কংগ্রেস যে আদৌ ধর্মনিরপেক্ষ নয়, তা ‘গণদাবী’র পাতায় বহুবার প্রমাণ সহ তুলে ধরা হয়েছে৷ তবুও যাঁদের ধন্ধ মেটেনি, তাঁরা পড়ে নিতে পারেন ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ সংবাদপত্রের সহকারি সম্পাদক রশিদ কিদওয়াইয়ের ‘ব্যালট– টেন এপিসোডস দ্যাট শেপড ইন্ডিয়াজ ডেমোক্রেসি’ বইটি৷ এতে তিনি দেখিয়েছেন, বাবরি মসজিদ ভাঙা, রামমন্দির তৈরির খেলা ও তাকে কেন্দ্র করে যে কদর্য রাজনীতি এ দেশে চলছে তার প্রধান হোতা কংগ্রেস৷
কংগ্রেস ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচন সম্পূর্ণ ‘হিন্দু তাস’–এর ভিত্তিতে পরিচালনা করেছিল৷ একজন শিখ রক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধী হত্যার অব্যবহিত পরে ওই ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ দেশ জুড়ে তখন কংগ্রেস নেতাদের প্রত্যক্ষ মদতে শিখ নিধন চলছিল৷ ভিন্দ্রানওয়ালে ও তাঁর সশস্ত্র গোষ্ঠীকে অপসারণ করার উদ্দেশ্যে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে ‘অপারেশন ব্লু স্টার’ নামে সেনা অভিযান এবং ভিন্দ্রানওয়ালের হত্যার ঘটনা তার আগেই ঘটে যায়৷ কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রচারের ফোকাস ছিল – শিখদের পৃথক ‘হোমল্যান্ড’ চাওয়ার বিরুদ্ধে৷ ওই বইয়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদ ‘‘দ্য বিগ ট্রি অ্যান্ড দ্য স্যাপলিং’’–এ বলা হয়েছিল, ‘কংগ্রেসের গোপন অ্যাজেন্ডা ছিল হিন্দু মানসিকতায় নিরাপত্তাহীনতার বীজ ঢুকিয়ে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস যে একমাত্র রক্ষাকর্তা হতে পারে তা বুঝিয়ে হিন্দু ভোট নিশ্চিত করা’৷
ওই বইতে আরও বলা হয়েছে, ‘নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী রাজীব গান্ধী কংগ্রেসের পক্ষে আরএসএস–এর সমর্থন চেয়ে নাগপুরের কংগ্রেস এমপি বনোয়ারিলাল পুরোহিতের মাধ্যমে তৎকালীন সরসঙঘচালক বালাসাহেব দেওরসের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করেছিলেন’৷ আর ওই সমর্থনের বিনিময়ে আরএসএস অযোধ্যায় রামজন্মভূমি শিলান্যাসের অনুমতি চেয়েছিল৷ সেই নির্বাচনে বিজেপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সত্ত্বেও আরএসএস তার পাশে না দাঁড়িয়ে কংগ্রেসকে দু’হাত তুলে সমর্থন করেছিল৷
রাজীব গান্ধীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ নেহেরু এক সাপ্তাহিকীতে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘১৯৮৬ সালের প্রথম দিকে ‘মুসলিম কার্ড’ খেলতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ‘মুসলিম মহিলা বিল’ পাশ করানো হয়েছিল এবং তারপর ‘হিন্দু কার্ড’ খেলার জন্য অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের তালা খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷’’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘মসজিদের তালা খোলার দু’দিন পর এক সন্ধ্যায় আমি রাজীব গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই৷ তিনি তখন দূরদর্শনে দেখছিলেন মসজিদের ভিতরে রামলালার পূজা চলছে৷ আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, কে এসব জিনিস দূরদর্শনে দেখানোর ব্যবস্থা করেছে? তিনি কোনও উত্তর দেননি, মৃদু মৃদু হাসছিলেন, আর পূজা দেখছিলেন৷ আমি তারপর উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বীরবাহাদুর সিংকে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলাম যে, কে এইসব ব্যবস্থা করেছেন৷ তিনি উত্তরে জানান, আপনি প্রধানমন্ত্রীকেই জিজ্ঞাসা করুন৷’’
তারপর ১৯৮৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে হিন্দু ভোট আরও নিশ্চিত করতে রাজীব গান্ধী আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে বাবরি মসজিদের কাছেই রামমন্দিরের শিলান্যাসের অনুমতি দেন৷ রামমন্দির ইস্যু অতি দ্রুত কংগ্রেসের হাত থেকে সংঘ পরিবারের হাতে চলে যায়৷ বস্তুত ওই শিলান্যাসই ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ভাঙা ও তার পরবর্তী ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীজ বপন করেছিল৷
কংগ্রেসের সঙ্গে আরএসএসের গভীর সম্পর্কের আরও উদাহরণ পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ ও সিকিমের প্রাক্তন রাজ্যপাল এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইবি–র প্রাক্তন প্রধান টি ভি রাজেশ্বরের বই ‘দ্য ক্রুসিয়াল ইয়ার্স’–এ৷ ওই বইতে বলা হয়েছে বালাসাহেব দেওরস ইন্দিরা গান্ধী ঘোষিত জরুরি অবস্থার বহু পদক্ষেপের দৃৃ সমর্থক ছিলেন৷ রাজেশ্বর বলেছিলেন, ‘‘তাঁরা (আরএসএস) জরুরি অবস্থার কেবল সমর্থক ছিলেন তাই নয়, সেই সমর্থন প্রকাশ করার জন্য দেওরস এমনকী ইন্দিরা গান্ধী ও সঞ্জয় গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন’’৷ ওই বইতে বলা হয়েছে, আরএসএস ইন্দিরা গান্ধীকে ভোটের সময় সমর্থন করতে চেয়েছিল এবং তা জানানোর জন্যও সরসঙঘচালকের প্রয়োজন ছিল ইন্দিরা ও সঞ্জয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার৷
এই সমস্ত তথ্য থেকে এটা জলের মতো পরিষ্কার যে ইন্দিরা কংগ্রেস তথা কংগ্রেসের সঙ্গে চরম দক্ষিণপন্থী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি আরএসএস–এর সম্পর্ক কত সুগভীর ও সুপ্রাচীন৷ অন্যদিকে আরএসএসের সঙ্গে বিজেপির রসায়ন কারও অজানা নয়৷ অথচ এই কংগ্রেসের গায়ে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ তকমা লাগিয়ে সিপিএম বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জোট বাঁধতে উঠে পড়ে লেগেছে!