২০১৮–র শেষলগ্নে একটি খবর অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে৷ খবরটি হল, ঋণ খেলাপের দায়ে কেনিয়ার প্রধান বন্দর মোম্বাসা কিছুদিনের মধ্যেই চীনের দখলে চলে যেতে বসেছে৷
সংবাদটি চমকে ওঠার মতোই৷ এতদিন আমেরিকা, জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেনের মতো বনেদি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিকেই দেখা গেছে ঋণের জাল বিস্তার করে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলির অর্থনীতি ও রাজনীতিকে কবজা করতে৷ যাকে স্ট্যালিন ‘নয়া উপনিবেশবাদ’ বলে অভিহিত করেছেন৷ তারও আগে লেনিন ‘সুদখোর মহাজনী পুঁজি’র (ইউজিয়ারি ক্যাপিটাল) কথা বলেছেন– যে পুঁজি শিল্পে বিনিয়োগ না হয়ে ঋণ হিসাবে বাজারে আসে এবং রাজনৈতিক প্রভুত্ব বিস্তারের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়৷ বিশ্বব্যাপী তৃতীয় তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের যুগে বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ ঠিক এই কাজটাই আমেরিকার হয়ে দীর্ঘদিন করে চলেছে৷ এই তালিকায় নবতম সংযোজন পুঁজিবাদী চীন৷
কী ঘটেছিল কেনিয়ায়? কয়েক বছর আগে কেনিয়া তার দেশের স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলপথ উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য চীনের কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছিল৷ ঋণ মঞ্জুর হয়েছিল চীনের একজিম ব্যাঙ্কের মাধ্যমে৷ ঋণের গ্রহীতা ছিল কেনিয়া পোর্ট অথরিটি– যারা কেনিয়া রেলওয়ে কর্পোরেশনের হয়ে ঋণচুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং সরকার তাতে সম্মতি জানায়৷ চুক্তিতে বলা হয়েছিল, এই রেলপথ যদি ঋণ পরিশোধের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাতে না পারে তবে মোম্বাসা বন্দর সহ কেনিয়া পোর্ট অথরিটির সম্পদ চীনের দখলে চলে যাবে৷ এই রেল প্রকল্প থেকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ উঠে আসার কোনও সম্ভাবনা আছে কি না, তা নিয়ে সে সময়ই প্রশ্ন উঠেছিল৷ বাস্তবেও দেখা গিয়েছিল, প্রথম বছরেই এই প্রকল্পে ১০ বিলিয়ন শিলিং (কেনীয় মুদ্রা) লোকসান হয়েছিল৷ চুক্তিতে আরও বলা হয়েছিল, চুক্তি রূপায়ণে কোনও বিরোধ দেখা দিলে তার সালিশী হবে চীনে, কেনিয়ায় নয়৷ বস্তুত নানাদিক থেকেই এটা পরিষ্কার, এই চুক্তি ছিল অসম, যেখানে চীনের স্বার্থকেই অধিকতর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে৷ যা পরিস্থিতি তাতে ঋণ খেলাপির দায়ে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই মোম্বাসা বন্দর চীনের দখলে চলে যাবে৷ পরিণতিতে বন্দরের কাজের সঙ্গে যুক্ত কয়েক হাজার কেনীয় শ্রমিক–কর্মচারী কাজ হারাবেন৷ বন্দর থেকে সংগৃহীত রাজস্ব সরাসরি চলে যাবে চীনের একজিম ব্যাঙ্কে৷
এমন একটি চুক্তিতে কেনিয়া কেন সম্মতি দিল, তার বাধ্যবাধকতা কী ছিল? আফ্রিকা মহাদেশের অধিকাংশ দেশই অত্যন্ত পশ্চাদপদ৷ কেনিয়া এদের মধ্যে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও সামগ্রিকভাবে তার অর্থনীতি আজও কৃষিনির্ভর৷ ভারী শিল্প বলতে তেমন কিছু এখানে গড়ে ওঠেনি৷ শিল্প বলতে রয়েছে শুধু চা–কফি রপ্তানি এবং পর্যটন ব্যবসা৷ এদের এই পশ্চাৎপদতার সুযোগ আমেরিকা ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি বারবার নিয়ে এসেছে৷ আজ পুঁজিবাদী চীনও সেই সুযোগ নিতে ঝানু সাম্রাজ্যবাদীর মতো কৌশল নিয়েছে৷ সাম্রাজ্যবাদীরা এভাবেই শিকার খুঁজে বেড়ায় দুনিয়া জুড়ে৷
এখানে স্মরণ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, এশিয়া ও আফ্রিকার এই দুর্বল দেশগুলির উপর সাম্রাজ্যবাদীদের হানাদারি ঠেকাতে পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক শিবির অতীতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল৷ সোভিয়েত রাশিয়া, চীন সহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি তখন অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া দেশগুলির দিকে অর্থ, প্রযুক্তিসহ নানা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত৷ ফলে এই দেশগুলি সাম্রাজ্যবাদীদের চোখরাঙানি ও দাদাগিরি থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বিকাশের পথে এগিয়ে যেতে পারত এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধচক্রান্তের বিরুদ্ধে, শান্তির পক্ষে দৃঢ় ভূমিকা নিয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হত৷ ট্র্যাজেডি এটাই, সমাজতন্ত্র পরিত্যাগ করা চীন আজ সাম্রাজ্যবাদীর ভূমিকায়৷
শুধু তো কেনিয়া নয়, শ্রীলঙ্কায়, জাম্বিয়ায় চীন কোন ভূমিকা পালন করেছে? ঋণ খেলাপের অজুহাতে শ্রীলঙ্কার হাসবেনতোতা বন্দর ৯৯ বছরের লিজে চীন দখল করেছে৷ জাম্বিয়া চীনের কাছে হারিয়েছে তাদের কেনেথ কৌন্ডা বিমানবন্দর৷ প্রতিবেশী দেশগুলিকে তাদের মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করার উদ্দেশ্যে চীন যে বিস্তীর্ণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলছে যাকে তারা ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিসিয়েটিভ’ নাম দিয়েছে, সেখানেও মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, মালদ্বীপ, মঙ্গোলিয়া, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তানের মতো দেশগুলির ঘাড়ে চাপিয়েছে বিশাল অঙ্কের ঋণের বোঝা৷ এছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকা, ভেনেজুয়েলা, লাওস, মালয়েশিয়া, মিশরের মতো বহু দেশ চীনের ঋণজালে আবদ্ধ৷ আফ্রিকায় চীনের মোট ঋণের পরিমাণ ২০০৫ সালে যেখানে ছিল ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৬ সালে তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷ বিশেষ করে পরিকাঠামো ও যোগাযোগ ক্ষেত্রকে তারা বেছে নিচ্ছে৷ ঋণ খেলাপের কারণে ঋণগ্রহীতা দেশগুলিকে তারা বাধ্য করেছে তাদের নানাভাবে সুবিধা দিতে বা অন্যায় দাবি মেনে নিতে৷
চীনে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর দু’যুগেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত৷ সমাজতন্ত্রের হাত ধরে চীনের অর্থনীতি বিপুল শক্তি অর্জন করেছিল৷ তার সুদৃঢ় পরিকাঠামো, বিশাল উৎপাদিকা শক্তি এবং কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুবাদে আজ সে এক বিশ্বশক্তিতে পরিণত৷ পুঁজির ক্ষমতার বিচারে আমেরিকার পরেই আজ তার স্থান৷ বিশ্ববাজারের দখল পেতে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সাথে সে সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছে৷ আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ লড়ছে, আমেরিকার মতোই এশিয়া–আফ্রিকার দুর্বল দেশগুলি তার আক্রমণের লক্ষ্য৷ সমাজতন্ত্রের সাথে পুঁজিবাদ–সাম্রাজ্যবাদের এটাই পার্থক্য৷ চীন একদিন দুনিয়ার খেটে খাওয়া মানুষের আশা–ভরসার স্থল ছিল৷ সমাজতন্ত্র ত্যাগ করার পর সেই চীনই আজ নিজের দেশের এবং দুনিয়ার নানা দেশের খেটে খাওয়া মানুষের রক্ত শোষণকারীতে পরিণত৷