মুখ্যমন্ত্রী যখন ‘সব জানেন’ তাহলে চোখ বুজে থাকেন কেন

এতদিন এলাকায় এলাকায় শাসক তৃণমূল নেতাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ক্ষোভের সঙ্গে যে অভিযোগ তুলে আসছিলেন, তা–ই এবার স্বীকার করে নিলেন দলনেত্রী স্বয়ং৷ সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী দলীয় কর্মীদের সভায় বলেছেন, ‘কে কোথা থেকে টাকা তোলে আমি সব জানি৷’

সিপিএমের দুর্নীতি, তোলাবাজি, সন্ত্রাস যখন মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল তখনই রাজ্যে এক ব্যাপক গণবিক্ষোভ ফেটে পড়েছিল৷ পতন হয়েছিল সিপিএম সরকারের৷ ক্ষমতায় বসেছিল তৃণমূল সরকার৷ অনেকে ভেবেছিল, সরকারের পরিবর্তনে বোধহয় পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে, জীবনে স্বস্তি আসবে সাধারণ মানুষের৷ কিন্তু মানুষের মোহ ভাঙতে দেরি হয়নি৷ যত দিন যাচ্ছে, মানুষ দেখছে সর্বত্র নেতা–কর্মীরা কীভাবে দুর্নীতি আর তোলাবাজিতে উত্তরোত্তর জড়িয়ে যাচ্ছে৷ অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে, কিছুদিন আগে পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণায় শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জী যখন বাস দুর্ঘটনায় নিহত এক ব্যক্তির স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে সরকারি প্রকল্পে তাঁকে গৃহ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন তখন শোকার্ত মহিলা মরিয়া হয়ে মন্ত্রীকে বলেই ফেলেন, বরাদ্দ অর্থ যেন নেতাদের হাতে না দেওয়া হয়, তা হলে টাকা শেষপর্যন্ত তাঁর কাছে পৌঁছবে না৷

দুর্নীতি-তোলাবাজি

স্বাভাবিক ভাবেই সিপিএম শাসন থেকে তৃণমূল শাসনে রাজ্যবাসীর অভিজ্ঞতা অনেকটা ফুটন্ত কড়াই থেকে লাফিয়ে জ্বলন্ত উনুনে পড়ার মতো৷ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর হঠাৎ এই স্বীকারোক্তির দ্বারা রাজ্যবাসীর কী লাভ হবে? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তিনি জানেন কারা, কোথা থেকে টাকা তুলছেন৷ দল তথা সরকারের প্রধান হিসাবে তাঁর তো এসব জানারই কথা৷ এর মধ্যে কোনও নতুনত্ব নেই৷ কিন্তু জেনে তিনি এর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? শাস্তি দিয়েছেন কাউকে? দল থেকে বহিষ্কার করেছেন? রাজ্যের জনগণকে কি বলেছেন, দুর্নীতিগ্রস্তদের ধরে পুলিশে খবর দেওয়ার জন্য? না, মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী এসব কিছুই করেননি বা বলেননি৷ তা হলে তাঁর এই উচ্চারণের দ্বারা পরিস্থিতির কী বদল ঘটল? জনগণের কী লাভ হল? তিনি কি মনে করেন, এর দ্বারা দলের মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং তোলাবাজরা সংযত হবে?

মানুষের এতদিনের অভিজ্ঞতা মুখ্যমন্ত্রী নিজেও এ কথা বিশ্বাস করেন না৷ এ হল, সুন্দরবনে দাঁড়িয়ে বাঘকে মাংস খেতে নিষেধ করার সামিল৷ তা হলে মুখ্যমন্ত্রী বললেন কেন এ কথা?

সামনে নির্বাচন৷ দলের নেতাদের দুর্নীতি নিয়ে মানুষের ব্যাপক ক্ষোভের কথা আজ আর চাপা নেই৷ তা হলে উপায় কী? সত্যিই তো আর নেতাদের বহিষ্কার করা কিংবা শাস্তি দেওয়া যায় না৷ তা হলে তো গাঁ উজাড় হয়ে যাবে৷ তা ছাড়া, শাস্তি দেওয়ার সদিচ্ছাও কি সরকারের প্রধান হিসাবে তাঁর সত্যিই আছে? শুরু থেকেই কংগ্রেসের দুর্নীতির ট্র্যাডিশন নিয়েই চলেছে তৃণমূল৷ তার থেকে বেরনোর চেষ্টা করেনি, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে৷ এমনকী যখন সিপিএম থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা–কর্মীরা বানের জলের মতো তৃণমূলে ঢুকছিল, তখন মুখ্যমন্ত্রী তাদের উচ্চাসন দিয়ে ‘সম্মানিত’ করেছেন, তাদের ভোটের বাজারের দামটাকেই বিচার করেছেন৷ তিনি মনেই করেন, ক্ষমতায় থাকতে গেলে একটু–আধটু এ–সব হবে৷ সেই একটু–আধটু যে আজ মহীরুহ হয়ে উঠেছে তা তিনিও জানেন, রাজ্যের মানুষেরও অজানা নয়৷ অথচ একদিন সিপিএমের এমন দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েই ক্ষমতায় বসেছিলেন তিনি৷

‘আমি সব জানি’ বলার দ্বারা মুখ্যমন্ত্রী জনগণকে স্তোক দিতে চেয়েছেন, বিষয়টাকে গুরুত্বহীন করতে চেয়েছেন৷ যেন তিনি যখন জেনেছেন তখন ব্যবস্থা একটা হবেই৷ তাঁর দলের বিপুল খরচ, নেতাদের রাজকীয় বিলাসবহুল জীবনযাপনে খরচ যে নিছক জনগণের থেকে চাঁদা তুলে হয় না, তা মানুষের জানা আছে৷ তা হলে তা কোথা থেকে আসে?  এই অর্থ আসে মূলত অসাধু পথে৷ বৃহৎ ব্যবসাদার, আড়তদার, কন্ট্রাক্টর, প্রমোটার, কালোবাজারি, মজুতদার, সিন্ডিকেট, জমির কারবারি, স্কুল–কলেজে ভর্তির দালাল, এমনকী নারী পাচারকারীদের থেকেও টাকার ভাগ পান শাসক দলের নেতারা৷ এ ছাড়াও রয়েছে সরকারি প্রকল্পে বরাদ্দ টাকার অবাধ লুঠ৷ এলাকায় এলাকায় সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, কোনও কিছু করতে গেলেই শাসক দলের নেতাদের টাকা দিতে হবে৷ এ ভাবে আদায়ের একটা অংশ ভোগ করে সংশ্লিষ্ট নেতারা, আর একটা অংশ যায় দলের ফান্ডে৷ সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে, কিছুদিন আগে দলীয় নেতাদের এক সভায় মুখ্যমন্ত্রী হাওড়ার এক নেতাকে নাম ধরে বলেছিলেন, ‘তোমাকে টাকা না দিলে নাকি হাওড়ায় কেউ বাড়ি করতে পারে না৷’

সব কিছু জানা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী এত বছর ধরে এসব অবাধে চলতে দিয়েছেন৷ আজও এমন বিশেষ কিছু ঘটেনি যা থেকে মনে হতে পারে তিনি এ–সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন৷ অর্থাৎ, এই অবাধ লুঠতরাজ যেমন চলছিল, তেমনই চলবে আর তার মারাত্মক ফল ভোগ করতে হবে রাজ্যের গরিব নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত জনগণকে৷ আর ধনীরা তো নেতাদের এই দুর্নীতির সুফল ভোগ করছে, শুধুমাত্র টাকার বিনিময়ে এই নেতারা তাদের বেআইনি এবং অন্যায় লুঠতরাজের সুব্যবস্থা করে দিচ্ছে৷ আর, সরকারি বরাদ্দ, প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ৷ হতদরিদ্র বিধবা তাঁর ভাতার পুরো টাকা পাচ্ছেন না৷ দরিদ্র মানুষ গৃহনির্মাণের পুরো টাকা পাচ্ছেন না৷ কন্ট্রাক্টর ঘুষ দিয়ে ব্রিজ, রাস্তা নির্মাণ করছে, যা নির্মাণের সাথে সাথেই ভেঙে পড়ছে৷ এমন করেই শাসক দলের দুর্নীতি, তোলাবাজির মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে৷ দলনেত্রী জেনেও এসব অন্যায় চলতে দিয়েছেন, এখনও দিচ্ছেন৷ তা হলে এই অন্যায়ের দায় থেকে তিনি নিজে রেহাই পেতে পারেন কি? তিনি তো কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেন৷ সেই রবীন্দ্রনাথ অন্যায় যিনি করেন, আর যিনি তা চলতে দেন, দুজনকেই ঘৃণার আগুনে দহন করতে বলেছেন৷ এই ঘৃণাই আজ রাজ্যবাসীর মনে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে৷

এ জিনিস নতুন নয়৷ রাজ্যে একের পর এক সরকার পাল্টেছে, কিন্তু লুঠপাট বন্ধ হয়নি৷ কারণ বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাটাই আজ পচে গেছে৷ দুর্নীতি আজ এই ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে৷ এর মেরামত তথা সংস্কারের কোনও উপায়ই নেই৷ এই দুর্নীতি কোনও নেতা বা নেত্রীর ইচ্ছা–নিচ্ছা কিংবা সদিচ্ছার বিষয়ই নয়৷ এটি একটি প্রক্রিয়ার ফল৷ এই যে দেশজুড়ে প্রতিটি বুর্জোয়া–পেটি বুর্জোয়া দল আজ দুর্নীতির সাগরে ডুবে রয়েছে, তা শুধুমাত্র তাদের দলের নেতারা চেয়েছে বলে নয়, যে প্রক্রিয়ায় এই দলগুলি চলে, এ তারই ফল৷ যে দল এই ব্যবস্থাকে টিকে থাকতে সাহায্য করবে, নানা মিষ্টি কথার ছলে এর গুণগান করবে, এই ব্যবস্থার মূল নিয়ামক চূড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত পুঁজিপতি শ্রেণির সেবা করবে সেই দল ও দলের নেতারা দুর্নীতিগ্রস্ত হতে বাধ্য৷ তাই এই ব্যবস্থার সেবাদাস প্রতিটি দল কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূল, সিপিএম সহ জাতীয় এবং আঞ্চলিক দলগুলি আজ দুর্নীতির পাঁকে ডুবে রয়েছে এবং জনগণের অশেষ দুর্গতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ দুর্নীতিকে নির্মূল করতে হলে এই শোষণমূলক সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত নতুন সমাজ গড়তে হবে৷ তার জন্য প্রয়োজন এক দিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত গণআন্দোলন, অন্য দিকে সমাজ বদলানোর লড়াই গড়ে তোলা৷ এই দুই আন্দোলন যে উচ্চ সংস্কৃতির জন্ম দেবে সেটাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করবে৷

(৭১ বর্ষ ১৫ সংখ্যা ২৩ – ২৯ নভেম্বর, ২০১৮)