কলকাতা মেডিকেল কলেজে ছাত্রাবাসের আসন বন্টন করতে যদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়, তাহলে সে রাজ্যের প্রশাসনে আর কী–ই বা অবশিষ্ট থাকতে পারে? তবে এই হস্তক্ষেপ তিনি অনায়াসে আরও দশ দিন আগেই করতে পারতেন৷ তাহলে এশিয়ার প্রাচীনতম এবং অন্যতম প্রসিদ্ধ কলেজের মুখ সমগ্র দেশ তথা বিশ্বের সামনে এভাবে পুড়তো না৷ তা না করে রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্ত্রী যাঁর উপর ভরসা করে সমস্যা মেটানোর দায় ছেড়ে দিয়েছিলেন, সেই স্বনামধন্য দলীয় চিকিৎসক নেতা যে বারংবার ব্যর্থ হয়েছেন এবং রাজ্য সরকারের বিড়ম্বনা বাড়িয়েছেন তা কি নেত্রীর অগোচরে ছিল? যদিও এবার এই ব্যর্থতার দায় স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা এবং প্রধান স্বাস্থ্য সচিবের উপরে চাপিয়ে এবং তাদের অপসারণ করে তিনি মুখরক্ষা করতে চেয়েছেন৷ কিন্তু আসল খলনায়ক যে তার আঁচলের তলাতেই থেকে গেলেন সে সত্য মুখ্যমন্ত্রীর থেকে আর কে ভাল জানেন যদিও অনশনরত ছাত্ররা জীবন বাজি রেখে যখন লড়ছে, প্রশাসনের উচ্চ এবং দায়িত্বশীল পদে বসে তাকে অবহেলা করা এবং উদাসীন থাকা গুরুতর অপরাধ এবং অকর্মণ্যতা৷ তার জন্য শাস্তি এই প্রশাসকরা পেতেই পারেন৷ যে প্রশ্নের উত্তর অধরা থেকে যাচ্ছে তা হল, এই সমস্ত জো–হুজুর, অপদার্থ অথচ আপাত কঠোর আধিকারিকরা মুখ্যমন্ত্রীকে চালাচ্ছেন, নাকি মুখ্যমন্ত্রী তাঁর অধস্তনদের চালাচ্ছেন? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর রাজ্য এবং জনসাধারণের স্বার্থে মুখ্যমন্ত্রীকেই খুঁজে বের করতে হবে৷
এ কেমন প্রশাসন যারা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রায় বিপ্লব সম্পন্ন করার বড়াই করে, অথচ বছরের পর বছর মেডিকেল ছাত্রদের হোস্টেলের ব্যবস্থা করতে পারে না শুধু ছাত্রদের নয়, ছাত্রীদের পর্যন্ত এখানে সেখানে বহু অর্থ ব্যয় করে পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকতে হয়৷ যে হোস্টেলগুলি আছে তার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে কলেজ কর্তৃপক্ষ কিংবা উচ্চতর প্রশাসন সচেতন নন৷ ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীদের মানুষের মতো বসবাসের ব্যবস্থা নেই৷ কলেজের আসন বাড়ানো বা নতুন কলেজ খোলা ভোটে জেতার জন্য জনপ্রিয়তার একটি সহজ অঙ্ক৷ অথচ তার জন্য যে হোস্টেলের আসন, ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরি ইত্যাদি বাড়াতে হয়, তা কি হোস্টেল সুপার–ডিন–প্রিন্সিপাল-ডিোমই-স্বাস্থ্য সচিব কেউই জানেন না? এগারোতলা হোস্টেল বাড়ি হওয়ার পর, এমসিআই–এর নিয়মের ধুয়ো তুলে, সেখানে শুধু ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রছাত্রীরা থাকবে– এই বলে গলা ফাটানো চলছে৷ অথচ ৭৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা না থাকলে এমসিআই–এর নির্ধারিত নিয়মে আটকায় না বছরের পর বছর প্রথম বর্ষের ছাত্রদের আলাদা হোস্টেল ছাড়াই কলেজের স্বীকৃতি থাকতে পারে, এমসিআই বাধা হয় না এ কোন নোংরা এবং নিকৃষ্ট দলীয় রাজনীতির চর্চা করছেন শাসক দলের প্রতিনিধিরা? তাদের পূর্বসূরী শাসকরা হোস্টেল বন্টন, ট্রান্সফার, পদোন্নতি ও চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে যে নারকীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তারই উপরে দুর্নীতি ও গণতন্ত্র হত্যার ইমারত গড়াই কি বর্তমান সরকার ও প্রশাসনের লক্ষ্য?
আশ্চর্য লাগে যখন দেখি বিরোধী রাজনীতির তাবড় নেতারা লজ্জা–ঘৃণা–ভয় সব ত্যাগ করে কে কত বেশি সমর্থন এবং সহানুভূতি দেখাতে পারেন তার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লেন৷ শুধু ছাত্র বা যুব সংগঠনকে পাঠিয়ে বা নিজেদের প্রভাবিত বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মানুষকে আসর মাত করতে পাঠিয়েও তাঁরা শান্তিতে থাকতে পারলেন না৷ তাঁদের মতানুসারী চিকিৎসক নেতারা তো ধর্নাতেই বসে গেলেন অনশনরত ছাত্রছাত্রীদের সাথে তাঁরা ভুলে গেলেন বা ভুলিয়ে দিতে চাইলেন– সংহতিজ্ঞাপন করতে বসা এই নেতাদের অনেকেই মাত্র কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন এবং সেই সময় থেকেই ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেলের এবং কলেজের নানা সমস্যা চলছে৷ বিরোধী রাজনীতির বেশ কিছু শীর্ষ নেতা, যাঁরা এর আগে রাজ্য–প্রশাসন চালিয়েছেন, নিজেদের আমলে এরকম কত ছাত্র আন্দোলনকে কোতল করেছেন, গুঁড়িয়ে দিয়েছেন তা বেমালুম ভুলে ভালমানুষ সেজে বসলেন এসব সমস্যা তো শুধু মমতা ব্যানার্জীর আমলের নয়, বুদ্ধদেববাবু, জ্যোতিবাবু এমনকী সিদ্ধার্থবাবুর আমলেরও৷
আরও আশ্চর্য, আন্দোলন যাঁরা পরিচালনা করছিলেন সেই ছাত্র সংগঠন, তাদের নেতারা ও পরামর্শদাতারা এককালের এই স্বাস্থ্য–শিক্ষা ধ্বংসকারী নেতাদের কাছে ও তাঁদের প্রেরিত তথাকথিত সংবেদনশীল বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীর কাছে আন্দোলনের মঞ্চকে উন্মুক্ত করে দিলেন! একেই বুঝি বলে অরাজনৈতিক আন্দোলন, যা নিয়ে আন্দোলনের সংগঠকরা প্রথম থেকে অতি সেনসিটিভ ছিলেন? তিন দশকের উপর সরকার চালিয়ে যে সিপিএম নেতারা মেডিকেল কলেজে দাঁত ফোটাতে পারেননি, আন্দোলনরত ছাত্রদের অপরিপক্কতা তাদের সে সুযোগ করে দিল, বাস্তবে যার কোনও প্রয়োজন ছিল না৷ দৃষ্টিকটু ছিল একদা অতি তৃণমূল বর্তমানে অতি বিজেপি এক নেতার আগমন৷
ছাত্রদের আন্দোলনে সরকারের দাম্ভিকতা চূর্ণ হয়েছে৷ ছাত্রদের দাবি তাদের মানতে হয়েছে৷ ছাত্ররা হোস্টেল পাবে, পুরানো ছাত্রাবাসও নিশ্চয় বাসযোগ্য হবে৷ এ অবশ্যই সফলতা এবং এখানেই আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা৷ তবে আরও বেশি কোনও লাভ, ছাত্রদের আত্মপীড়নের উপর দিয়ে, আরও বড় ধান্দাবাজ ও ধড়িবাজরা তুলে নিলেন কি না, ভবিষ্যতে ছাত্রছাত্রীদের তা ভেবে দেখতে হবে৷
ডাঃ তরুণ মণ্ডল
কলকাতা মেডিকেল কলেজ মেন হোস্টেলের প্রাক্তন আবাসিক ও
ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক
(৭১ বর্ষ ২ সংখ্যা ১০ আগস্ট, ২০১৮)