উত্তরবঙ্গের চা–শ্রমিক সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ (জয়েন্ট ফোরাম) দীর্ঘকাল ধরে আইনসঙ্গত ন্যূনতম মজুরি সহ অন্যান্য দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু মালিকপক্ষ কখনওই ন্যূনতম মজুরি আইন কার্যকর করেনি৷ পূর্বতন সিপিএম সরকারের মতো বর্তমান তৃণমূল সরকারও আইন মানতে মালিকদের উপর কোনও চাপ সৃষ্টি করেনি৷ ২৩–২৫ জুলাই জয়েন্ট ফোরাম তিন দিনের শ্রমিক ধর্মঘট ডেকেছিল৷ সেই চাপেই লেবার কমিশনার দাবি বিবেচনার আশ্বাস দিলে ধর্মঘট প্রত্যাহূত হয়৷ রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী এ বিষয়ে শীঘ্রই কিছু ঘোষণা করবেন বলে শ্রমিক সংগঠনগুলির বিশ্বাস৷ অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, আন্দোলনের চাপে মজুরি সামান্য বাড়লেও, প্রকৃতপক্ষে কত বাড়া উচিত সে বিষয়ে বহু শ্রমিকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই৷ শ্রমিকদের মধ্যে সেই ধারণা স্পষ্ট করা এবং তার ভিত্তিতে ন্যায্য অধিকার আদায়ের লড়াই তীব্রতর করতে জয়েন্ট ফোরামের অন্যতম শরিক নর্থ বেঙ্গল টি প্ল্যানটেশন এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুচিন্তিত বক্তব্য তুলে ধরেছে৷
আমাদের দেশে ন্যূনতম মজুরি আইন (মিনিমাম ওয়েজ অ্যাক্ট) তৈরি হয় ১৯৪৮ সালে৷ কীভাবে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হবে সেই পদ্ধতি ঠিক করা হয় ১৯৫৭ সালে, ইন্ডিয়ান লেবার কনফারেন্সের ১৫তম অধিবেশনে৷ উল্লেখ্য, সমস্ত জাতীয় বণিক সংস্থা, প্রতিটি কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন, কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিরা এখানে অংশ নিয়েছিলেন৷ এখানে সর্বসম্মতভাবে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের যে পদ্ধতি স্থির হয় তা হল : (১) প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক কমপক্ষে ২৭০০ ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য প্রয়োজন৷ প্রতিটি শ্রমিক পরিবার পিছু ২ জন প্রাপ্তবয়স্ক ও ২ জন নাবালক হিসাব করে তাকে ৩ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সমতুল ধরা হয়৷ অর্থাৎ দৈনিক ২৭০০ ক্যালোরি হিসাবে ৩ জনের মোট ৮১০০ ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য একটি শ্রমিক পরিবারে প্রয়োজন৷ সেই খাদ্যের ক্রয়মূল্য হবে ন্যূনতম মজুরির একটি অংশ৷ (২) বছরে প্রতি শ্রমিক পরিবারে অন্তত ৭২ গজ কাপড়ের প্রয়োজন, অর্থাৎ মাসে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিটার৷ সেই কাপড়ের মূল্য ন্যূনতম মজুরিতে যুক্ত হবে৷ (৩) কোনও এলাকায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাউজিং স্কিম অনুযায়ী নিম্ন আয়সম্পন্ন মানুষের জন্য যে ঘর বরাদ্দ করা হয়, তার সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম ভাড়ার সমান টাকা আবাসন ভাড়া বাবদ ধরা হবে৷ (৪) জ্বালানি, আলোর ব্যবস্থা ও অন্যান্য খরচ বাবদ মোট মজুরির ২০ শতাংশ ধার্য করতে হবে৷
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ কী ছিল লক্ষ করা যাক৷ ১৯৯২ সালে রেপটাকোস অ্যান্ড কোম্পানি বনাম শ্রমিকদের একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ হল, চিকিৎসা, শিশু শিক্ষা, বিনোদন, বিবাহ এবং বৃদ্ধাবস্থার জন্য সঞ্চয় বাবদ মোট মজুরির ২৫ শতাংশ ধার্য করতে হবে৷ সর্বোচ্চ আদালতের মতে কোনও অবস্থাতেই এর থেকে কম কোনও মজুরি হতে পারে না৷ এখানে বলা দরকার, সর্বত্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাউজিং–এর অস্তিত্ব না থাকায় বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বন করতেই হয়৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকার দীর্ঘদিন যাবৎ শিল্প–শ্রমিকদের জন্য বাসস্থান বাবদ মাত্র ৫ শতাংশ ধার্য করে আসছে, যা অত্যন্ত কম৷ যুক্তির খাতিরে ৫ শতাংশ ধরেই দেখা যাক চা–শ্রমিকদের ন্যূনতম পাওনা কী দাঁড়ায়৷
আবাসনের জন্য ৫ শতাংশ, আলো ইত্যাদির জন্য ২০ শতাংশ এবং চিকিৎসা–শিক্ষা ইত্যাদির জন্য ২৫ শতাংশ– সব মিলিয়ে দাঁড়াচ্ছে মোট মজুরির ৫০ শতাংশ৷ তা হলে খাদ্য ও বস্ত্রের জন্য যা খরচ হবে সেটা হবে মোট মজুরির বাকি ৫০ শতাংশ৷ সোজা করে বললে খাদ্য ও বস্ত্রের জন্য যা খরচ হবে, মোট ন্যূনতম মজুরি হবে তার দ্বিগুণ৷
এবার খাদ্যের প্রসঙ্গে আসা যাক৷ পুষ্টিবিদদের মতে মাঝারি মানের পরিশ্রম করেন এমন একজনের ২৭০০ ক্যালোরি খাদ্যে কাজ চলে যায়, কঠিন পরিশ্রমের জন্য এর চেয়ে অনেক বেশি খাদ্যের প্রয়োজন৷ এর ভিত্তিতে ভারতীয় শ্রম সম্মেলন ২৭০০ ক্যালোরিযুক্ত খাদ্যকে ন্যূনতম প্রয়োজন বলে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল৷ তাই ন্যূনতম মজুরি হিসাব করার ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতেই হবে৷ যদিও বেশিরভাগ চা–শ্রমিকের জন্য এই খাদ্য যথেষ্ট নয়৷ ২৭০০ ক্যালোরি পাওয়া যেতে পারে এমন খাদ্যের একটি তালিকা এখানে দেওয়া হল৷ যেমন– চাল/আটা ৩৯৭ গ্রাম, ডাল ৮৫ গ্রাম, সবজি ২৮৩.৫ গ্রাম, দুধ ২৮৩.৫ গ্রাম, তেল/ঘি ৫৬.৭ গ্রাম, চিনি ৫৬.৭ গ্রাম, ফল ৫৬.৭ গ্রাম, মাছ/মাংস ৮৫ গ্রাম, ডিম ২৮.৩৫ গ্রাম৷ এর ৩ গুণ হবে ৩ জনের একটি শ্রমিক পরিবারের এক দিনের মোট প্রয়োজনীয় খাদ্য৷ এই হিসাবে পাওয়া যাবে এক মাসের প্রয়োজনীয় খাদ্যের পরিমাণ৷ এর খরচ হিসেব করে, তার সাথে সাড়ে পাঁচ মিটার কাপড়ের দাম যোগ করতে হবে৷ এতে যা আসবে, ন্যূনতম মাসিক মজুরির মোট পরিমাণ হবে ঠিক তার দ্বিগুণ৷ একে ২৬ দিয়ে ভাগ করলেই দৈনিক ন্যূনতম মজুরির মোট পরিমাণ বের হয়ে আসবে৷ এর মধ্যে একটা অংশ বিভিন্ন পরিষেবা বা বেনিফিটের মাধ্যমে চা–শ্রমিকদের প্রাপ্য৷ ফলে মোট মজুরি থেকে এই অংশটি বাদ দেওয়ার পর যা দাঁড়াবে সেটাই নগদ মজুরি৷ মালিকরা এই সব প্রাপ্য সুবিধার অনেকই দেয় না৷
এনবিটিপিইইউ–র দাবি শুধু ন্যূনতম মজুরিই নয়, সংগঠিত শিল্পের শ্রমিক হিসাবে ‘ফেয়ার ওয়েজ’–ই চা শ্রমিকদের প্রাপ্য৷ তা ছাড়া বন্ধ বাগান চালু করা, প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট অনুযায়ী সমস্ত প্রাপ্য সুনিশ্চিত করা, শ্রম আইন লঙঘনের জন্য মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটির দুর্নীতি, পরচা–পাট্টা নিয়ে ধোঁকাবাজি এবং আট ঘন্টা কাজ করা সত্ত্বেও ‘ঠিকা’ পুরা না করার অজুহাতে হাজিরা কেটে নেওয়া বন্ধ করার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে৷
(৭১ বর্ষ ১ সংখ্যা ৩ আগস্ট, ২০১৮)