আন্দোলন ছাড়া যে দাবি আদায়ের অন্য রাস্তা নেই, আবার তা প্রমাণিত হল৷ এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর দেশজোড়া দীর্ঘ আন্দোলনের চাপে পাশ–ফেল ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার৷ ২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার আইনে বদল নিয়ে আসতে হল লোকসভায়৷ গণআন্দোলনের ইতিহাসে এ এক বিরাট জয়৷ শিক্ষার অধিকারের নামে আসলে শিক্ষার সুযোগ কেড়ে নেওয়ার ওই আইন চালু হওয়ার পর পার হয়ে গেছে পুরো দশটি বছর৷ সর্বনাশ হয়ে গেছে কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীর৷ অথচ এর কোনও প্রয়োজন ছিল না৷ এই ক্ষতির কথা জানাই ছিল৷ পশ্চিমবাংলায় আটের দশকের গোড়ায় সিপিএম সরকার প্রাথমিক স্তর থেকে পাশ–ফেল এবং ইংরেজি তুলে দিয়েছিল৷ তার মারাত্মক ফল ছিল চোখের সামনে৷ কেন্দ্রে বিগত কংগ্রেস সরকার শিক্ষার অধিকার আইনের নামে যখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দিল তখনই এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) পশ্চিমবাংলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিল৷ বলেছিল, এর ফলে শিক্ষার অপূরণীয় ক্ষতি হবে, গরিব–নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে৷ যুক্তি এবং বিজ্ঞানের নিরিখে যে বিচার এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দেশের মানুষের সামনে উপস্থিত করেছিল তার সাথে সহমত হয়ে দেশজুড়ে বহু শিক্ষাবিদ–বুদ্ধিজীবী এগিয়ে এসে সরকারকে এই সর্বনাশ সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন৷ কিন্তু সরকার সেদিন কারও কথা শোনেনি৷
চালু হওয়ার পরই এর কুফল ফলতে থাকে৷ শিক্ষক অভিভাবকদের কাছে সর্বনাশটা স্পষ্ট হতে থাকে৷ একটি যথার্থ মার্কসবাদী দল হওয়ায় এবং জনগণের সাথে নাড়ির যোগ থাকায় এস ইউ সি আই (সি) এই সর্বনাশটা শুরুতেই ধরতে পারে৷ এই জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা থেকে দল এই মারাত্মক ক্ষতি তুলে ধরে অবিলম্বে পাশ–ফেল ফিরিয়ে আনার দাবিতে ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক শিক্ষাবিদ বুদ্ধি–জীবীদের যুক্ত করে রাজ্যে রাজ্যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে৷ জনগণের সামনে দল এ কথা তুলে ধরে যে রাজ্যে রাজ্যে এবং কেন্দ্রে সরকারগুলি একচেটিয়া পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়েছে৷ জনস্বার্থকে তারা পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে দু’পায়ে মাড়িয়ে চলছে৷ শুধুমাত্র ভোট দিয়ে সরকার পাল্টে আজ আর জনগণের কোনও দাবি আদায় হবে না৷ গণআন্দোলনের ব্যাপক চাপই একমাত্র শাসক শ্রেণিকে বাধ্য করতে পারে জনগণের দাবি মানতে৷ এস ইউ সি আই (সি) এ দেশের শোষিত শ্রেণির একমাত্র দল হিসাবে বারে বারে জনগণের দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছে, জেলে গিয়েছে, পুলিশের অত্যাচার সহ্য করেছে৷ অটুট দৃঢ়তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট দাবিতে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাছে৷ ১৯ বছরের দীর্ঘ আন্দোলনের চাপে পশ্চিমবাংলায় প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি ফিরিয়ে আনা তার উজ্জ্বল উদাহরণ৷ এবারও এস ইউ সি আই (সি) সারা দেশ জুড়ে পাশ–ফেল ফিরিয়ে আনার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছে৷ এরই ফলে চার বছরের মধ্যেই ২২টি রাজ্য থেকে পাশ–ফেল ফিরিয়ে আনার দাবি ওঠে৷ আন্দোলনের চাপে সরকার রাজ্যগুলির শিক্ষামন্ত্রীদের নিয়ে কমিটি গড়তে বাধ্য হয়৷ একের পর এক কমিশনের রিপোর্টে শিক্ষার মারাত্মক অবনতির কথা উঠে আসে৷ কিন্তু সরকারের গড়িমসি এবং অনিচ্ছায় এতগুলি বছর চলে গেল৷
এখন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর স্বীকার করছেন, শিক্ষার মান তলানিতে এসে ঠেকেছে৷ সমীক্ষার রিপোর্ট উদ্ধৃত করে বলছেন, অষ্টম শ্রেণির ছাত্র পঞ্চম শ্রেণির অঙ্ক পারছে না৷ ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তৃতীয় শ্রেণির প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে৷ এর সাথে মন্ত্রী যে কথাটি বলেননি, তা হল, এই সুযোগে দেশ জুড়ে ব্যবসার একটি অন্যতম পণ্য হয়ে উঠেছে শিক্ষা৷ দেশের ছোট বড় একচেটিয়া– সব ধরনের পুঁজিপতিরা নেমে পড়েছে শিক্ষার ব্যবসায়৷ এখন যদি সরকার পাশ–ফেল চালু করতেই চায় তবে নতুন আইনে তাঁরা শুধুমাত্র পঞ্চম এবং অষ্টমের কথা বলা হচ্ছে কেন? কেন তাঁরা প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ–ফেল চালুর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না? মারাত্মক ক্ষতিটা দেখেও তাঁরা পাশ–ফেল চালু বাধ্যতামূলক না করে রাজ্যগুলির উপরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? যে দিন কেন্দ্রীয় সরকার পাশ–ফেল তুলে দিয়েছিল সেদিন তো তারা এ ভাবে রাজ্যগুলির মত নেয়নি৷ তা হলে চালু করার সময় মতামতের বাহানা দিয়ে দেরি করা হচ্ছে কেন?
এ রাজ্যে তৃণমূল সরকারের নেতা–মন্ত্রীরাও ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থান নিয়ে চলছেন৷ তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সিপিএম যে পাশ–ফেল ব্যবস্থাকে প্রাথমিক স্তর থেকে তুলে দিয়েছিল তা তাঁরা ফিরিয়ে আনবেন৷ কিন্তু উল্টে সারা দেশে তাঁরাই প্রথম অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ–ফেল তুলে দিলেন৷ কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভায় আইন পাশ করার পরও এখন তাঁরা আবার নতুন করে কমিশন তৈরি করছেন৷ অথচ যেদিন তাঁরা কলমের এক খোঁচায় পাশ–ফেল তুলে দিয়েছিলেন সেদিন কোনও কমিশন, কোনও শিক্ষাবিদ, কোনও বুদ্ধিজীবীর মতামতের তোয়াক্কা করেননি৷ সেদিনও রাজনৈতিক দল হিসাবে একমাত্র এস ইউ সি আই (সি) এর প্রতিবাদ করে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল৷ সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন রাজ্যের প্রথম সারির শিক্ষাবিদ–বুদ্ধিজীবীরা৷ এবারের লোকসভা অধিবেশনে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপি সরকারের এই ঢিলেঢালা আইনকেই সমর্থন করে এসেছেন, কোনও প্রতিবাদ করেননি৷ তাঁদের নেতা–নেত্রীরা প্রায়শই শিক্ষার মানের অধঃপতন নিয়ে জনগণের সামনে হা–হুতাশ করেন৷ কিন্তু পাশ–ফেল না থাকাটা যে এর মূল কারণ, সেটা তাঁরা কখনও জনগণকে বলেন না৷ কারণ তাঁরাও বুর্জোয়াদের বিশ্বস্ত একটি দল৷ শোষণ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে তাঁরাও চান না দেশের মানুষ শিক্ষা পাক, সচেতন হোক৷ চান না শিক্ষা–ব্যবসায়ী পুঁজিপতিদের হাত থেকে ব্যবসার এত বড় সুযোগটা কেড়ে নিতে৷ কিন্তু শিক্ষা নিয়ে মানুষের যে গভীর আবেগ রয়েছে সেটিকে তাঁদের ভোট রাজনীতিতে ব্যবহার করতে চান৷ প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল ফেরানোর দাবিতে গত বছর ১৭ জুলাই এস ইউ সি আই (সি)–এর ডাকা বাংলা বনধে রাজ্য জুড়ে ব্যাপক সাড়ার সামনে পড়ে তৃণমূল সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা অবিলম্বে পাশ–ফেল চালু করে দেবে৷ কিন্তু প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে এখনও কমিশন বসিয়ে সময় নষ্ট করে চলেছেন৷ উপরন্তু ১৯ জুলাই রাজ্যপালের কাছে প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালুর দাবি জানাতে গেলে তৃণমূল সরকার এস ইউ সি আই (সি) কর্মীদের উপর নির্মম পুলিশি অত্যাচার নামিয়ে এনেছে৷
রাজ্যের জনগণ আর তাঁদের সন্তানদের সর্বনাশ হতে দিতে রাজি নন৷ কিন্তু এ কথা আজ পরিষ্কার ভাবে বুঝতে হবে, পুঁজিপতি শ্রেণির তাঁবেদার এই সরকারগুলির থেকে জনস্বার্থের দাবি আদায় করতে গণআন্দোলনকে তীব্র করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই৷ শিক্ষা আন্দোলন তথা গণআন্দোলনের নেতা হিসাবে এস ইউ সি আই (সি) নেতৃত্ব সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছে, দু’মাসের মধ্যে রাজ্য সরকার প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালু না করলে জনগণ রাজ্যকে অচল করে দিয়ে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করবে৷ লোকসভায় পাশ–ফেল ফেরানোর আইন পাশ হওয়া এস ইউ সি আই (সি)–র আন্দোলনের এক বিরাট জয়৷ এ রাজ্যে প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালুর পূর্ণ বিজয়ের ফয়সালা করতে হবে জনগণের আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে৷
(৭০ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা ২৭ জুলাই, ২০১৮)