Breaking News

প্রবল দুর্যোগ অগ্রাহ্য করে সংগ্রামী মানুষের ঢল ৫ আগস্ট

৫ আগস্ট, বেলা ১২টা৷ চলছে মুষলধারায় বৃষ্টি৷ রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে জলের সাদা চাদর আর কালো আকাশের পটভূমিতে দৃপ্ত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে বিশাল লাল মঞ্চ৷ মঞ্চের একটি অংশ জুড়ে কমরেড শিবদাস ঘোষের উজ্জ্বল ছবি৷ মঞ্চের সামনে সারি দেওয়া অসংখ্য চেয়ার৷ কিন্তু সব চেয়ারই যে ফাঁকা তাহলে কি সমাবেশ হবে না তুমুল বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া শহর থেকে শূন্য মন নিয়ে ফিরে যাবে বহু কষ্ট সহ্য করে দীর্ঘ পথ পার হয়ে গোটা রাজ্য থেকে আসা হাজার হাজার মানুষ!

তা–ও কি হতে পারে এঁরা যে এসেছেন এদেশের একমাত্র সাম্যবাদী দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর ডাকে দলের প্রতিষ্ঠাতা–সাধারণ সম্পাদক এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ স্মরণদিবস উদযাপন করতে! এসেছেন রাজ্যের প্রান্ত–প্রত্যন্ত থেকে দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের ভাষণ থেকে লড়াইয়ের পথ খুঁজে নিতে৷ সুজলা–সুফলা–শস্যশ্যামলা এই সমৃদ্ধ দেশে সব কিছু থেকেও কেন তাঁদের কোনও কিছুই নেই, তা বুঝতে৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কি নিরস্ত করতে পারে এস ইউ সি আই (সি)–র লাগাতার সংগ্রামের রূপকার লড়াকু এই মানুষগুলোকে তাই ঘন্টা দুয়েক ঢালাও বর্ষণের পর বৃষ্টি একটু কমতেই যেই মাইকে অনুষ্ঠানের ঘোষণা শুরু হল, অমনি যেন ম্যাজিকের মতো ভরে গেল জল–থইথই সমাবেশস্থলের হাজার হাজার আসন৷ বসার জায়গা মেলেনি অনেকেরই৷ রাস্তার তিনটি লেন জুড়ে বিশাল সমাবেশস্থলের এপাশে–ওপাশে–মাঝে রেলিং দেওয়া ফুটপাথে তাই দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড়৷ এতক্ষণ ধরে কোনওক্রমে মাথাটুকু বাঁচিয়ে এঁরা অপেক্ষা করছিলেন এদিকে–ওদিকে গাছের তলায় কিংবা দোকানের ছাউনির নিচে৷

কলকাতায় দলের কেন্দ্রীয় অফিসে ৫ অাগস্ট মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড মানিক মুখার্জী

শুরু হল মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান৷ রক্ত ঝরানো আন্দোলনের পথে ব্রিটিশকে উচ্ছেদ করার পর নিজের দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণ–জুলুমে জেরবার হয়ে যাওয়া মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে যিনি জীবনের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেন, মুষ্টিমেয় সহযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে সুকঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে যিনি গড়ে তুলেছেন এদেশের একমাত্র সাম্যবাদী দল এস ইউ সি আই (সি), তাঁকে স্মরণ করে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করলেন কমরেড প্রভাস ঘোষ, মঞ্চে উপস্থিত পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড রণজিৎ ধর ও কমরেড অসিত ভট্টাচার্য এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড দেবপ্রসাদ সরকার সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ৷ শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করলেন নানা ফ্রন্ট, জেলা ও আঞ্চলিক স্তরের নেতারা৷ সভাপতি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক কমরেড সৌমেন বসু৷

মহান নেতার স্মরণে সঙ্গীতের পর শুরু হল দলের কিশোর বাহিনী ‘কমসোমল’–এর গার্ড অফ অনার প্রদর্শন৷ ভিজে যাওয়া সাদা ইউনিফর্ম আর জুতো পরেই অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে প্যারেড করল শোষণমুক্তির স্বপ্ন দেখা কিশোর–কিশোরীরা৷

বক্তব্য শুরু করলেন প্রধান বক্তা কমরেড প্রভাস ঘোষ৷ তোড় কমলেও তখনও চলেছে বৃষ্টি৷ জমে যাওয়া জলে পা ডুবিয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলির চোখেমুখে তখন গভীর অভিনিবেশ৷ জায়গা না মেলায় অনেকেই রাস্তার উপর প্লাস্টিক বিছিয়ে বসে পড়েছেন৷ মগ্ন হয়ে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, কোন স্বার্থ সিদ্ধি করতে শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির তাঁবেদার বিজেপি আসামে এনআরসি–র ধুয়ো তুলে লক্ষ লক্ষ মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে৷ কেন এই পথে গোটা দেশ জুড়ে ভ্রাতৃঘাতী হানাহানি বাধিয়ে দেওয়ার মতলব আঁটছে ভোটবাজ বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলি৷ কমরেড ঘোষ ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছেন, কীভাবে সমাজ পরিবর্তনের পথে সৃষ্টি হল সংসদীয় গণতন্ত্র৷ কেনই বা আজ আর তা মানুষের বিকাশ ঘটাতে পারে না৷ সেই কারণেই বছর বছর ভোট হয়, সরকার পাল্টায়, কিন্তু মানুষের জীবনের মৌলিক সমস্যাগুলি পাল্টায় না, বরং দিনে দিনে তা বাড়ে৷ সিপিএম–সিপিআই–এর উদ্দেশে বললেন, ভোটসর্বস্ব রাজনীতির কারণেই আজ আপনাদের এই পরিণতি৷ তাঁর আহ্বান, ভোট রাজনীতি ছেড়ে গণআন্দোলনের পথে আসুন৷ শ্রমিক–কৃষক–ছাত্র কর্মচারী–ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী– গভীর মনোযোগে শুনছেন সকলে৷ কে নেই সেই দলে তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ, শিশু–কোলে মা, গ্রামীণ মহিলা– রয়েছেন সকলে৷ সমাবেশে যোগ দিতে অনেকেই দু’দিন, তিন দিন ধরে বাড়ির বাইরে৷ খিদে মেটাতে ভরসা মুড়ি–চিঁড়ে৷ তার ওপর এই তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে সপসপে জামাকাপড়৷ কিন্তু পরোয়া নেই উপস্থিত মানুষগুলোর৷ জীবনে সমস্যার তাদের অভাব নেই, অভাব রয়েছে সমাধানের সঠিক দিশার৷ সেই দিশা খুঁজে পেতেই দূর–দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন তাঁরা৷ তাই বৃষ্টির কারণে আরও কিছুক্ষণ বলবেন কি না, কমরেড ঘোষ এ কথা জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা সমস্বরে উত্তর দিয়েছেন– আপনি আরও বলুন৷ সমাবেশস্থলের ডানদিকে ছিল মহান নেতার নানা উদ্ধৃতির সুসজ্জিত প্রদর্শনী৷ জল ঠেলে ঠেলে সেগুলি পড়েছেন মানুষ৷ জল জমে থাকা বুকস্টল থেকে সংগ্রহ করেছেন পার্টির নানা প্রকাশনা৷ মেডিকেল ক্যাম্পে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই অসুস্থ হয়ে পড়া মহিলা–পুরুষ–শিশু–কিশোরের চিকিৎসা করেছেন ডাক্তাররা, দিয়েছেন ওষুধপত্র৷ কমরেড প্রভাস  ঘোষের ভাষণ শেষ হলে ‘আন্তর্জাতিক’ সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে এ দিনের সমাবেশের সমাপ্তি হয়৷ আরও একবার প্রবল পথকষ্ট সহ্য করে এবার ঘরে ফেরার পালা৷ তবে এখন সঙ্গে রয়েছে দলের পথনির্দেশ– ‘আন্দোলন ছাড়া বাঁচার পথ নেই৷ আন্দোলনের লক্ষ্যে আপনারা এলাকায় এলাকায় গণকমিটি গড়ে তুলুন৷’ সেই নির্দেশ বুকে নিয়ে ভেজা শরীরে জল ঠেলে এগিয়ে চলল জনতা৷ মুখে তাদের মেঘভাঙা সূর্যের উজ্জ্বল আভা৷

(৭১ বর্ষ ২ সংখ্যা ১০ আগস্ট, ২০১৮)