‘তাঁহার প্রধান গৌরব অজেয় পৌরুষ ও অক্ষয় মনুষ্যত্ব’

ভিওয়ানি

দেশাচারের দাস নহি

(পুত্র নারায়ণের বিধবাবিবাহের সংকল্পের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে ভাই শম্ভুচন্দ্রকে লেখা বিদ্যাসাগরের চিঠির একাংশ)

… ইতিপূর্ব্বে তুমি লিখিয়াছিলে, নারায়ণ বিধবাবিবাহ করিলে আমাদের কুটুম্ব মহাশয়েরা আহার–ব্যবহার পরিত্যাগ করিবেন, অতএব নারায়ণের বিবাহ নিবারণ করা আবশ্যক৷… আমি বিধবাবিবাহের প্রবর্তক, আমরা উদযোগ গ্রহণ করিয়া অনেকের বিবাহ দিয়াছি৷ এমন স্থলে আমার পুত্র বিধবাবিবাহ না করিয়া কুমারী–বিবাহ করিলে আমি লোকের নিকট মুখ দেখাইতে পারিতাম না৷ ভদ্রসমাজে নিতান্ত হেয় ও অশ্রদ্ধেয় হইতাম৷… বিধবাবিবাহ প্রবর্ত্তন অমার জীবনের সর্ব্বপ্রধান সৎকর্ম্ম৷ এজন্মে যে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোন সৎকর্ম্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই৷ এ বিষয়ের জন্য সর্ব্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরাঙ্মুখ নহি৷ সে বিবেচনায় কুটুম্ব বিচ্ছেদ অতি সামান্য কথা৷ কুটুম্ব মহাশয়েরা আহার–ব্যবহার পরিত্যাগ করিবে, এই ভয়ে যদি আমি পুত্রকে তাহার অভিপ্রেত বিধবাবিবাহ হইতে বিরত করিতাম, তাহা হইলে আমা অপেক্ষা নরাধম আর কেহ হইত না৷… আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে তাহা করিব, লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হইব না৷

অবশেষে আমার বক্তব্য এই যে, সমাজের ভয়ে বা অন্য কোন কারণে নারায়ণের সহিত আহার–ব্যবহার করিতে যাঁহাদের সাহস বা প্রবৃত্তি না হইবেক, তাঁহারা স্বচ্ছন্দে তাহা রহিত করিবেন, সে জন্য নারায়ণ কিছুমাত্র দুঃখিত হইবে, এরূপ বোধ হয় না, এবং আমিও তজ্জন্য বিরক্ত বা অসন্তুষ্ট হইব না৷… ইতি– ৩১ শে শ্রাবণ (১২৭৭ সাল)

দিল্লী

ধর্ম কী, তা জানার দরকার নাই’

কয়েকজন ভদ্রলোক একদিন বিদ্যাসাগরের কাছে৷ বললেন– বিদ্যাসাগর মহাশয় ধর্ম নিয়ে বাংলাদেশে বড় হুলস্থূল পড়েছে৷ যার যা ইচ্ছা, বলে যাচ্ছে৷ এ বিষয়ে কিছুই ঠিকানা নেই৷ আপনি ছাড়া এ বিষয়ের মীমাংসা হবার সম্ভাবনা নেই৷

বিদ্যাসাগার বললেন– ধর্ম যে কী, মানুষের বর্তমান অবস্থায় তা জানার উপায় নেই, এবং জানারও কোনও দরকারও নেই৷ … পণ্ডিতমশায় পড়ানোর সময় যখন জিজ্ঞেস করতেন, ‘ঈশ্বর বোঝো তো?’, আমি বলতাম, ‘আপনিও যেমন বোঝেন, আমিও তেমন বুঝি, পড়িয়ে যাচ্ছেন পড়িয়ে যান৷’ আমার কথা শুনে পণ্ডিতমশায় খুব হাসতেন৷

গুনা

বাবা আমার বিশ্বেশ্বর, মা অন্নপূর্ণা

বিদ্যাসাগরের পিতা–মাতা তখন কাশীতে৷ উনি তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে কাশীর কয়েকজন ব্রাহ্মণ বিদ্যাসাগরকে নামজাদা লোক হিসাবে কিছু টাকা–কড়ি দান করতে বললেন৷

বিদ্যাসাগর বললেন, আমি কাশী দর্শন করতে আসিনি, পিতৃদর্শনের জন্য এসেছি৷ আমি যদি আপনাদের মতো বামুনকে কাশীতে দান করে যাই, তা হলে আমি কলকাতায় ভদ্রলোকের কাছে মুখ দেখাতে পারব না৷ আপনারা যত রকমের দুষ্কর্ম করতে হয়, তা করে, দেশ ছেড়ে কাশীতে এসে উঠেছেন৷ এখানে আছেন বলে আপনাদের যদি আমি ভক্তি–শ্রদ্ধা করে বিশ্বেশ্বর বলে মান্য করি, তা হলে আমার মতো নরাধম আর নেই৷

সেই ব্রাহ্মণেরা বিদ্যাসাগর কে জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি কী তবে কাশীর বিশ্বেশ্বর মানেন না?

বিদ্যাসাগর উত্তর দিলেন–আমি আপনাদের কাশী মানি না৷ আপনাদের বিশ্বেশ্বর মানি না৷ সেই ব্রাহ্মণেরা রাগ করে বললেন–আপনি তাহলে কী মানেন? বিদ্যাসাগর বললেন–মাকে মানি, বাবাকে মানি৷ আমার বাবা আমার বিশ্বেশ্বর, আমার মা আমার অন্নপূর্ণা৷

(তথ্য সূত্র : করুণাসাগর বিদ্যাসাগর)

উত্তরাখণ্ড

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ

‘দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁর অক্ষয় মনুষ্যত্ব৷’

খাঁটি হিউম্যানিস্ট

শিবদাস ঘোষ

… বিদ্যাসাগর মশাইয়ের অভ্যুত্থান রেনেসাঁস আন্দোলনে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা৷ চারিদিকে ধর্মীয় কুসংস্কার আর কূপমণ্ডূকতার মধ্যে যখন শাস্ত্রের পণ্ডিত, টোলের পণ্ডিত এবং ব্রাহ্মণ্য দাপটে সমস্ত সমাজটা ধুঁকছে, তার মধ্যে পচন ধরেছে– এই রকম একটা পরিবেশে এবং সময়ে সেক্যুলার মানবতাবাদী ভাবধারার একটা প্রকৃষ্ট প্রকাশ আমরা বিদ্যাসাগরের মধ্যে দেখতে পাই৷ যতদূর মনে হয়, বিদ্যাসাগর মশাই–ই প্রথম ব্যক্তি, যিনি আমাদের দেশে ধর্মীয় সংস্কারের পথে রেনেসাঁস আন্দোলনকে ধর্ম থেকে মুক্ত করে ইতিহাস, বিজ্ঞান ও যুক্তির শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাইতে চাইলেন৷ সেক্যুলার করতে চাইলেন৷

বিদ্যাসাগরকে এ দেশের মানুষ বড় মানুষ বলে জানেন– তাঁকে শ্রদ্ধা করেন, পূজা করেন৷ কিন্তু তাঁকে বুঝেছেন কয়জন? আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই বিদ্যাসাগর মশাইয়ের বাইরের আচরণটা দেখে, তাঁর হাঁটুর ওপর কাপড় পরা এবং মাথায় টিকি রাখা দেখে তাঁকে একজন নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ বলেই ভাবেন৷ একথা ঠিক, বাইরে তাঁর শাস্ত্রকারের মতো এবং নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণের মতো বেশই ছিল৷ কারণ এ দেশটাকে তিনি বুঝতেন৷ কিন্তু ভিতরে তিনি ছিলেন তদানীন্তন ভারতীয় সমাজ পরিবেশে একজন খাঁটি হিউম্যানিস্ট৷ তিনি ভারতীয় সভ্যতার সাথে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান সভ্যতার একটা যুক্তিভিত্তিক সংযোগ সাধন করতে চেয়েছিলেন৷ তাই, তাঁর বক্তব্য ছিল– ‘ছাত্রদের ইংরাজী শেখাও, মিলের লজিক পড়াও এবং তা সংক্ষিপ্ত কোর্স নয়, পুরো কোর্স পড়াও৷ তিনি বলেছিলেন, ‘শুধু সংস্কৃত শিখিয়ে ন্যূব্জ হয়ে যাওয়া এই জাতির মেরুদণ্ড খাড়া করা যাবে না৷ এই জাতির মেরুদণ্ড খাড়া করতে হলে বিশ্বের জ্ঞান–বিজ্ঞানের সঙ্গে তাকে পরিচিত হবার সুযোগ দিতে হবে৷ ইংরাজী শিখলে দেশের যুবকরা তাদের মাধ্যমে ইতিহাস, লজিক ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তা–ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হবে, ইউরোপের বস্তুবাদী দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হবে৷

কেরালার কালিকট

কেউ মাথা নোয়াইতে পারে নাই’

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী

 … এই দেশে এই জাতির মধ্যে সহসা বিদ্যাসাগরের মতো একটা কঠোর কঙ্কালবিশিষ্ট মানুষের কীরূপে উৎপত্তি হইল, তাহা বিষম সমস্যার কথা৷ সেই দুর্দম প্রকৃতি যাহা ভাঙিতে পারিত, কেহ কখনও নোয়াইতে পারে নাই, সেই উগ্র পুরুষকার যাহা সহস্র বিঘ্ণ ঠেলিয়া ফেলিয়া আপনাকে অব্যাহত করিয়াছে, সেই উন্নত মস্তিষ্ক যাহা কখনও ক্ষমতার নিকট ও ঐশ্বর্যের নিকট অবনত হয় নাই, সেই উৎকট বেগবতী ইচ্ছা, যাহা, সর্ববিধ কপটাচার হইতে আপনাকে মুক্ত রাখিয়াছিল–তাহার বঙ্গদেশে আবির্ভাব একটা অদ্ভুত ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে গণ্য হইবে, সন্দেহ নাই৷ এই উগ্রতা, এই কঠোরতা, এই দুর্দমতা ও অনন্যতা, এই দুর্ধর্ষ বেগবত্তার  উদাহরণ– যাহারা কঠোর দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকিয়া দুই ঘা দিতে জানে ও দুই ঘা খাইতে জানে– তাহাদের মধ্যেই পাওয়া যায়৷ আমাদের মতো যাহারা তুলির দুধ চুমুক দিয়া পান করে ও সেই দুধ মাখন তুলিয়া জল মিশাইয়া লয়, তাহাদের এই উদাহরণ কীরূপে মিলিল, তাহা গভীর আলোচনার বিষয়৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪১ সংখ্যা)