৩০ জানুয়ারি মহামিছিলে আসার জন্য চাঁদা তুলে বাসের ব্যবস্থা করেছিলেন ঢাকুরিয়া এলাকার কর্মীরা৷ একে একে ছাত্র অভিভাবক সমাজের নানা অংশের মানুষ জড়ো হচ্ছেন৷ এক মা স্কুটি চড়ে তাঁর সন্তানকে নিয়ে হাজির৷ দশম শ্রেণির ওই ছাত্রটিকে স্কুলের গেটে মিছিলে আসার আবেদন করেছিলেন দলের কর্মীরা৷ ছাত্রটির স্কুল ড্রেস দেখে কর্মীরা বললেন, তোমাকে তো বলেছিলাম স্কুল ড্রেস পরে না আসার জন্য৷ ছাত্রটি মা–র দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, কেন ড্রেস পরে যাবে না৷ ছাত্র, ছাত্রের ড্রেস পরেই মিছিলে যাবে৷ বললেন, পাশ–ফেল তুলে দেওয়াটা অন্যায়৷ তার প্রতিবাদ করতে সে স্কুলের প্রতিনিধি হয়েই যাবে৷ কর্মীরা বললেন, অনেক সময় কোনও কোনও মিডিয়া এই ড্রেস দেখিয়েই প্রচার করতে থাকে– স্কুল থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জোর করে নিয়ে এসেছে৷ মা বললেন, ঠিক আছে, তার উত্তরে কী বলতে হবে তা আমি ওকে বলে দিচ্ছি৷ আর বাকি যা বলার আমি বলব৷
টালিগঞ্জ এলাকা থেকে এসেছিলেন মুকুলবাবু৷ বয়স একাশি বছর৷ একটি অপারেশনে পিঠের দুটি হাড় বাদ দিতে হয়েছে৷ প্রবীণ বামপন্থী মানুষ৷ দলের কর্মীরা যখন তাঁকে মিছিলের কথা বলেন, তিনি বললেন, আমি দেখতে যেতে পারি, মিছিলে হাঁটতে পারব না৷ আমার বেশি হাঁটা নিষেধ৷ কর্মীরা বললেন, তাই চলুন৷ প্রবীণ এই মানুষটি মিছিলের বিশালতা, শৃঙ্খলা দেখে না হেঁটে থাকতে পারেননি এবং হেদুয়া থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত হাঁটেন৷ মিছিল শেষে বললেন, এই মিছিল সাম্প্রতিক ব্রিগেড সমাবেশের থেকে বেশি৷ কেন? তিনি উত্তর দিলেন, ‘দশ হাজার সুশৃঙ্খল মানুষের মিছিল এক লক্ষ মানুষের সমাবেশের সমান৷ তা হলে লক্ষ মানুষের এমন সুশৃঙ্খল মিছিল তো ব্রিগেডের বেশিই হবে৷’ কথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ
রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে যাঁরা মিছিল দেখেছেন, মিছিলের শৃঙ্খলা তাঁদের সকলকে মুগ্ধ করেছে৷ মধ্য কলকাতায় এমনই একজন মাঝবয়সী মহিলা বললেন, আমি সিপিএমের মিছিল দেখেছি, তৃণমূলের মিছিল দেখেছি৷ কিন্তু এমন অদ্ভুত শৃঙ্খলা আমি কোথাও দেখিনি৷ গোটা মিছিলটা প্রথম থেকে শেষ অবধি একই রকম সুশৃঙ্খল৷ কেউ কথা বলছে না, গল্প করছে না, সবাই স্লোগানে গলা মিলিয়ে চলেছে৷ মিছিল দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেছে৷
কর্মীদের অনুরোধে এক দোকান কর্মী এসেছিলেন মিছিল দেখতে৷ পরে দেখা হলে বললেন, আমি রাজনীতি একদম পছন্দ করি না, মিছিল তো নয়ই৷ শুধু আপনারা যে দাবিগুলি নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন সেগুলির প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন আছে বলেই মিছিল দেখতে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু মিছিল দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি৷ শুরু থেকে কলেজ স্ট্রিট পর্যন্ত হেঁটেছিও৷
মিছিলের কয়েকদিন আগে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের গেটে লিফলেট বিলি করছিলেন দলের কর্মীরা৷ অনুরোধ করছিলেন ৩০ জানুয়ারির মিছিলে যাওয়ার জন্য৷ একজন লিফলেট নিয়ে তাতে পার্টির নাম দেখে যেন আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন– এই তো, এই পার্টিটারই তো আমি খোঁজ করছিলাম কত দিন ধরে৷ আপনাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না৷ তিনি খিদিরপুরের একটি উর্দুমাধ্যম সুক্লের শিক্ষক৷ সব শুনে নিয়ে বললেন, আমি অবশ্যই মিছিলে যাব৷ বললেন, পাশ–ফেল চালু করাটা খুবই দরকার৷ তিনি সেদিন হেদুয়া থেকে ধর্মতলা পুরোটাই হেঁটেছেন এবং বলে গেছেন, আন্দোলনের যে কোনও কাজে আমায় ডাকবেন, আমি থাকব৷
কলেজ স্ট্রিট বাটার মোড়ে মিছিলে আটকে পড়া এক বাইক আরোহী খানিকটা ধৈর্য হারিয়ে বললেন, আর কতক্ষণ চলবে মিছিল৷ পাশে এসে দাঁড়ানো এক ব্যক্তি বললেন, আরে দাঁড়ান না, ছোট পার্টির মিছিল, কতক্ষণ আর হবে, এখুনি শেষ হয়ে যাবে৷ সঙ্গে সঙ্গে মিছিল দেখতে থাকা আর এক ব্যক্তি প্রতিবাদের সুরে বলে উঠলেন, ছোট পার্টি বলছেন? আধঘন্টার উপর দাঁড়িয়ে আছি৷ সারা রাস্তা জুড়ে মিছিল চলেছে তো চলেছেই৷ দেখছেন না কত মানুষ এসেছে৷
কলেজ স্ট্রিট মোড়ের আগে মিছিলে হাঁটা এক পরিচিত মহিলাকে উদ্দেশ করে স্থানীয় এক দোকান কর্মচারী বললেন, কী বৌদি, আপনিও মিছিলে৷ তিনিও দাঁড়িয়ে এই দীর্ঘ মিছিল দেখছিলেন৷ এর কাছাকাছি মিছিল থেকে এক কর্মী ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক পরিচিত মহিলাকে বারবার ডেকেও সাড়া পেলেন না– তিনি বিভোর হয়ে দেখছেন অগণিত ছাত্র–যুব–মহিলাকে৷ পাশে দাঁড়ানো আর এক মহিলা বললেন, আমাদের সংসার ভেঙে দিচ্ছে এই ভয়ঙ্কর নেশা৷ মদের উচ্ছেদের লড়াই আমরাও চাই৷ সেখানেই দাঁড়িয়েছিলেন এক বিএড ছাত্রী৷ তাঁর বন্ধুর আহ্বানে এসেছেন মিছিলে যোগ দিতে৷ মিছিল দেখে উচ্ছ্বসিত– এত লোক হবে ভাবতে পারিনি৷
পঞ্চাশোর্ধ এক মহিলা হাঁটতে হাঁটতে ওয়েলিংটনের কাছে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সঙ্গে থাকা অন্যরা তাঁকে অনুরোধ করলেন না হেঁটে বাসে যাওয়ার জন্য৷ তিনি ব্যাগ থেকে ইনহেলার বের করে কয়েক বার নিয়ে বললেন, না, আমি পুরোটাই হাঁটব৷ মিছিল থেকে এ ভাবে বেরিয়ে যাওয়া উচিত নয়৷
এস এন ব্যানার্জী রোডে লোটাস সিনেমার মোড়ে শত শত মানুষ মিছিল দেখছেন৷ এক ব্যক্তি একটু ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, এরা মিটিং–মিছিলগুলো নিজেদের অফিসে করতে পারে না পাশেই দাঁড়ানো এক ব্যক্তি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, হ্যাঁ যেগুলো ওঁদের দলের মিটিং সেগুলো ওঁরা অফিসেই করেন৷ এই মিছিলের দাবিগুলো সবই জনগণের, তাই এটা রাস্তায় করছেন৷
ধর্মতলায় মিছিল শেষ হওয়ার পর এক পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে দলের এক কর্মীকে বললেন, পঞ্চাশ হাজারের বেশি লোক হয়েছে বলে আমার মনে হয়৷ কিন্তু আমার যেটা আশ্চর্য লেগেছে তা হল, এত লোক কিন্তু কী সুশৃঙ্খল আমাদের তো কিছুই করতে হয়নি৷