ধামাধরা গণমাধ্যম : ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে যে, প্রায় সমস্ত গণমাধ্যম, বিশেষত টিভি চ্যানেল, দৈনিক–সাপ্তাহিক–মাসিক পত্র–পত্রিকাগুলি শাসকদলের মুখপত্রে পরিণত হয়েছে৷ কয়েকটি চ্যানেল তো প্রায় দলীয় চ্যানেলের মতো লাগাতার এবং সর্বক্ষণ বিজেপির পক্ষে প্রচার চালিয়ে গণমনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ ‘টক–শো’গুলিতে বিজেপির ধামাধরা লোকেদের বসিয়ে তাদের সমস্ত দলীয় এজেন্ডাকে সামনে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ এবং কখনও সাম্প্রদায়িকতা, কখনও গো–রক্ষা, অনুপ্রবেশ, কাশ্মীর সমস্যা, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদির অজুহাতে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে৷
প্রায় কোনও চ্যানেলই দেশে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র, বেকারত্ব, সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন, আদিবাসী–দলিতদের উপর আক্রমণ ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করছে না৷ আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, গরিব কৃষকদের আত্মহত্যা, নারী ও শিশুদের উপর নির্যাতন, নতুন কোনও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারা ইত্যাদি আলোচনায় আনাই হচ্ছে না৷ ক্ষমতায় আসার আগে বর্তমান শাসকদল যে গালভরা প্রতিশ্রুতিগুলি দিয়েছিল, সেগুলির কণামাত্র পূরণ করতে তারা কেন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল, সে–সব নিয়ে কোনও আলোচনা কোনও চ্যানেলে নেই৷ কোনও চ্যানেল এই প্রশ্ন তুলছে না যে, কেন প্রায় ২৪ লক্ষ সরকারি পদে নিয়োগ হচ্ছে না, কেন রেলে প্রায় ৪ লক্ষ পদ খালি পড়ে রয়েছে৷ বাস্তবে, দেশে এখন ৭.২ শতাংশ হারে বেকারত্ব বাড়ছে, যা গত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ৷ অথচ চ্যানেলগুলিতে এ নিয়ে বিতর্ক আয়োজন করা হচ্ছে না৷ বরং সেখানে তারা শাসকদলের পক্ষ নিয়ে নানা অবান্তর বিষয়, যার সাথে জনস্বার্থের কোনও সম্পর্ক নেই, সেগুলি জনগণকে গেলাবার চেষ্টা চালাচ্ছে৷
এর একমাত্র কারণ, বেশির ভাগ টিভি চ্যানেল চলে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলির টাকায়৷ শুধুমাত্র সরকারি বিজ্ঞাপনের লোভে নয়, বরং নিজেদের মুনাফার স্বার্থেও এহেন কাজ করছে ওই সংস্থাগুলি৷ কয়েকটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য, ব্যাঙ্কে সঞ্চিত জনসাধারণের টাকা লুঠ করার জন্যও শাসকদলের পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে৷ আবার, এগুলি যাতে তারা অবাধে করতে পারে সে–জন্য ভোটের সময় এরাই বিজেপির মতো দলগুলিকে বিপুল অর্থ জোগায়৷ যা দেয়, পাঁচ বছরে তার কয়েকশো গুণ লুটে নেয় জনগণের ঘাড় ভেঙে৷ মালিকশ্রেণিকে এই সুবিধা দেওয়ার জন্য বিজেপি নতুন কৌশল করে ‘নির্বাচনী বন্ড’ ছাড়ে বাজারে৷ এর ফলে কারা কত পরিমাণ টাকা এই দলগুলিকে দিচ্ছে, তা সহজেই গোপন করা যায়৷ গত নির্বাচনে বিজেপি ৯৫ শতাংশ বন্ড পেয়েছিল৷ জনগণের দ্বারা ধিক্কৃত কংগ্রেসের বদলে কর্পোরেট সংস্থাগুলি নিজেদের কায়েমি স্বার্থেই বিজেপিকে তুলে ধরেছিল৷ তাই এদের পরিচালিত মিডিয়ায় সারাক্ষণ বিজেপিকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন, বিশেষ অনুষ্ঠান ইত্যাদি করে বিজেপিকে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করা হবে৷ বিজেপিও বিভিন্ন চ্যানেলকে টাকা দেয়৷ এইসব চ্যানেলের কাজ হল, কোনও ঘটনাকে একপেশে করে দেখানো৷ সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে যা সামনে আনতে চায়, যা আড়াল করতে চায়, সে–সবই পরিকল্পনা মতো চ্যানেলে চলে৷ জনগণের সমস্যা যতটুকু তারা তুলে ধরে তা নিতান্ত বাধ্য হয়ে, গণবিক্ষোভের চাপে পড়ে৷ অনেকটা সিটির মাধ্যমে প্রেসার কুকারের হাওয়া বের করে দেওয়ার মতো৷ কেন না, মাঝে মধ্যে এমন না করলে ক্ষোভ ফেটে পড়ে অনর্থ ঘটতে পারে৷
ইদানীং চলছে ভুয়ো এবং সাজানো খবরের রমরমা৷ মুনাফার স্বার্থে চ্যানেলগুলি হর–হামেশাই এই জঘন্য কাজ করে চলেছে৷ সমাজে এর কতটা কুপ্রভাব পড়ছে, তা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই৷ এমনকী সরকারি ওয়েবসাইটেও অন্য দেশের রাস্তা–আলো–শহর ইত্যাদির ছবি দিয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের সাফল্য বলে প্রচার করা হচ্ছে৷ বিজেপি ক্ষমতায় বসার পর থেকে এই হীন প্রবণতা মারাত্মক ভাবে বেড়েছে৷
সম্প্রতি দু’জন বিশিষ্ট টিভি–সঞ্চালককে চ্যানেল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ কারণ, তাঁরা সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের হাল–হকিকৎ প্রকাশ্যে আনছিলেন৷ স্বভাবতই, তা সরকারি দলের মনপসন্দ হয়নি৷ যে–কেউ সরকারের সমালোচনা করছে তাঁকেই এভাবে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ যে–সব চ্যানেল সরকার–বিরোধিতা করে জনস্বার্থের কথা তুলে ধরছে, তাদের কাজে নানা ভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে৷ এমনকী কেবল–পারেটরদের নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে৷ শাসকদলের না–পসন্দ চ্যানেলগুলো সম্প্রচার না করার জন্য অপারেটরদের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে৷
ধামাধরা পত্রপত্রিকা : সংবাদপত্রগুলির ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটছে৷ বেশির ভাগই সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করছে৷ কিন্তু যারা তা করছে না তাদের উপর নেমে আসছে আক্রমণ৷ ‘ইকনমিক টাইমস’–এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার দু’দিন পরেই সরকারি চাপে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করান হয়৷ এরকম ঘটনা সম্ভবত দেশে প্রথম ঘটল৷ সংবাদপত্রের মালিকেরা প্রায়শই সম্পাদকদের নির্দেশ দিচ্ছেন, সরকারের বিরুদ্ধে বেশি কিছু না লিখে বরং তার ‘সাফল্যের রঙিন ছবি’ তুলে ধরতে৷
পেইড–নিউজ এখন একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ বোঝা মুশকিল, কোনটা লেখা আর কোনটা পয়সা দিয়ে লেখানো৷ বলা হয়, সংবাদপত্র গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ৷ তার কাজ স্বাধীন ভাবে সরকারের ত্রুটি–বিচ্যুতি তুলে ধরা৷ সরকার যদি জনহিতে কাজ না করে তাহলে সেগুলি প্রকাশ্যে আনা সংবাদপত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব৷ এর মধ্য দিয়ে সঠিক জনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করাই তার বিশেষ দায়িত্ব৷ অর্থাৎ সংবাদমাধ্যম হবে সরকারের সমালোচক, তার তল্পিবাহক নয়৷ ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, মত প্রকাশের অধিকার এবং স্বাধীনতা কোনও অবস্থাতেই কোনও সরকার কেড়ে নিতে বা খর্ব করতে পারে না৷ এই অধিকারকে আরও প্রসারিত করতে ‘তথ্য জানার অধিকার আইন’ তৈরি হয়েছে৷ যার মাধ্যমে সরকারের অপ্রকাশিত তথ্য জেনে সাংবাদিকেরা বাস্তবতা তুলে ধরেন৷ কিন্তু বিজেপি কার্যত এই অধিকারকে নানা ভাবে খর্ব করছে৷
সরকার গণমাধ্যমকে নানা ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্রিটিশ আমলের ‘অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট’কেও ব্যবহার করছে৷ রাফাল কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গেও এ জিনিস তারা করেছে৷ এর সাথে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনাটা তো বিজেপির নিত্যকার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ছোটখাটো ব্যাপারেও সাধারণ মানুষকে তারা দেশদ্রোহিতার নামে অভিযুক্ত করার মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে৷
সোস্যাল মিডিয়ার উপর আক্রমণ : ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর সরকার একটা নতুন আইনের কথা বলে দেশের ১০টি সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করেছে৷ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টিতে কোনও কিছু আপত্তিকর মনে হলেই তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ এমনকী ৭ বছর পর্যন্ত জেলও হতে পারে৷ অন্য দিকে, সোস্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করেই কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় ফ্যাসিবাদী আক্রমণ নামিয়ে আনতে চাইছে দেশের সাধারণ জনগণের উপর৷ এবং সেজন্য তারা আইটি অ্যাক্টে এমন সংশোধন আনতে চাইছে যাতে সরকার বিরোধী প্রত্যেককে চিহ্ণিত করতে সুবিধা হয়৷ আর, নিজের ধামাধরাদের মাধ্যমে অসংখ্য ভুয়ো খবর ও ভিডিও ইত্যাদি ছড়িয়ে সমাজে ঘৃণা–বিদ্বেষকে উস্কানি দিচ্ছে৷ এজন্য রীতিমতো একাধিক আইটি–সেল খুলে তারা দাঙ্গা লাগাচ্ছে, গণপিটুনিতে নিরীহ গরিব মানুষকে মারছে৷ প্রায় সকলেই জানে, দিল্লি ও তার আশপাশে প্রায় ৪০০ জন ভাড়াটে লোক নিযুক্ত করেছে বিজেপি৷ এদের বলা হয় স্ট্রোল ম্যানেজার৷ এদের কাজ হল সারাক্ষণ ভুয়ো খবর বানানো, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনামূলক ভিডিও বানানো, নানা বিকৃত তথ্য–পরিসংখ্যান দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা৷
সরকারি দলের হাতে এটা একটা নতুন হাতিয়ার৷ বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণ করার একটা মোক্ষম অস্ত্র৷ সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে যারা তাদেরকে সুকৌশলে বিভ্রান্ত করার কাজেই সরকার একে ব্যবহার করছে৷ যদিও ‘আইপি অ্যাড্রেস’ থেকে ভুয়ো খবর প্রচারকদের ধরা যায়, স্ট্রোল ম্যানেজারদের খুঁজে বের করা যায়৷ সেই আইন আছে৷ সম্ভবত সেই কারণেও সরকার আইটি অ্যাক্টে সংশোধন আনতে চাইছে৷
বাস্তবে, তারা আইনি সংশোধন এনে প্রকৃত খবরগুলিকেই চাপা দেওয়ার ষড়যন্ত্র করবে৷ না হলে, ঠিক লোকসভা ভোটের আগে এ ধরনের আইন সংশোধনের উদ্দেশ্য কী? ২০১৫ সাল থেকে বিজেপি সরকার দেশে কৃষক–আত্মহত্যার তথ্য প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছে৷ ২০১৬ সাল থেকে দেশে সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা প্রকাশও সরকার বন্ধ করেছে৷ এমনকী শ্রমমন্ত্রক থেকে কর্মসংস্থানের তথ্য দেওয়ার দপ্তরও তুলে দেওয়া হয়েছে৷ জিডিপি সংক্রান্ত তথ্যও সরকার বিকৃত করছে নিজের ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য৷
সেই ব্যর্থতা চাপা দিতেই তারা গণমাধ্যম ও সোস্যাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে৷ সে সংক্রান্ত আইন সংশোধন করতে চাইছে৷ গণতন্ত্র ও বাক–স্বাধীনতার পক্ষে যাঁরা তাঁদের প্রত্যেকের উচিত এহেন কাজের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া এবং তীব্র বিরোধিতা করা৷