গবেষণার বিষয়বস্তু হতে হবে জাতীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এমন সব বিষয়েই৷ তবেই পিএইচডি করার অনুমতি দেওয়া হবে৷ এটিই বর্তমানে কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের ফরমান৷ ২০১৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১১টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের একটি সভায়, যেখানে সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের অধীন উচ্চশিক্ষা দপ্তরের সচিব আর সুব্রহ্মনিয়ন এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডি পি সিং, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে বিষয়গুলি নিয়ে গবেষণা করা হবে তা জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে হবে৷ কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১৩ মার্চ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অফ কেরালার রেজিষ্ট্রার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ও বিভাগীয় প্রধানদের চিঠি দিয়ে জানান জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে নিরুৎসাহিত করতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ের তালিকা তৈরি করতে হবে যার বাইরে কোনও বিষয় নিয়ে গবেষণা করা চলবে না৷ তবে জাতীয় স্বার্থ কী তা স্পষ্ট করা হয়নি ওই নির্দেশিকায়৷ উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে গুজরাট সরকার অনুরূপ নির্দেশ জারি করে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত ৮২টি বিষয়ের একটি তালিকা দেয় যেগুলির মধ্য থেকে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গবেষণা করতে হবে৷ স্পষ্টতই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির অন্যতম এজেন্ডা হিসাবেই গবেষণার ওপর এই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ৷
মনে রাখা দরকার যথার্থ শিক্ষা ও গবেষণা কোনও জাতীয় সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তার এক ও একমাত্র লক্ষ্য জ্ঞানের প্রসার৷ বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অর্থ জ্ঞানের বিস্তার ক্ষতিগ্রস্ত করা৷ গবেষণার জন্য প্রয়োজন মুক্ত পরিবেশ যেখানে চিন্তার, প্রশ্ণ করার এবং বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করার স্বাধীনতা থাকবে৷ তাই যারা গবেষণাকে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত করে মুক্ত জ্ঞান চর্চার পথ রুদ্ধ করতে চায় তাদের দুরভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই৷
প্রশ্ন হল, জাতীয় স্বার্থ বলতে কী বোঝায়, কী অর্থে জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় স্বার্থ কী তা স্থির করবে কে? কীসের ভিত্তিতে জাতীয় স্বার্থ স্থির করা হবে? তা কি পুঁজিবাদী বাজারের চাহিদা অথবা ক্ষমতাসীন দলের বিচার অনুযায়ী নির্ধারিত হবে? অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে এটা কি চলতে পারে? এ ধরনের ফতোয়ার অর্থ মৌলিক ও তাত্ত্বিক গবেষণা যা সরাসরি প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, সেই সব গবেষণার জন্য কোনও অর্থ বরাদ্দ করা হবে না৷ যাঁরা জ্ঞানের প্রসার চান, যা গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য, তাঁরা কি এটা মেনে নিতে পারেন?
এই ফতোয়ার পরিণাম ভয়ঙ্কর৷ এটি মুক্ত জ্ঞানচর্চার পথে বাধাস্বরূপ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষক ও গবেষকদের স্বাধিকার ক্ষুণ্ণ করবে৷ সরকারের দায়িত্ব হল অর্থের অভাবে যাতে গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করা, কিন্তু কোনও অজুহাতেই গবেষণার উপর খবরদারি করা নয়৷ অথচ দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার নানা ভাবে মুক্ত চিন্তার পথ, বিশেষ করে অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্র রুদ্ধ করতে সচেষ্ট৷
আশার কথা শিক্ষক–গবেষকরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন৷ সরকারের এই নির্দেশকে আত্মঘাতী ও সামন্তী বলে আখ্যায়িত করে তার প্রতিবাদে কেরল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ ইংলিশ–এর অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর কালচারাল স্টাডিজ–এর ডঃ মিনা টি পিল্লাই ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্যের বোর্ড অফ স্টাডিজ থেকে পদত্যাগ করেছেন৷ তাঁর মতে কর্পোরেটদের স্বার্থেই এই সার্কুলার৷ এতে মুক্ত চিন্তা ধ্বংস হবে যা শিক্ষার ক্ষতি করবে৷ জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জয়তী ঘোষ এর প্রতিবাদ করে বলেছেন, এই সরকারের নীতিই হল বিরোধী সমালোচনা চলবে না৷ প্রতিবাদের মুখে ২৫ মার্চ একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ মন্ত্রক বলেছে, তারা এই সার্কুলার দেয়নি৷ কিন্তু তাতে আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই, কারণ তাদের নীতিই স্বাধিকারের হস্তক্ষেপ৷ অল ইন্ডিয়া সেভ এডুকেশন কমিটি অবিলম্বে এই সার্কুলার প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে৷
ড. প্রদীপ কুমার দত্ত,
প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা