আসামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস (এনআরসি)–এর প্রথম খসড়া প্রকাশিত হয় ২০১৭–র ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাত্রে৷ এনআরসি–তে নাম নথিভুক্ত করার জন্য ৩ কোটি ২৯ লক্ষ আবেদনপত্র জমা পড়েছিল৷ দেখা গেল এর মধ্যে ১ কোটি ৩৯ লক্ষ আবেদনকারীর নাম খসড়া তালিকায় নেই৷ যাঁদের নাম বাদ পড়েছে, তাঁদের অধিকাংশই ধর্মীয় ও ভাষাগত দিক থেকে সংখ্যালঘু৷ নাম বাদ পড়ায় জনমানসে ব্যাপক উদ্বেগ–আশঙ্কা দেখা দিলে কর্তৃপক্ষ বলেছিলেন, বাদ পড়া নামগুলি চূড়ান্ত খসড়ায় যুক্ত করা হবে৷ ২০১৮–র ৩০ জুলাই এনআরসি–র দ্বিতীয় তথা চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে ৪০ লক্ষ ৭ হাজার নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে৷ সামাজিক–রাজনৈতিক পটভূমি ও ঐতিহাসিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে এই সংখ্যাও অবিশ্বাস্য৷ এর আগেই এস ইউ সি আই (সি)–র কেন্দ্রীয় মুখপত্র প্রোলেটারিয়ান এরা–র ১৫ মার্চ ২০১৮ সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে, এনআরসি প্রকাশ করার পিছনে বুর্জোয়া শাসকদের সমর্থনপুষ্ট উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী–সাম্প্রদায়িক-বর্ণবাদী শক্তিগুলির মতলব হল ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু ভারতীয় জনগণকে ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া৷ দীর্ঘদিন ধরেই নানা রকমের উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী–সাম্প্রদায়িক শক্তি আসামে সক্রিয়৷ সেখানকার অ–অসমীয়া ভারতীয় নাগরিকদের বিরুদ্ধে অসমীয়াভাষী সাধারণ মানুষকে খেপিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে তারা প্রচার করে চলেছে যে, প্রথমোক্তরা অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে তুলবে, অসমীয়াভাষীদের হাত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নেবে, তাদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করবে এবং এইভাবে কার্যত তাদের গ্রাস করে ফেলবে৷ খেটে–খাওয়া সাধারণ অসমীয়াভাষী জনগণকে জাতিবাদ–উগ্র প্রাদেশিকতাবাদ– সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত চিন্তায় ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে ফেলার অপচেষ্টা ছাড়া এ আর কিছুই নয়৷ এনআরসি তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কায়েমি স্বার্থবাদীদের এই হীন প্রচারের অঙ্গ হিসাবেই৷ এনআরসি–র মাধ্যমে প্রকৃত ভারতীয়দের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত কার্যকর করতে গিয়ে ব্যাপক বেআইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, ন্যায়বিচারের সমস্ত নিয়মনীতি এবং সংবিধানের বিধিগুলি লঙঘন করা হয়েছে৷ আসাম ছাড়াও মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ ও মণিপুরের মতো উত্তর–পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে এই ধরনের উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী চিন্তাভাবনার যে প্রভাব রয়েছে, আসামে এনআরসি কার্যকরী হওয়ায় তা আরও শক্তিসঞ্চয় করছে৷ এস ইউ সি আই (সি) শুরু থেকেই এর পরিণতি সম্পর্কে যে সাবধানবাণী দিয়ে আসছিল এবং দলের ইংরেজি মুখপত্র প্রোলেটারিয়ান এরা–র পূর্বতন সংখ্যায় যা বলা হয়েছে, এনআরসি–র দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তী ঘটনাবলিতে তাই প্রমাণিত হচ্ছে৷ পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবে খুবই সংকটজনক এবং আসাম সহ গোটা দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এর বিরুদ্ধে না দাঁড়ালে এর পরিণাম হবে ভয়ঙ্কর৷
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ফিরে দেখা
কালানুক্রমিক ঘটনাবলির যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণ এবং কয়েকটি বিষয়, যেগুলি সম্পর্কে আমরা আগেই বলেছি, সেগুলির পুনরাবৃত্তি এই কৌশলী ষড়যন্ত্রের বীভৎস চেহারা ফাঁস করে দেবে৷ শুরুতেই বলা দরকার, উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী–সাম্প্রদায়িকবর্ণবাদী শক্তি তথা আরএসএস–বিজেপি–র বাড়বাড়ন্ত রাতারাতি ঘটেনি৷ এক সুনির্দিষ্ট দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তা ঘটেছে৷ ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত আসামকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল৷ ১৯০৬ সালে অবিভক্ত আসাম পূর্ব বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়৷ ১৯১২ সালে অবিভক্ত বাংলার গোয়ালপাড়া ও সিলেট জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে চিফ কমিশনারের প্রদেশ হিসাবে একে পুনর্গঠিত করা হয়৷ ১৯১৩ সালে একটি বিধান পরিষদ এবং ১৯৩৭ সালে আসাম বিধানসভা গঠিত হয়৷ সকলেই জানেন, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক, উভয় দিক থেকে উত্তর–পূর্ব ভারতে আসাম রাজ্যের একটি বিশেষ স্থান আছে৷ বহু ভাষা, ধর্ম, জনজাতির মানুষের বাসভূমি এই রাজ্যে কোনও অংশের মানুষই সংখ্যাগুরু ছিলেন না৷ হাজার বছর ধরে নিজস্ব রীতিনীতি পালনের মধ্য দিয়ে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে উঠেছে৷ স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন ও স্বাধীনতা–উত্তর পর্বে আশা করা গিয়েছিল, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যেকার ঐক্য এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চেতনা দৃঢ়তর হবে৷ কিন্তু তা হয়নি৷ কারণ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এমন একটা সময়ে শুরু হয়েছিল যখন চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল ও মুমূর্ষু হয়ে পড়ে বিশ্ব পুঁজিবাদ তার যাবতীয় প্রগতিশীলতা হারিয়ে ফেলেছে৷ রাজনীতিগত ভাবে গান্ধীজিকে সামনে রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বে থাকা ভারতের জাতীয় বুর্জোয়ারা সেই মুমূর্ষু বিশ্ব পুঁজিবাদেরই অঙ্গ ছিল এবং সেই কারণেই তারা প্রধানত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংস্কারবাদী–বিরোধীর ভূমিকা নিয়ে পিছিয়ে পড়া সামন্তী চিন্তাভাবনার সঙ্গে আপস করেছিল৷ তাই ভারতীয় জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি প্রাচীন সামন্তবাদী ধর্মান্ধতা, অজ্ঞানতা, জাত–পাতের বিভাজন ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার বদলে এগুলির সঙ্গে আপস করেছিল৷ কেন এমন ঘটেছিল? কারণ, প্রতিক্রিয়াশীল বিশ্ব পুঁজিবাদের অঙ্গ ভারতীয় বুর্জোয়ারা ব্রিটিশের হাত থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার সময় বিভিন্ন দেশে ঘটতে থাকা পুঁজিবাদবিরোধী সর্বহারা বিপ্লবের আশঙ্কায় ভীত ছিল৷ বিপ্লব আটকাতে তাদের প্রয়োজন ছিল, ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রের খেটে খাওয়া মানুষ যাঁরা সমস্ত ধরনের শোষণ–পীড়ন থেকে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিভেদ ঘটানো৷ জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ঐক্যে ভাঙন ধরিয়ে এক অংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায়ে এদেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষকে প্রতারণা করা যেত না৷ এ যুগের অগ্রগণ্য মার্কসবাদী চিন্তানায়ক এবং এস ইউ সি আই (সি)–র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষ বিজ্ঞানসম্মত যুক্তির ভিত্তিতে প্রজ্ঞাদীপ্ত বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন, ‘‘রাজনৈতিক ভাবে ভারত একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হলেও সংস্কৃতিগত দিক দিয়ে তা এখনও বিভক্ত রয়ে গেছে’’৷ ভারতের শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি আপসের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর মানুষের মধ্যে ধর্ম–জাতপাত–ভাষা– বিভাজনগুলিকে পরিকল্পিতভাবেই উস্কানি দিতে শুরু করল৷ তারা জানত, শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই যে জনগণের ক্রমবর্ধমান দুর্দশার আসল কারণ, এ কথা চোখের আড়াল করে রাখতে হলে জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে অসচেতন করে গড়ে তুলতে হবে যাতে তারা যুক্তিভিত্তিক চিন্তাভাবনা করতে সক্ষম না হয়, একে অপরের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করে এবং মাঝে মাঝেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে৷ শাসক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার নিজস্ব নিয়মেই যত বেশি করে সংকটে পড়ে, ততই সম্প্রদায়–জাতপাত– প্রাদেশিকতাবাদ ইত্যাদির ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভেদ বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা চালাতে থাকে, যার পরিণতিতে ব্যাপক সন্ত্রাস ও হত্যার ঘটনা ঘটে৷ যতদিন শোষিত নিপীড়িত মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে বিভেদ–সংঘর্ষে মত্ত হয়ে থাকবে, ততদিনই শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি সুরক্ষিত থাকবে৷ কারণ, ততদিনই তার বর্বর শাসনের বিরুদ্ধে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ গণভ্যুত্থান ঘটতে পারবে না৷ এই প্রেক্ষাপটেই আসামে তথাকথিত এনআরসি সৃষ্টির পিছনের উদ্দেশ্য বুঝতে হবে৷
কায়েমি স্বার্থ দীর্ঘদিন আগেই বিভেদের বীজ বুনেছিল
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিজের শাসন দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য দেশে ডিভাইড অ্যান্ড রুল (বিভেদ আনো, শাসন করো) নীতির আশ্রয় নিয়েছিল৷ এই জঘন্য নীতি রূপায়ণ করার জন্য তারা অসমীয়াভাষী ও অ–সমীয়াভাষী, হিন্দু ও মুসলমান, উপজাতি ও অ–উপজাতি মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধিয়ে আসামকে একটি সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগত সংঘর্ষপ্রবণ রাজ্যে পরিণত করে৷ স্বাধীনতার পর আসামের সমস্ত খেটে–খাওয়া মানুষ, সে তাঁরা অসমীয়া বা অ–সমীয়াভাষীই হোন, হিন্দু বা মুসলমান বা খ্রিস্টান হোন– দেখলেন, বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি থেকেও বঞ্চিত হয়ে তাঁরা যখন কার্যত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছেন, তখন সমস্ত সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে অল্পসংখ্যক ধনী ব্যক্তি৷ ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্ব, ন্যূনতম প্রয়োজনীয় শিক্ষা–স্বাস্থ্য–শৌচব্যবস্থা এবং পৌর সুযোগ–সুবিধার অভাব ইত্যাদি কারণে সাধারণ মানুষের দুর্দশা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে৷ ফলে, এই ব্যাপক প্রতারণা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাদের মনে ক্রমাগত ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে৷
জমে ওঠা এই ক্ষোভ সঠিক খাতে প্রবাহিত হয়ে সকল স্তরের নিপীড়িত মানুষকে একজোট করে যাতে সংগঠিত আন্দোলনে রূপ নিতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যে আসামের শাসক কংগ্রেসের তৎকালীন নেতারা রাস্তা খুঁজছিলেন৷ তাঁরা দেখলেন, উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী– সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা জাগিয়ে তুলে অসমীয়াভাষী মানুষের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র–দুর্দশার যাবতীয় দায় তথাকথিত ‘বহিরাগত’ ও ‘বেআইনি বসবাসকারী’–দের উপর চাপিয়ে দেওয়াই এক্ষেত্রে উৎকৃষ্টতম কৌশল৷ তাই, অন্যান্য উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী– সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির সঙ্গে একযোগে মিথ্যা প্রচার শুরু করে ধীরে ধীরে সেই প্রচারকে তুঙ্গে তুলে প্রথমে বাংলাভাষী হিন্দুদের বিরুদ্ধে এবং পরে বাংলাভাষী মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে ‘বেআইনি বসবাসকারী’ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে দাগিয়ে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে এক ধরনের জেহাদ শুরু করল তারা৷ এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে, ব্রিটিশ আমলে আসামে প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষ থেকে ‘বঙ্গাল খেদা’ নাম দিয়ে বাঙালিবিরোধী সেন্টিমেন্ট অবিরত খুঁচিয়ে তোলা হত৷ ফলে বাংলাভাষী মানুষকে আসাম থেকে তাড়াবার লক্ষ্যে তাদের উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণের ঘটনা ঘটত৷ স্বাধীনতার পর শাসক কংগ্রেস দেখল, বিদ্যমান এই উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী– সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার আবহাওয়া বজায় রাখতে পারলেই পুঁজিবাদী দমন–পীড়ন আড়াল করে রাখা যাবে এবং এর বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনগণ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না৷ ফলে তারা বিভাজনবাদী ধ্যানধারণাগুলিকে আরও জোরদার ভাবে প্রচার করতে শুরু করল এবং উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী– সাম্প্রদায়িক মানসিকতার বাহক কংগ্রেসের ভিতরকার একটি বড় অংশকে আসামের নিরপরাধ সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজে লাগাল৷
আসাম–জাতিবাদী মানসিকতা, ব্রিটিশ আমলে যার সূচনা, কংগ্রেস নেতারা পরবর্তীকালে তা তীব্রতর করে তুলেছিলেন৷ উগ্র জাতিবাদী আসাম আন্দোলনের ডানায় ভর করে ১৯৭৯ সালে সরকারি ক্ষমতা পুনর্দখলের লক্ষ্যে ‘আসাম শুধু অসমীয়াদের জন্য’ এবং ‘বিদেশিদের তাড়াও’ ইত্যাদি উত্তেজক স্লোগান তুলে গোটা রাজ্যে তারা তোলপাড় শুরু করেছিল৷ বাংলাভাষী সংখ্যালঘু মানুষকে সেইসময় সন্দেহ ও আক্রমণের লক্ষ্য বানানো হয়েছিল৷ পরিকল্পিত উপায়ে আসামের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মেহনতি মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস ও বিভেদের বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছিল৷ ১৯৭৯ থেকে ’৮৫ পর্যন্ত চলা আসাম আন্দোলনের হোতা অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন তথা ‘আসু’–র বহু নেতা ও কর্মী ছিলেন প্রাক্তন কংগ্রেসকর্মী৷ শাসক বুর্জোয়াদের হীন শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার তাগিদে গোটা আন্দোলনটির উদ্দেশ্য ছিল মানুষের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব বাধিয়ে দেওয়া৷
উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী ও কায়েমি স্বার্থবাদীদের দ্বারা
উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ইতিহাস বিকৃতির ষড়যন্ত্র
আরও এক ধাপ এগিয়ে, এই উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী– সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি আওয়াজ তুলেছিল যে, গোয়ালপাড়া ও ধুবড়ির মতো ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার জেলাগুলিতে বসবাসরত বাংলাভাষী মুসলমান ধর্মের মানুষরা সকলেই বাংলাদেশ থেকে আসা ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’, ফলে তারা ‘বিদেশি’৷ এ হল ইতিহাসের অপরাধমূলক বিকৃতি৷ আগেই বলা হয়েছে, বিশ শতকের প্রথম দিকে আসাম এবং অবিভক্ত বাংলা উভয়েই ছিল প্রশাসনিক ভাবে একই কমিশনারের শাসনের অধীনে৷ ফলে ব্রিটিশ আমলে উভয় অঞ্চলই একই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হত এবং একই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াত খুবই স্বাভাবিক বিষয় ছিল৷ দ্বিতীয়ত, দরিদ্র ভূমিহীন বাংলাভাষী মুসলমান চাষিরা চর এলাকার পতিত জমিগুলিকে উর্বর কৃষিজমিতে পরিণত করার কাজে দক্ষ ছিলেন৷ ফলে তৎকালীন অবিভক্ত গোয়ালপাড়া জেলার জমিদাররা নিজেদের মালিকানাধীন অকৃষিযোগ্য পতিত জমিগুলিতে বসবাস করার জন্য ময়মনসিংহ, রংপুর ও পাবনা জেলার এই সমস্ত পরিশ্রমী মুসলমান চাষিদের উৎসাহিত করত৷ ব্রিটিশ সরকারেরও এতে আপত্তি ছিল না, কারণ এর ফলে তাদের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেত৷ এই দরিদ্র চাষিরা যাতে স্থায়ীভাবে ওই এলাকায় বাস করে সেজন্য কোনও কোনও জমিদার এমনকী জিনিসপত্র দিয়েও তাদের সাহায্য করত৷ অর্থাৎ, সেই সময় অসমীয়াভাষী সাধারণ মানুষ অত্যন্ত সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতার সঙ্গেই এই মানুষগুলিকে স্বাগত জানিয়েছিল৷ এই কারণেই আসামের এই এলাকায় এখনও বিরাট সংখ্যক বাংলাভাষী মুসলমান মানুষ বাস করেন যাঁদের অধিকাংশ চাষের কাজে নিযুক্ত৷ ফলে, এটা কোনও অন্তঃপ্রবাহ ছিল না, ছিল দেশের এক অংশের মানুষের অন্য অংশে স্বাভাবিক স্থানান্তরণ, যা অসমীয়াভাষী মানুষের সঙ্গে সঙ্গে অ–সমীয়াভাষী সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই সেই সময় সাহায্য করেছে৷
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে নিম্ন আসামের বাংলাভাষী মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত করেন৷ কিন্তু বাংলাভাষী মুসলমানদের বড় অংশ, যাঁদের কাছে ভারতবর্ষই ছিল মাতৃভূমি, তাঁরা এদেশেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷ ভারত স্বাধীন হওয়ার পর নিম্ন আসামের মুসলমান জনগণ কংগ্রেসের সঙ্গে থাকার শপথ নেওয়ার পাশাপাশি তীব্র চাপের কাছে নতি স্বীকার করে অসমীয়া ভাষাকেই মাতৃভাষা বলে স্বীকার করে নেন৷ এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ আজকের আসাম–জাতিবাদের প্রবক্তারা দাবি করছে, এই ভারতীয়দের উত্তরপুরুষরা, যাঁরা এদেশে জন্মেছেন, বড় হয়েছেন এবং যাঁরা এদেশেরই দরিদ্রতম মানুষের একটি অংশ, তাঁরা বাংলাদেশ থেকে আসা ‘বিদেশি’ এবং সেই কারণেই তাঁদের তাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন এই দাবির পিছনে সামান্যতম যুক্তিও আছে কি?
এই উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী শক্তিগুলি আরও একটি মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, যা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি৷ চরম মিথ্যাচার করে এরা বলছে, ‘বিদেশিদের নীরব আগ্রাসন’–এর পরিণতিতে অসমীয়াভাষী মানুষ ভেসে যাবে, সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে, রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে ‘নিজভূমে পরবাসী’ হয়ে পড়বে৷ এখানেই শেষ নয়, আরও এক পা এগিয়ে তারা এ–ও প্রচার করে যে, আগামী দিনে বাংলাদেশ আসামকে দখল করে নেবে৷ এসবই হল অসমীয়াভাষী নিপীড়িত সাধারণ মানুষকে বোকা বানানোর চটকদার স্লোগান৷ এর দ্বারা কৌশলে যে ঐতিহাসিক সত্য তারা চাপা দিতে চাইছে তা হল দু’শো বছরের গদ্য–সাহিত্য সমৃদ্ধ অসমীয়া ভাষা অত্যন্ত দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত৷ ১৯৩১–এর জনগণনা রিপোর্ট দেখিয়েছিল, সেইসময় আসামের ৩১.৭ শতাংশ মানুষ ছিলেন অসমীয়াভাষী৷ সংখ্যার বিচারে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও অবাধে অসমীয়া ভাষা প্রসার লাভ করেছিল৷ দ্বিতীয়ত, ইতিহাসে এমন কোনও উদাহরণ নেই যেখানে দেখা যায় এক অংশের দরিদ্র মানুষ অপর অংশের দরিদ্র মানুষের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার হরণ করেছে বা তার ক্ষতি করেছে৷ শুধুমাত্র নিপীড়নকারীরাই নিজেদের শোষণমূলক শ্রেণি শাসন বজায় রাখার স্বার্থে জনগণের সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অধিকারগুলিকে বিপন্ন করে তোলে৷ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তাদের শত্রু শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে একে অপরের ভাষাকে সমৃদ্ধ করে তোলে এবং পারস্পরিক দেওয়া–নেওয়ার মধ্য দিয়ে একে অপরের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়৷
আসাম আন্দোলন এবং ‘বিদেশিদের বেআইনি অনুপ্রবেশ’–এর জুজু
১৯৭৯ সালে মঙ্গলদৈ বিধানসভা উপনির্বাচন হওয়ার মুখে, সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী– সাম্প্রদায়িক-বর্ণবাদী অপশক্তি এবং কংগ্রেস সহ সমস্ত বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলির মদতপুষ্ট ‘আসু’ ও তার দলবল এই বলে হইচই বাধাল যে, ওই বিধানসভার নির্বাচক তালিকায় ৪৭ হাজারের উপর বিদেশির নাম রয়েছে এবং উপনির্বাচন শুরু হওয়ার আগে সেই নামগুলি তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে৷ তাদের শান্ত করতে কিছু নাম তালিকা থেকে সরাসরি বাদ দেওয়া হলেও আসু–কে শান্ত করা যায়নি৷ আসলে, আসাম আন্দোলন শুরু করার জন্য তাদের একটা অজুহাতের প্রয়োজন ছিল এবং ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘বিদেশি’–দের বিতাড়নের দাবিকেই সেই অজুহাত হিসাবে তারা ব্যবহার করতে চেয়েছিল৷ ফ্যাসিস্ট হিটলারের কুখ্যাত প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলস একবার বলেছিলেন যে, কোনও মিথ্যা বারবার বলে যেতে থাকলে একসময় মানুষ তা সত্য বলে বিশ্বাস করে নেয়৷ আসামেও একই ঘটনা ঘটেছে৷ শ্বাসরোধকারী জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তির দিশা না পেয়ে দরিদ্র হতভাগ্য অসমীয়াভাষী মানুষ এই উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচারে ভেসে গিয়ে আসাম আন্দোলনে সামিল হয়ে যান৷ তাঁদের আরও তাতিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী–সাম্প্রদায়িক-বর্ণবাদী নেতৃত্ব প্রচার তুলল যে, প্রতিদিন হাজার হাজার বাংলাদেশি মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে আসামে প্রবেশ করছে এবং ইতিমধ্যে ৭০ লক্ষেরও বেশি বাংলাদেশি বেআইনিভাবে আসামে অনুপ্রবেশ করেছে৷ সেইসময় সংবাদপত্রেও এই সমস্ত পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছিল৷ উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে নেলি, মুকালমোয়া, চালখোয়া, সিলাপাথার, দরং, লখিমপুর, কামরূপ, গোয়ালপাড়া ও বরপেটাতে একের পর এক ভয়ঙ্কর গণহত্যাঘটতে থাকে এবং বহু নিরীহ মানুষের প্রাণ যায়৷ সেই সময়ে আসু অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলিকেও আক্রমণের লক্ষ্য করেছিল৷ কিন্তু বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলি তো বটেই, এমনকী সিপিআই(এম), সিপিআই–এর মতো স্বঘোষিত মার্কসবাদী দলগুলিও এই উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী–সংকীর্ণতাবাদী অপশক্তিগুলির দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেছিল৷ যথার্থ প্রেক্ষাপটে সেই কঠিন পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলার যে আশঙ্কা সাধারণ অসমীয়াভাষী মানুষের মনে বদ্ধমূল হয়ে ছিল, তা অনুভব করতে সক্ষম হয়েছিল একমাত্র এস ইউ সি আই (সি)৷ অত্যন্ত সংবেদনশীল এই বিষয়টির গুরুত্ব অনুভব করে এ সংক্রান্ত বিতর্কের যথার্থ সমাধানের জন্য আমাদের দল নিম্নলিখিত চার–দফা সূত্র পেশ করেছিল :
(১) ভাষাগত সংখ্যালঘুদের যে অধিকার সংবিধানে রয়েছে তা অক্ষুণ্ণ রেখে যেকোনও মূল্যে অসমীয়া ভাষাকে আসামের রাষ্ট্রীয় ভাষা বা সরকারি ভাষা হিসাবে স্থায়ীভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং রাজ্যের জনবসতির গঠন পরিবর্তিত হলেও কোনও ভাবেই এই অবস্থানের পরিবর্তন ঘটানো যাবে না৷ রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে অসমীয়া ভাষার বর্তমান অবস্থানকে নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে অথবা সংসদে আইন পাশ করাতে হবে৷
(২) একজন বিদেশিও যাতে গোপনে বা বেআইনিভাবে অনুপ্রবেশ করতে না পারে তার জন্য সুনিশ্চিত ব্যবস্থাবলি গ্রহণ করতে হবে৷ গোপন অনুপ্রবেশকারীদের সীমান্তেই ধরে ফেলে সুবিচারের জন্য যাতে তাদের ট্রাইব্যুনালে পাঠানো যায়, তার জন্য গোয়েন্দা দপ্তরকে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে৷
(৩) আসামে শিল্প ও অর্থনীতির দ্রুত বিকাশ ঘটানোর জন্য সরকারকে সর্বব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে৷
(৪) ‘বিদেশি নাগরিক’–দের চিহ্ণিতকরণের জন্য ১৯৭১–এর ২৫ মার্চ তারিখটিকে ‘কাট–অফ’ তারিখ তথা ভিত্তিবর্ষ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে৷ সমস্ত স্বীকৃত ও প্রাসঙ্গিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিয়ম, আইন ও রীতিনীতি মেনে চিহ্ণিতকরণের প্রক্রিয়াটি চালাতে হবে৷ এক্ষেত্রে সংবিধানের নির্দেশিকাগুলিকে সম্পূর্ণ মর্যাদা ও মান্যতা দিতে হবে৷ পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশভাগের কারণে জওহরলাল নেহরু সহ অন্য জাতীয় নেতৃবৃন্দের দেওয়া প্রতিশ্রুতি– পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর যদি ধর্মীয় নিপীড়ন ঘটে, তাহলে তাদের জন্য ভারতের দরজা খোলা থাকবে– তা রক্ষা করতে হবে৷ উক্ত ‘কাট–অফ’ তারিখের আগে যাঁরা এদেশে এসেছেন, তাঁদের প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক হিসাবে গণ্য করতে হবে৷ বাকিদের নির্বাসিত করার ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন–কানুন এবং রীতিনীতি মেনে চলতে হবে৷
বহু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অসমীয়াভাষী মানুষ কর্তৃক এই চার–দফা সূত্রটি এতটাই প্রশংসিত হয়েছিল যে বেশ কয়েকটি প্রথম সারির অসমীয়া সংবাদপত্র তাদের প্রথম পাতায় এটি ছেপেছিল৷ কিন্তু আসাম আন্দোলনের হোতা উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী–সাম্প্রদায়িক-বর্ণবাদী উন্মত্ত শক্তিগুলি সহ বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলি যারা মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব–বিভেদ জিইয়ে রাখতে চায়, তারা এই চার–দফা সূত্রটির দিকে ফিরে তাকায়নি৷ অথচ এই চার–দফা সূত্রটির মধ্যেই রয়েছে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে যুক্তিসঙ্গত ন্যায়বিচারের কথা৷
আসাম চুক্তি
পরবর্তীকালে ১৯৮৫ সালে কংগ্রেস সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী বিতর্কিত বিষয়গুলি নিয়ে কথা বলতে আসু নেতাদের আলোচনার টেবিলে আমন্ত্রণ জানান৷ এই আলোচনাতেই স্বাক্ষরিত হয় বহু সোরগোল তোলা আসাম চুক্তি৷ এই চুক্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার আসু নেতাদের উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী দাবির কাছে কার্যত আত্মসমর্পণ করে৷ বিশাল জনগোষ্ঠীকে ‘বিদেশি’ হিসাবে চিহ্ণিতকরণের লক্ষ্যে ভিত্তিবর্ষ ১৯৭১–এর বদলে ১৯৬৬ করে দেওয়া হয়৷ সঙ্গে সঙ্গে এই তথাকথিত চিহ্ণিত ‘বিদেশি’দের নাম ভোটার লিস্ট থেকে বাদ দেওয়া এবং তাদের বহিষ্কারের জন্য তারা উঠে পড়ে লাগে৷ আমাদের চার দফা সূত্রের কোনও বিষয়কেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি৷ এমনকী অসমীয়াভাষী জনগণের মধ্য থেকে তাঁদের মাতৃভাষা নিয়ে তৈরি হওয়া উদ্বেগ ও ভয় কাটানোর চেষ্টাও করা হয়নি৷ একই সাথে আসাম রাজ্যের শিল্পোন্নয়ন ও লাভজনক কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আমাদের দলের পক্ষ থেকে পেশ করা হয়েছিল, রাজ্যের মানুষও যার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, তা গ্রহণ করা হল না৷ তারপর প্রায় ৩৩ বছর কেটে গেছে কিন্তু সমস্যা সমাধানে এবং জাতি–ধর্ম–বর্ণ–সম্প্রদায়-ভাষা নির্বিশেষে সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব রক্ষার্থে কিছুই করা হয়নি৷ যার ফলে জনবিরোধী শক্তিগুলির চক্রান্তে জটিল পরিস্থিতি জটিলতর হয়েছে৷
যে ভাবে হোক বিদেশি তকমা দেওয়ার পরিকল্পনা
উল্লেখযোগ্য, আসাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরেই এই আন্দোলনের উগ্রপ্রাদেশিকতাবাদী– সাম্প্রদায়িক নেতারা আসাম গণপরিষদ (অগপ) নামে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করে ফেললেন৷ ১৯৮৫ সালের নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তারা সরকার গঠনও করে ফেলল৷ বলার অপেক্ষা রাখে না, আরও বেশি বেশি করে প্রাদেশিক–সাম্প্রদায় এবং ভাষাগত সেন্টিমেন্টকে বাড়িয়ে তোলাই ছিল তাদের একমাত্র কর্মসূচি৷ তাই যে ভাবেই হোক না কেন লক্ষ লক্ষ ‘বিদেশি’কে ‘চিহ্ণিত’ করার কথাই তারা বছরের পর বছর আউড়ে গেছে৷ সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের প্রায় পুরো শক্তি নিয়োজিত হয়েছে এই অপ্রয়োজনীয় কার্যসূচির পিছনে৷ জনসাধারণের আর্থিক–সামাজিক পরিস্থিতির যথার্থ উন্নতির জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মতো প্রকৃত প্রয়োজনীয় বিষয় থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতেই এই কাজ করা হয়েছে৷ এমনকী ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু মূলত গরিব হতদরিদ্র প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের বিরুদ্ধে ‘বিদেশি’ অভিযোগ আনার কোটা দেওয়া হয়েছিল পুলিশকে৷ ‘ফরেনারস ট্রাইবুন্যালে’র মাধ্যমে তাদের নরকতুল্য ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানোর হিড়িক পড়ে গিয়েছিল৷ এভাবেই গণতন্ত্র ও দেশের সংবিধানকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছিল৷ তখন থেকেই এই রাজ্য সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় পূর্ণ হয়ে আছে, যার সবচেয়ে বড় শিকার বাংলাভাষী হিন্দু ও মুসলমান সংখ্যালঘুরা৷ প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক হওয়ার কারণে জীবন ও জীবিকার সম্পূর্ণ সুরক্ষার অধিকার থাকা সত্ত্বেও মুসলমান সংখ্যালঘুরাই বিশেষ করে আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিলেন৷ অসৎ উদ্দেশ্য থেকে, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে তাঁদের ‘বাংলাদেশি’ কিংবা ‘অনুপ্রবেশকারী’ অথবা ‘বেআইনি দখলদার’ হিসাবে দাগিয়ে দিয়ে তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে, হেনস্তা করা হয়েছে, গায়ের জোরে উচ্ছেদ করা হয়েছে, এমনকী জাতিগতভাবে তাঁদের নির্মূল করার লক্ষ্যে হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে৷ আরএসএস–বিজেপি তাদের উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক–মৌলবাদী কর্মসূচি অনুসরণ করে তখনকার মতোই এখনও সমানে মুসলমান সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিষ উগরে চলেছে এবং সংকীর্ণতাবাদী–প্রাদেশিকতাবাদী শক্তিগুলিকে উত্তেজিত করে চলেছে যাতে তারা ধর্ম ও ভাষাগত ভাবে সংখ্যালঘু মানুষ, যাঁদের অধিকাংশই হতদরিদ্র, তাঁদের উপর হামলা ও সন্ত্রাস চালায়৷
কিন্তু সর্বশক্তি নিয়োগ করা সত্ত্বেও অগপ সরকার মাত্র ৮ হাজারের মতো মানুষকে ‘বিদেশি’ বলে চিহ্ণিত করতে পেরেছিল৷ তাই তারা অন্য পথ ধরল৷ ভোটার তালিকা খতিয়ে দেখার অজুহাতে তারা সাধারণ মানুষকে, যাঁদের বেশিরভাগই ধর্মের দিক থেকে সংখ্যালঘু, তাঁদের প্রমাণপত্র দেখিয়ে নিজেদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে নির্দেশ দেওয়া হল৷ অনেকদিন ধরে নানা কষ্ট, অসুবিধা ও হয়রানিতে নাকাল হয়ে এই দুঃখী মানুষগুলি কর্তৃপক্ষের কাছে বৈধ প্রমাণপত্র জমা দিল৷ কিন্তু সরকারি আধিকারিকরা নানা অজুহাত তুলে প্রমাণপত্রগুলিকে বৈধ বলে স্বীকার করতে রাজি হল না৷ স্পষ্টতই ‘উপর মহল’–এর নির্দেশে তাঁদের এই আচরণ৷ তালিকা খতিয়ে দেখার একই ধরনের কাজ চার এমনকী পাঁচবারও চালানো হল৷ তা সত্ত্বেও তারা ‘লক্ষ লক্ষ বিদেশি নাগরিক’–এর হদিশ পেল না, কারণ পুরো বিষয়টিই ছিল শাসক দলের বাস্তবতাবর্জিত একটি দুরভিসন্ধি৷
১৯৯১ সালে অগপ–কে পরাজিত করে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে আসে৷ অসমীয়াভাষী এলাকাগুলিতে ভোটব্যাঙ্ক পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কংগ্রেস নেতৃত্বও ধর্ম ও ভাষাগত সংখ্যালঘু প্রকৃত ভারতীয়দের হয়রানি করার মধ্য দিয়ে দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রাখার সেই পুরনো নীতিই অনুসরণ করতে থাকে৷ উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী–সাম্প্রদায়িক-বর্ণবাদী অপশক্তিগুলিকে সন্তুষ্ট রাখতে ও গোপনে তাদের সাথে যোগাযোগ রেখে চলতে তাদের সামান্য বিবেকদংশনও হয়নি৷ এই ঘটনা আরও একবার দেখিয়ে দিল যে, উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী– সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা জাগিয়ে তোলাটা ছিল আসলে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি ও তার সেবাদাস রাজনৈতিক দলগুলির এক সুগভীর চক্রান্ত৷ অতএব, জাতীয় বা আঞ্চলিক সমস্ত বুর্জোয়া দলগুলি, অর্থ ও ক্ষমতার লালসায় এই ষড়যন্ত্রই যেন তেন প্রকারেণ কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিল৷ ১৯৯৬ সালে সামান্য মার্জিনে জিতে অগপ দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসে এবং সিপিআই–কে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করে৷ সিপিআই(এম) সেই সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করে৷ এই ঘটনা আরও একবার প্রমাণ করে যে, এস ইউ সি আই (সি) ছাড়া অন্য সমস্ত রাজনৈতিক দল, এমনকী ছদ্ম–মার্কসবাদীরা পর্যন্ত আসলে একই নৌকার যাত্রী৷ কারণ তাদের সকলেরই একমাত্র লক্ষ্য নির্বাচনে সুবিধা লাভ করা এবং তার জন্য সাম্প্রদায়িক–উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী অপশক্তিগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করতেও তাদের আপত্তি নেই৷ অগপ ক্ষমতায় বসার সঙ্গে সঙ্গেই কাল্পনিক ‘বিদেশি’ বিতাড়নের কর্মযজ্ঞ আগের চেয়ে আরও জোরদার ভাবে শুরু হয়ে গেল৷ প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে তারা ধর্মীয় ও ভাষাগত ভাবে সংখ্যালঘু প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের নাম ‘ডি ভোটার’, অর্থাৎ ডাউটফুল বা সন্দেহজনক ভোটার হিসাবে ইচ্ছামতো চিহ্ণিত করতে শুরু করল৷ এই কাজ করতে গিয়ে তারা কোনও আইনসঙ্গত পদ্ধতি বা বৈধতার ধারও ধারল না৷ সেই সময়ে বলা হয়েছিল, ছয় মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ যাচাই করে তাঁদের ডি ভোটারের তকমা থেকে মুক্ত করে দেওয়া হবে৷ ২০ বছর পার হয়ে গেছে, অথচ কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই ডি ভোটাররা এখনও সন্দেহের হাত থেকে রেহাই পাননি৷ ফলে, বহু ভারতীয় নাগরিক ও তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম, জন্মসূত্রেই যাঁদের ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা, তাঁরা ডি ভোটার হিসাবে চিহ্ণিত হয়ে ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে বেঁচে রয়েছেন৷ এরকম ডি ভোটারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজার৷ বুঝতে পারা গিয়েছিল যে, এই ডি ভোটাররা ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য আবেদন করার যোগ্য বলে বিবেচিত হলেও ওই তালিকায় তাঁদের নাম তোলা হবে না, যতক্ষণ না তাঁরা তথাকথিত ‘ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল’ কর্তৃক যোগ্য বলে বিবেচিত হন৷ (পরবর্তী সংখ্যায়)
(৭১ বর্ষ ১৩ সংখ্যা ৯ – ১৫ নভেম্বর, ২০১৮)