ভারতে নির্বাচনগুলি যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাতে এটা পরিষ্কার যে, নির্বাচনে ভালমন্দ বিচারটাই যেন ক্রমাগত হারিয়ে যচ্ছে৷ দল বা দলীয় প্রার্থীর নীতি–আদর্শ কী, সে আদর্শ সমাজ বা দেশের অগ্রগতির সহায়ক কি না, দেশের মৌলিক সমস্যা বিশেষভাবে বেকার সমস্যা, শিল্পায়নের সমস্যা, কৃষির সমস্যা সমাধানের উপযুক্ত কি না ইত্যাদি কোনও বিষয়ই বিচারের মধ্যে মূলত আনা হচ্ছে না৷ না মিডিয়া প্রচারে, না দলীয় প্রচারে কোথাওই এর লেশমাত্র নেই৷ নির্বাচন দাঁড়িয়ে গেছে ‘কে জিতবে, কে হারবে’ এই গণ্ডিতে৷ জনস্বার্থে কার জেতা উচিত, কার হারা উচিত এবং এই কারণে উচিত ইত্যাদি বিষয় প্রচারে নেই৷
প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে যে বক্তব্য রাখছে সেখানে বইছে কু–কথার স্রোত৷ সোস্যাল মিডিয়াতেও ছড়ানো হচ্ছে কুরুচিকর, অশালীন বক্তব্যের বিষ৷ তাতে রাজনৈতিক–সামাজিক পরিবেশ কলুষিত হচ্ছে৷ রাজনৈতিক সহনশীলতার পরিবর্তে রাজনৈতিক বিদ্বেষ মাথা তুলছে৷ এই কু–কথার স্রোত এত লাগামছাড়া যে, তা নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন কমিশন বলছে তারা অসহায়৷ শুধু কি পশ্চিমবঙ্গে? প্রতিটি রাজ্যেই এ জিনিস চলছে এবং সংসদীয় সব রাজনৈতিক দলের তাবড় তাবড় নেতারা পর্যন্ত এর বাইরে নন৷
একে অপরের বিরুদ্ধে এরা চিন্তা সমৃদ্ধ রাজনৈতিক বক্তব্য রাখতে পারছেন না কেন? বিচার করলে দেখা যাবে, তাদের রাজনৈতিক বক্তব্যে শব্দ এবং বাক্যগত পার্থক্য যাই থাকুক, প্রত্যেকের রাজনীতি এক সুরে বাধা৷ সেটা কী? সেটা হচ্ছে যেভাবেই হোক ভোটে জেতা এবং সরকার গঠন করে ভারতের শোষক পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে কাজ করা, পার্লামেন্টে বা বিধানসভায় তাদেরই স্বার্থে নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া৷ এদের বিগত বছরগুলির ইতিহাস বা কার্যধারা বিচার করলে এই বক্তব্যের সত্যতা অবশ্যই মিলবে৷ তা হলে প্রতিটি দলই যদি পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হয়, তা হলে তারা কী করে একে অপরের বিরুদ্ধে নীতিগত এবং পরিশীলিত রাজনৈতিক বক্তব্য রাখবে? কী করেই বা সাধারণ মানুষের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়াবে? এটা সম্ভব নয়৷ আবার সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে বা বিভ্রান্ত করে– পক্ষে আনতে না পারলে ভোটে জেতা মুশকিল৷ সেই কারণে এরা পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যক্তি আক্রমণ, কুৎসা– এ সবেই মত্ত৷
আরেকটা জিনিস প্রবলভাবে চলছে৷ সেটা হচ্ছে টাকার থলি ও গুন্ডারাজের ব্যবহার৷ প্রার্থী হতে বাধা দেওয়া, প্রচার করতে বাধা দেওয়া, বুথ দখল করে ছাপ্পা মারা, গণনা কেন্দ্রে পর্যন্ত ছাপ্পা দিয়ে বিরোধী ভোট বাতিল করা সবই এ রাজ্যের মানুষ বিগত নির্বাচনগুলিতে দেখেছে৷ অন্য রাজ্যেও ঘটছে৷ বিষয়টা এত ব্যাপক যে, ভারতের ১৬তম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নবীন চাওলা পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘গুন্ডারাজ এবং টাকার থলির অশুভ জোট ভারতের গণতন্ত্রকে দুর্বল করছে’৷ ( হিন্দুস্থান টাইমস– ২৬.১২.২০১৭)৷
নবীন চাওলা সাড়ে পাঁচ বছর ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ছিলেন৷ ২০০৯–এর লোকসভা নির্বাচন তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হয়েছে৷ তাঁর কার্যকালে রাজ্যে রাজ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিধানসভা নির্বাচনও৷ সে সব দেখে তাঁর উপলব্ধি ‘মানি পাওয়ার’ এবং ‘মাসল পাওয়ার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্বাচনে জেতার মূল নিয়ামক৷ তাঁর পর্যবেক্ষণ, ভারতীয় গণতন্ত্রে গুন্ডারাজের প্রাদুর্ভাব কোনও নতুন বিষয় নয়, ’৭০–’৮০–র দশক থেকেই এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা বাড়তে শুরু করেছে৷
চাওলা তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন, এখন কোটিপতি এবং ক্রিমিনালরাই নির্বাচনে জয়ী হয়৷ দেখিয়েছেন ১৫তম বা ১৬তম লোকসভায় প্রায় ৩০ শতাংশ সাংসদের বিরুদ্ধেই এক বা একাধিক ক্রিমিনাল কেস বা ফৌজদারি মামলা রয়েছে৷ খুন, খুনের উদ্দেশে আক্রমণ, তোলাবাজি, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি– এই ধরনের মামলাই তাদের বিরুদ্ধে বেশি৷ বোঝা যায় জনস্বার্থে আন্দোলন করার জন্য পুলিশ এদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেনি, মামলা সত্যিই অপরাধজনিত৷
রাজনৈতিক দলগুলি এদের প্রার্থী করে কেন? এদেরই বা কেন সাংসদ হওয়া জরুরি প্রয়োজন? সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলি এদের প্রার্থী করে এদের মস্তান বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে সহজে ভোটে জেতার জন্য৷ ’৮০–র দশক পর্যন্ত এই সব মাফিয়ারা বাইরে থেকে রাজনৈতিক দলকে বা তার প্রার্থীকে সাহায্য করত যাতে প্রার্থী বিজয়ী হয়ে ক্রিমিনালদের স্বার্থ রক্ষা করে– পুলিশি গ্রেপ্তার থেকে বাঁচায় বা নিদেন পক্ষে তাদের কাজে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়৷ এখন তারা নিজেরাই নির্বাচনে দাঁড়ায়, যাতে বিধায়ক সাংসদ হয়ে নিজেরাই সব কন্ট্রোল করতে পারে৷
২০১৪ সালে যে লোকসভা নির্বাচন হল এবং বিজেপি সরকার গঠন করল, সেই লোকসভায় ৫৪৩ জন সাংসদের মধ্যে কোটিপতির সংখ্যা ৪৪২ জন৷ দেশের অতি নগণ্য অংশ কোটিপতি৷ ৯৫ ভাগ মানুষই তো গরিব–নিম্নবিত্ত–মধ্যবিত্ত৷ সংসদে তাদের প্রতিনিধি কোথায়? বাস্তবে পার্লামেন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে ধনীদের প্রতিষ্ঠান৷ এই কোটিপতি সাংসদরা কী সাধারণ মানুষের হয়ে কাজ করে? তথ্য বলছে, সংসদে যতগুলি জনবিরোধী বিল পাশ হয়েছে তাতে সম্মতি দিয়েছে এই সাংসদরা৷
জনসাধারণ কোটিপতি এবং ক্রিমিনাল প্রার্থীদের বারবার ভোট দিচ্ছেন কেন? তাদের হয়ে কাজ করবে এমন প্রার্থীদের কেন তারা ভোট দিচ্ছেন না বা নির্বাচিত করছেন না? এখানেই রয়েছে মিডিয়ার ভূমিকা৷ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া থেকে প্রিন্ট মিডিয়া এখন পুরোপুরি পুঁজিপতি শ্রেণির কব্জায়৷ পুঁজিপতি শ্রেণি যে প্রার্থীদের মনে করে তার বিশ্বস্ত সেবক হিসাবে কাজ করতে পারে, সেই সেই প্রার্থীর বা প্রার্থীর দলের হয়ে এমন জোরালো প্রচার শুরু করে যে, সাধারণ মানুষের চোখ ঝলসে যায়৷ প্রচারের তোড়ে মানুষ ভাবতে শুরু করে এই প্রার্থীরই জেতার সম্ভাবনা৷ ফলে তাকেই ভোট দিয়ে দেয়৷
এ প্রসঙ্গে মার্কসবাদী চিন্তাবিদ শিবদাস ঘোষ বলেছেন, ‘‘ইলেকশন হচ্ছে একটা বুর্জোয়া পলিটিক্স৷ জনগণের রাজনৈতিক চেতনা না থাকলে, শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রাম এবং শ্রেণি সংগঠন না থাকলে, গণআন্দোলন না থাকলে, জনগণের সচেতন সংঘশক্তি না থাকলে শিল্পপতিরা, বড় ব্যবসায়ীরা, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিরা বিপুল টাকা ঢেলে এবং সংবামাধ্যমের সাহায্যে যে হাওয়া তোলে, যে হাওয়া তৈরি করে, জনগণ উলুখাগড়ার মতো সেই দিকে ভেসে যায়৷’’
নির্বাচনে এক একটি কেন্দ্রে যত প্রার্থী থাকে বুর্জোয়া মিডিয়া তার মধ্যে থেকে দু’তিন জন প্রার্থীকে প্রচার দেয়৷ বাকিদের কথা উল্লেখ করে না বললেই চলে৷ এটা একটা বুর্জোয়া ষড়যন্ত্র৷ সাধারণ মানুষ এই ফাঁদে পড়ে বুর্জোয়া প্রচারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বুর্জোয়াদের প্রার্থীকে নিজের পছন্দের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করে বসেন৷ ফলে বুর্জোয়াদের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়ে বুর্জোয়াদের স্বার্থেই কাজ করে৷ জনগণের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে নানা বিল পাশ করায়৷ তার বিনিময়ে বুর্জোয়াদের কাছ থেকে তাদের প্রাপ্তিও ঘটে৷ স্বাধীনতার পর থেকে এই জিনিসই ঘটছে৷ যা দেখে সাধারণ মানুষ বলেন, ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’৷ এরা যে লঙ্কায় যাওয়ার আগেই রাবণ জনসাধারণ তা ধরতে পারেন না প্রচারের জৌলুসে৷ যতদিন পর্যন্ত জনসাধারণ শ্রেণি সচেতন না হচ্ছে, অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণির সত্যিকারের দল এবং প্রার্থীকে চিনতে না পারছে, তার পক্ষে বলিষ্ঠভাবে না দাঁড়াচ্ছে ততদিন পর্যন্ত এর ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷