আসামে এনআরসি–র নাম করে ৪০ লক্ষ মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)–এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ ৩১ জুলাই এক বিবৃতিতে বলেন :
আসামের ৪০ লক্ষেরও বেশি প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক, যাঁদের অধিকাংশই ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু, তাঁদের নাম ৩০ জুলাই প্রকাশিত জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি)–র চূড়ান্ত খসড়া থেকে বাদ পড়ার সংবাদে আমরা গভীর ভাবে মর্মাহত৷ এর আগে ১৯৮৫ সাল থেকে যতগুলি সমীক্ষা ও তদন্তের কাজ হয়েছে, এমনকী পূর্বেকার খোদ এজিপি নেতৃত্বাধীন আসাম সরকার যে সমীক্ষা করিয়েছে, সেগুলির সঙ্গে এবারের ব্যাপক সংখ্যক নাম বাদ দিয়ে তৈরি খসড়ার কোনও মিলই নেই৷ এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা দরকার, ১৯৮৫ সালের এবং তৎপরবর্তী সমীক্ষা ও তদন্তগুলি যদিও জাতিগত, ধর্ম ও ভাষাগত বিদ্বেষ থেকে আদৌ মুক্ত ছিল না এবং সেগুলিতেও ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে খেয়ালখুশি মাফিক একটি বড় অংশের প্রকৃত নাগরিককে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ডি–ভোটার হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তথাপি পূর্বেকার সব সমীক্ষাতেই ডি–ভোটারের সংখ্যা কখনও ৩ লক্ষ ৭০ হাজার ছাড়ায়নি৷ এই প্রেক্ষাপটে ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষের নাম বাদ পড়ার ঘটনা শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, ষড়যন্ত্রমূলক৷ ইতিপূর্বেই আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম যে, এই ধরনের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে জাতিবাদী ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনাই কাজ করবে৷ খসড়া তালিকা আমাদের সেই আশঙ্কাকেই সত্য প্রমাণ করল৷
সরকার ভান দেখিয়েছে, অবৈধ অভিবাসী বা অনুপ্রবেশকারীদের ‘বিদেশি’ হিসেবে চিহ্ণিত করার জন্য সরকার এক বিশাল কর্মকাণ্ডের আয়োজন করেছে৷ বাস্তবে তা নয়৷ বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির পরিকল্পনাই ছিল– এ দেশে নাগরিক হিসাবে বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক মানুষকে গায়ের জোরে, কলমের এক খোঁচায় ‘ভারতে অনভিপ্রেত’ বলে চিহ্ণিত করে দেওয়া৷ জাতিগত–সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে ও সম্ভাব্য সমস্ত রকম উপায়ে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে হীন বুর্জোয়া শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করার লক্ষ্যেই অত্যন্ত তৎপরতার সাথে তারা এ কাজ করল৷ একটি দেশের সরকার আইনগত বৈধতার প্রশ্ন তুলে নিজের দেশের নাগরিকদেরই নাগরিকত্ব কেড়ে নিচ্ছে– এ হেন ফ্যাসিবাদী কাজ ভারতের অন্য কোনও রাজ্যে বা পৃথিবীর আর কোথাও ঘটতে দেখা যায়নি৷ নাগরিকত্ব হারানো রাষ্ট্রহীন খেটে–খাওয়া এত মানুষকে এইভাবে বাসভূমি থেকে গায়ের জোরে উৎখাত করে দিলে তাদের জীবন যে ধ্বংস হয়ে যাবে– মানবিকতার সেই ভয়ঙ্কর সঙ্কট সম্পর্কেও বিজেপি সরকারের বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই৷ বিশেষভাবে চিহ্ণিত নাগরিকদের একটি অংশের মৌলিক অধিকার ষড়যন্ত্র করে ছিনিয়ে নেওয়ার ফ্যাসিবাদী মতলব নিয়ে যে সরকার ও প্রশাসন পরিচালিত হয়, একমাত্র তারাই এ ধরনের চূড়ান্ত অমানবিক কাজ করতে পারে৷ সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা চূড়ান্ত দরিদ্র ও অসহায় জনগণকে সম্পূর্ণ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার লক্ষ্যে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এবং উগ্র জাতিবাদী শক্তিগুলি সম্মিলিতভাবে আসামে এনআরসি তৈরির কাজে নেমেছে৷ এর দ্বারা তারা বাস্তবে ধর্ম–বর্ণ–ভাষা নির্বিশেষে আসামের সর্বস্তরের মেহনতি মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকেই আটকাবার অপচেষ্টা চালাচ্ছে৷
আসামের সাম্প্রদায়িক ও উগ্র জাতিবাদী শক্তিগুলির স্বার্থে তৈরি এই ফ্যাসিবাদী পরিকল্পনার আমরা তীব্র নিন্দা করছি এবং বিশেষ মতলব থেকে বাদ দেওয়া সমস্ত প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকের নাম অবিলম্বে এনআরসি–র খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি৷ বিজেপি সরকারকে এই হীন ষড়যন্ত্র পরিত্যাগ করতে বাধ্য করার জন্য লাগাতার ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে আসাম সহ গোটা দেশের শুভবুদ্ধি ও গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন মানুষকে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি৷
(৭১ বর্ষ ২ সংখ্যা ১০ আগস্ট, ২০১৮)