়ে রেশমা বলে গেল, যেদিন থেকে ডিএসও–তে যুক্ত হয়েছি, ভেবেছি নতুন মানুষ হব৷ নভেম্বর বিপ্লবের কথা আমার জীবন সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে৷

কাশ্মীরের ছাত্র

কাশ্মীর থেকে উত্তরাখণ্ডে পড়তে গিয়ে দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন গবেষক ছাত্র সেলিম জাফর৷ বললেন,  এক বছর ধরে সমাজতন্ত্র নিয়ে যে চর্চা করেছি তাতে বুঝেছি কাশ্মীরের মানুষের জ্বলন্ত সমস্যার সমাধান হতে পারে সমাজতন্ত্রের পথেই৷ নভেম্বর বিপ্লবের এই সমাবেশ আমার চোখ খুলে দিয়েছে৷ এখানে সবাই সবাইকে বোঝার চেষ্টা করছেন৷ যতটুকু বুঝেছি, তাতে কাশ্মীরের মানুষকে আপনারাই ঠিক মতো বুঝবেন৷