সামনে নির্বাচন, তাই সবাই এখন কৃষক দরদি৷ কেন্দ্রের মোদি সরকার, রাজ্যের তৃণমূল সরকার, সবাই নিজেদের কৃষক দরদের নিত্য নতুন নজির হাজির করছে এবং সজোরে বলছে–তাদের রাজত্বে নাকি কৃষকরা খুব ভাল আছেন, কৃষকদের অবস্থার নাকি অনেক উন্নতি হয়েছে৷ এ রাজ্যের বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি যে দাবি করেছেন তা সবাইকে বিস্মিত, চমকিত করেছে৷ রাজ্যের গৌরবগাথা প্রচার করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন : (১) এই রাজ্যে কৃষকদের আয় বেড়েছে ৩.২ গুণ, (২) কোনও কৃষক এই রাজ্যে আত্মহত্যা করেনি৷ এইভাবে এক ধাক্কায় গল্পের গরু তিনি গাছে তুলে দিয়েছেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবি কতটা বাস্তব সম্মত তা এবার বিচার করে দেখা যাক৷
এ রাজ্যের ৯০ শতাংশ কৃষি জোতের মালিকই ক্ষুদ্র–প্রান্তিক–গরিব কৃষকরা৷ এই সব জোত অলাভজনক৷ এর অর্থ হল, এই সব জোতের ফসল বিক্রি করে যা আয় হয়, ব্যয় হয় তার চেয়ে বেশি৷ এই কারণে, কৃষক ক্রমাগত জমি হারাচ্ছে, খেতমজুরে পরিণত হচ্ছে৷ তথ্য বলছে, ১৯৭৭ সালে রাজ্যের কৃষক পরিবারগুলোর ৩৮ শতাংশ ছিল খেতমজুর–গ্রামীণ মানুষ৷ ২০১৬ সালে তার হার গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ শতাংশের কাছাকাছি৷ অর্থাৎ গ্রামীণ জীবনে ভূমিহীন কৃষকরাই এখন সংখ্যায় অর্ধেকের বেশি–আর জমি হারানোই যে এর অন্যতম প্রধান কারণ এ কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়৷ তৃণমূল সরকার ২০১১ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এই প্রক্রিয়া যে আরও বেগবান হয়েছে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই৷
যে কোনও বিবেচক মানুষ সহজেই বুঝতে পারবেন, কৃষকের আয় বৃদ্ধির পথ একটাই৷ তা হল, এক– ফসল উৎপাদনের জন্য খরচ কমানো অর্থাৎ সার–বীজ–কীটনাশক ইত্যাদির দাম কমানো, সহজ শর্তে কৃষককে কৃষি ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং দুই, ফসলের লাভজনক দাম পাওয়ার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা৷ একমাত্র এই পথেই কৃষকের আয় খানিকটা বাড়তে পারে এবং কৃষিকাজ একটা লাভজনক পেশায় পরিণত হতে পারে৷
এখন যদি দেখা যেত কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এমন সব নীতি গ্রহণ করেছে ও করছে যার ফলে কৃষকের কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ কমছে এবং তারা উৎপন্ন ফসলের ন্যায্য দাম পচ্ছে তা হলে তার আয়বৃদ্ধির দাবি জানানো যেত৷ কিন্তু এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যে নীতি গ্রহণ করছে তার ফলে কি এই সব শর্ত পূরিত হয়েছে? দেখা যাক–
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নীতিতে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে, ফসলের লাভজনক দাম পাওয়া যাচ্ছে না
চাষের জন্য দরকার সার–বীজ–ডিজেল–বিদ্যুৎ ইত্যাদি উপকরণ৷ আর দরকার প্রাথমিক পুঁজি৷ এই সব উপকরণ কম দামে সরবরাহ করার কি কোনও উদ্যোগ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আছে? না নেই৷ বরং ওদের গৃহীত নীতি শিল্প মালিকদের মুনাফা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে আর কৃষকের সর্বনাশ করেছে৷ সারের কথাই ধরুন, গত সাত বছরে সারের দাম বেড়েছে গড়পড়তা প্রায় আড়াই গুণ, কীটনাশকের দাম বৃদ্ধির কোনও সীমা–পরিসীমা নেই৷ এক কেজি পাট বীজের দাম যেখানে সাত বছর আগে ছিল ৩০ টাকা এখন তা দেড়শো–দুশো টাকা৷ এই রাজ্যে ডিজেলের দাম দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি৷ ফলে কৃষককে ঘন্টায় একশো থেকে একশো কুড়ি টাকা দরে জল কিনে চাষ করতে হয়৷ আর বিদ্যুৎ? অনেক রাজ্য চাষিকে বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করলেও এ রাজ্যে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ– ৬ টাকারও বেশি৷ ফলে সহজেই বোঝা যায়, চাষের খরচ কী পরিমাণে বাড়ছে৷
আর চাষের খরচ যত বাড়তে থাকে, নগদ টাকার প্রয়োজনও তত বেশি হয়৷ এই নগদ টাকা চাষি পায় কোথা থেকে? রাজ্যের ৯০ ভাগ চাষি নিম্ন–প্রান্তিক গোত্রের৷ ব্যাঙ্ক তাদের ঋণ দিতে চায় না৷ ফলে চাষি বাধ্য হয় সুদখোর মহাজনদের কাছে যেতে৷ তারাও মাসে ৬ থেকে ১০ শতাংশ সুদে টাকা ধার দেয়৷ এই বিপুল সুদের বোঝার হাত থেকে চাষিকে নিষ্কৃতি দেওয়ার উদ্যোগ কোনও সরকারই নেয় না৷ ফলে চাষির আয়ের একটা বড় অংশ খেয়ে নেয় এই সুদখোররা৷ এই হল গ্রাম বাংলার বাস্তব চিত্র৷
এত কষ্ট করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষক যে ফসল ফলায়, তার দাম পাওয়ার কোনও ব্যবস্থা কি কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার করেছে? কৃষকদের ৩.২ গুণ আয় বৃদ্ধির দাবিদার রাজ্য সরকারের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা কী? ভূমিকা প্রায় নেই বললেই চলে৷ রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থকরী ফসল পাটের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার কোনও দায়িত্ব গ্রহণ করে না৷ এক কেজি পাটও তারা কেনে না৷ কেন্দ্রীয় সরকারের জে সি আইও পাট কেনা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে৷
এই অবস্থায় পাট চাষিরা জলের দামে ফড়ে আর আড়তদার মহাজনদের কাছে পাট বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়৷ আলু চাষিরা আলুর লাভজনক দাম পায় না৷ সব্জি চাষিরা তাদের ফসল রাস্তায় ফেলে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে৷ বাদাম চাষি, পান চাষিরা আজ সর্বস্বান্ত৷ এই হল রাজ্যে ফসলের দাম পাওয়ার বাস্তব চিত্র৷ ধান কেনার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের প্রচার অনেক৷ কিন্তু এত প্রচার সত্ত্বেও তারা গত বছর ৫৭ হাজার মেট্রিক টনের বেশি ধান কেনেনি৷ যা এই রাজ্যের মোট ধান উৎপাদনের একটা সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র৷ এই ধান কেনার ক্ষেত্রেও কিন্তু প্রক্রিয়া এত জটিল এবং দাম পাওয়ার বিষয়টা এত দেরিতে ঘটে যে অধিকাংশ গরিব চাষি সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে ধান নিয়ে যেতে চায় না৷ তারা জলের দরেই ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়৷ এই হল ফসলের ন্যায্য ও লাভজনক দাম পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারগুলোর ভূমিকা৷
তাই আমরা কী দেখলাম? ফসল উৎপাদনের খরচ প্রতি বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আর ফসলের লাভজনক দাম কৃষকরা পাচ্ছে না৷ তা হলে কোন যাদুমন্ত্রে রাজ্যের কৃষকের আয় ৩.২ গুণ বাড়ছে? মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী আমাদের এই সামান্য প্রশ্নের জবাব দেবেন কি?
এ রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যা নেই
রাজ্যের কৃষকদের কল্পিত স্বর্গরাজ্যে বাস করাতে গিয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী আর একটা অসত্য তথ্য বিধানসভায় পেশ করেছেন৷ তা হল, এ রাজ্যে নাকি কোনও কৃষক আত্মহত্যা করেনি৷ সগর্বে তিনি বলেছেন, সারা দেশে গত বছর বারো হাজার চাষি আত্মহত্যা করেছে, কিন্তু এই রাজ্যে একজন চাষিও আত্মহত্যা করেনি৷ ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ না হলে মুখ্যমন্ত্রী দেখতে পেতেন, তাঁর এই দাবির সাথে বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই৷ বাস্তব চিত্র অন্য কথা বলছে এবং সে চিত্র বড় নিদারুণ, বড় মর্মান্তিক৷
তথ্য বলছে, ২০১৬ সালের অক্টোবর মাস থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছে৷ তৃণমূল কংগ্রেসের গত ৭ বছরের শাসনে তা হলে এই আত্মহত্যার পরিমাণ কত তা সহজেই অনুমান করা যায়৷ মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এই সব তথ্য পরিসংখ্যানকে তুড়ি মেরে অস্বীকার করবেন এবং বলবেন এ সব নিন্দুকদের রটনা৷ তাই তাঁর জ্ঞাতার্থে আমরা কৃষক আত্মহত্যার কয়েকটা সুনির্দিষ্ট ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি৷
বর্ধমান জেলার মেমারি ব্লকের আলুচাষি চন্দন পাল ২.৮০ একর জমিতে আলু চাষ করেছিলেন৷ আর এই আলু চাষ করতে গিয়ে তিনি সুদখোর মহাজনদের কাছ থেকে ধার করেছিলেন ৫০ হাজার টাকা৷ বাজারে আলুর দাম তিনি পাননি৷ দেনার দায়ে মহাজনের তাড়নায় চন্দনবাবু আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ আর একজন আলু চাষি স্বপন হাজরাও একই কারণে আত্মহত্যা করেছেন৷ তাঁর বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশপুর ব্লকের আনন্দপুর অঞ্চলে৷ (দি হিন্দু–২৭ মার্চ, ২০১৭)
এই তালিকায় আর একজন হলেন প্রবীণ কুমার লাহা৷ বাড়ি তাঁর বর্ধমান জেলার মেমারি ব্লকে৷ প্রবীণবাবু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশকরা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন৷ কিন্তু চাকরি–বাকরি জোগাড় করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তিনি কৃষিকাজে নেমে পড়েন৷ সুদে টাকা ধার করে আলু চাষ করেছিলেন৷ ফসলও ভাল হয়েছিল৷ কিন্তু তিনি বাজারে দাম পেলেন না৷ ফলে লক্ষাধিক টাকার বেশি দেনার দায়ে পড়ে যান৷ মান–সম্মান রক্ষার কোনও উপায় না দেখতে পেয়ে তিনি আত্মহত্যার বেদনাদায়ক পথ গ্রহণ করেন৷ এই রকম অসংখ্য ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়৷ ফলে এ রাজ্যে কৃষকরা আত্মহত্যার পথ গ্রহণ করছেন না বলে মুখ্যমন্ত্রী যে সগর্ব ঘোষণা করেছেন বাস্তবের সাথে তার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই৷
(৭১ বর্ষ ২ সংখ্যা ১০ আগস্ট, ২০১৮)