প্রেসিডেন্ট ওমর আল–বশিরের পদত্যাগের দাবিতে গত ডিসেম্বর থেকে সুদানে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে৷ ৯ জানুয়ারি রাজধানী খার্টুমে সেই বিক্ষোভ তীব্রতম রূপ নেয়৷ রাজধানী লাগোয়া ওমডারমান শহরে এদিন পুলিশের গুলিতে তিনজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়৷ আহত হন বেশ কয়েকজন৷ বিক্ষোভে এখনও পর্যন্ত ৪০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছে৷
২৯ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন আল–বশির৷ ১৯৮৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতায় বসেন তিনি৷ আফ্রিকা মহাদেশের একসময়কার বৃহত্তম দেশ সুদান অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এখন চূড়ান্ত দুরবস্থায়৷ ২০১১ সালে আলাদা দেশ হিসাবে দক্ষিণ সুদান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর থেকে সুদানের অর্থনৈতিক দুর্দশা বেড়েছে, কারণ দেশের তেল সম্পদের চারভাগের তিনভাগই চলে গেছে দক্ষিণ সুদানে৷ আল–বশির এই দুরবস্থা শুধু সামাল দিতে পারছেন না তাই নয়, নানা ধর্ম ও জাতিতে বিভক্ত দেশটির মধ্যে শান্তি বজায় রাখার কাজেও তিনি ব্যর্থ৷ দেশে বেকার সমস্যা ভয়াবহ, জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া৷ এর ওপর রুটিতে আর সরকারি ভরতুকি পাওয়া যাবে না, এমন আশঙ্কা তৈরি হওয়া ক্ষোভে ফেটে পড়ে সুদানের মানুষ৷ ১৯ ডিসেম্বর পথে নামে তারা৷ সেই থেকে লাগাতার বিক্ষোভ চলছে সুদান জুড়ে৷
৯ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে মুখর সুদানের বিক্ষোভরত কয়েক হাজার মানুষ পার্লামেন্টের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ পুলিশ কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করে, গুলি চালিয়ে তাদের বাধা দেয়৷ এ দিন বিক্ষোভকারীদের সংগ্রামী মেজাজ ছিল তুঙ্গে৷ সন্ধ্যা নেমে যাওয়ার পরেও বিক্ষোভ থামেনি৷ পুলিশের তাড়া খেয়ে বার বার রাজপথ ছেড়ে আশপাশের রাস্তায় চলে যেতে হয়েছে বিক্ষোভকারীদের, কিন্তু পরক্ষণেই আবার দল বেঁধে পার্লামেন্ট ভবনের দিকে অভিযান চালিয়েছে তারা৷
এক তরুণীর কথায় ফুটে উঠেছে সুদানের মানুষের দুরবস্থার ছবি৷ উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও উপযুক্ত কাজ না পেয়ে সে কয়েকটি অফিসে ঝাড়পোঁছের কাজ করে৷ মেয়েটি জানিয়েছে, ‘‘প্রেসিডেন্টকে গদি ছাড়তেই হবে, কারণ আমাদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে৷ সমস্ত ভয় আর দ্বিধা ছেড়ে এই প্রথমবার আমি বেরিয়ে এসে প্রতিবাদে যোগ দিয়েছি৷ এছাড়া বাঁচার আর কোনও উপায় নেই৷’’
দীর্ঘদিন যাবৎ সুদানের অশান্ত পরিস্থিতি দেশের মানুষকে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে আজ পথে নামিয়েছে৷ অবিভক্ত সুদান ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীন৷ ১৯৫৬ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সুদানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বার বার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নানা ঘটনায়৷ স্বাধীন হওয়ার বছর খানেক আগে থেকে দক্ষিণ সুদানের বিদ্রোহীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়, শুরু হয় গৃহযুদ্ধ৷ ১৯৫৮ সালে সদ্যস্বাধীন সুদানে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী৷ ছ’বছর ধরে শাসন কায়েম রাখে তারা৷ ১৯৬৪ সালে নির্বাচন হয়৷ একের পর এক সরকার গঠিত হয়, কিন্তু কেউই গৃহযুদ্ধ বন্ধ করতে পারেনি৷ ১৯৬৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় বসেন সেনা–ফিসার জাফর আল–নিমেইরি৷ এরপর সামরিক বাহিনীই ১৯৮৫ সালে আল–নিমেইরিকে হঠিয়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় বসায়৷ এর চার বছর পরে ইসলামি মৌলবাদীদের ঘনিষ্ঠ সেনা অফিসার আল–বশির অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সুদানের প্রেসিডেন্ট পদ দখল করেন৷
২৯ বছর ধরে আল–বশিরের শাসনে দেশের মানুষকে ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে৷ একদিকে ইসলামি ভাবাদর্শের নাম করে তিনি একটি অনুগত মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করেছেন, যা তাঁর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে জোরদার করেছে৷ অন্যদিকে নানা কৌশলে প্রতিবেশী দেশগুলির কোনওটির সঙ্গে হৃদ্যতা তৈরি করে, কোনওটির বিরুদ্ধে গিয়ে, কখনও একটি দেশকে অন্য দেশের বিরুদ্ধে উসকে দিয়ে সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন৷ এই প্রক্রিয়ায় দেশের মধ্যে ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের একটি অনুগত চক্র গড়ে তুলেছেন যাদের হাতে জমা হয়েছে ব্যাপক সম্পদ ও ক্ষমতা৷ ক্রমাগত আরও বেশি করে শোষিত লুন্ঠিত হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষ৷
বাড়তে থাকা দুর্দশা সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে এর আগেও বার বার প্রেসিডেন্ট আল–বশিরের বিরুদ্ধে ফেটে পড়েছে সুদানের সাধারণ মানুষ৷ বার বারই বিক্ষোভকারীদের হত্যা করে, বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার করে, শহরে শহরে কারফিউ কিংবা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে, স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বন্ধ করে দিয়ে বিরোধী কণ্ঠের টুঁটি টিপে ধরেছেন তিনি৷ কিন্তু পেট বড় বালাই৷ তাই আবারও গত ডিসেম্বর থেকে বিক্ষোভের পথে সুদানের জনতা৷