নারী ও পুরুষের সাম্য ও সমানাধিকারের দাবি উঠেছিল রাজতন্ত্র–সামন্ততন্ত্রের অবসান ও গণতন্ত্রের উন্মেষের যুগে৷ সামন্ততন্ত্র উচ্ছেদ করে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কিন্তু এই পুঁজিবাদ শোষণের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সাম্যের আকাঙক্ষা অপূরিতই থেকে যায়৷
সামাজিক জীবনে আজও নারী ও পুরুষের বৈষম্যের উপস্থিতি আধুনিক সভ্যতার গরিমাতে কলঙ্ক লেপন করে৷ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই বৈষম্য কতটা তা আমেরিকার সমীক্ষক সংস্থা ‘ম্যান কেয়ারের’ সাম্প্রতিক রিপোর্টে লক্ষ করা যায়৷ বাড়িতে এবং কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা পুরুষের চেয়ে বেশি সময় শ্রম ব্যয় করে৷ সারাদিনে ব্যয়িত মেয়েদের শ্রম সময়ের একটা অংশ হিসাবের বাইরে আড়ালেই থেকে যায়, যাকে বলা হয়, ‘আনপেইড ওয়ার্ক’৷
শ্রমিকের শ্রমশক্তি মালিকরা কীভাবে লুঠ করে, তা অঙ্ক কষে দেখিয়ে পুঁজিবাদের দুর্গে প্রবল আঘাত হেনেছিলেন কার্ল মার্কস৷ পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরা যে কথাকে গায়ের জোরে অস্বীকার করতে চেয়েছে সবসময়৷ অথচ মার্কসের জন্মের ২০০ বছর পর আবারও এই সমীক্ষা রিপোর্ট দেখাচ্ছে কীভাবে পুঁজিপতিরা শ্রম শোষণ করছে৷ বিশ্বকে ৮টি এলাকায় ভাগ করে সমীক্ষা তুলে ধরেছে কোন এলাকায় শ্রমশক্তি কতটা শোষিত হচ্ছে৷
প্রথমে লাতিন আমেরিকার কথাই ধরা যাক৷ এখানে মহিলা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ৮.৩ ঘন্টা শ্রমের মধ্যে ৫ ঘন্টার শ্রম লুঠ করে মালিকরা৷ পুরুষের ক্ষেত্রে লুঠ করে ১.৬ ঘন্টার শ্রম৷ অর্থাৎ মহিলা শ্রমিকরা তাঁদের শ্রমের মূল্যের ৬০ শতাংশ পান না৷ পুরুষরা পান না ২০ শতাংশ৷
অন্যান্য এলাকায় এই শ্রম শোষণের হার কেমন? দক্ষিণ এশিয়া, ভারতের অবস্থান যে এলাকায়, সেখানে মহিলারা প্রাপ্য বেতনের ৬১.৫ শতাংশ পান না, পুরুষরা পান না ১৩.২ শতাংশ৷ পূর্ব এশিয়ায় মহিলারা পান না তাঁদের প্রাপ্য বেতনের ৪৯.৩ শতাংশ, পুরুষেরা পান না ১৭.৬৪ শতাংশ৷ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় এই শোষণ আরও বেশি৷ সেখানে মহিলারা পান না বেতনের ৮৩.৫ শতাংশ, পুরুষরা পান না ২৮.৫ শতাংশ৷ সাহারা মরুভূমি দক্ষিণে আফ্রিকার দেশগুলিতে মহিলারা পান না তাঁদের প্রাপ্য বেতনের ৫৭.৭ শতাংশ, পুরুষরা পান না ২৪.৫৯ শতাংশ৷ আর অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশ যার মধ্যে আমেরিকা, জাপান, জার্মানি, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশ রয়েছে, সেখানে মহিলারা পান না তাঁদের বেতনের ৬২.৫ শতাংশ, পুরুষরা পান না ৩৫.৩৮ শতাংশ৷
এই বঞ্চনা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এক মৌলিক অবিচার৷ নারী ও পুরুষ উভয়েই এখানে শোষিত হলেও, নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি শোষিত৷
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নারীর কাঁধে চেপেছে দ্বৈত শোষণের জোয়াল৷ একদিকে পুঁজিবাদী শোষণ, অন্য দিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আধিপত্য৷ ‘ম্যান কেয়ারের’ এই সমীক্ষা দেখাচ্ছে বাড়ির বৃদ্ধ বাবা–মাকে দেখাশোনার ক্ষেত্রে তাঁদের কন্যারা ছেলেদের থেকে দ্বিগুণ সময় দিয়ে থাকে৷ আবার দক্ষিণ আফ্রিকার উপর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে এইডস এবং এইচআইভি আক্রান্তদের প্রাথমিক দেখাশোনার দুই–তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে মেয়েরাই অগ্রণী৷ কিন্তু এর কোনও ক্ষেত্রেই সামাজিক শ্রমের স্বীকৃতি নেই৷ ৩২টি দেশের উপর আরেকটি গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মেয়েদের বিনা পারিশ্রমিকে সেবার যে বাৎসরিক মূল্য, তা ধনী দেশগুলির ক্ষেত্রে বিশ্বের জি ডি পি–র ১.৯ শতাংশ এবং দুর্বল দেশগুলির ক্ষেত্রে ২.৯ শতাংশ৷
ভারতের ক্ষেত্রে পরামর্শদাতা সংস্থা ম্যাকেন্সির তৈরি আরেকটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, এ দেশে মাত্র ৩০ শতাংশ মহিলা কর্মরত৷ এই হার চীন, জাপান, ফিলিপিন্স, মায়ানমার, বাংলাদেশের থেকেও কম৷ যাঁরা কাজ করেন তাঁদের মধ্যে ৫০ শতাংশ মহিলা সমকাজে কম বেতন পান, যেখানে পাকিস্তানে ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই হার যথাক্রমে ৪৮ শতাংশ ও ৪৬ শতাংশ৷ মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ আইনের বাধ্যবাধকতায় বিভিন্ন কোম্পানি মহিলাদের নিয়োগ করলেও তাঁদের দিয়ে বাড়তি কাজ করানো হয়৷
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ শুধু বিজ্ঞাপনের জাঁকজমকেই আটকে থেকেছে৷ রিপোর্ট বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে নারী–বৈষম্যে ভারতের অবস্থান উপরের দিকেই৷ আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ‘আইএলও’–র আশা, আগামী ৭৫ বছর পর নারী–পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠত হবে,কিন্তু কী ভাবে হবে? পুঁজিবাদে তা হওয়া কোনও মতেই সম্ভব নয়৷ পুঁজিবাদ মানেই মুষ্টিমেয় মালিকের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়া, আর সমাজের বিরাট পরিসরে দারিদ্র, ক্ষুধা, বেকারির জন্ম দেওয়া৷ এখানে সাম্য আসতে পারে না৷ যে পুঁজিবাদ দাঁড়িয়েই আছে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের উপর, সে কোনও সামাজিক বৈষম্যই দূর করতে পারে না, নারী–পুরুষের বৈষম্যও নয়৷ এমনকী প্রাচুর্যে ভরা মুষ্টিমেয় ধনী পরিবারগুলির ভিতরকার নারী–পুরুষ বৈষম্যকেও পুঁজিবাদ দূর করতে পারে না৷
এই বৈষম্য দূর করতে পারে একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা৷ যা সোভিয়েত, চীন সহ নানা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র করে দেখিয়েছিল৷ সমাজতন্ত্রের সাময়িক বিপর্যয় নারীর ওপর অত্যাচারকে আরও বাড়িয়েছে৷ কিন্তু এটা স্থায়ী হতে পারে না৷ পুঁজিবাদকে ভেঙে বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ার লড়াই মানবজাতিকে লড়তেই হবে৷
(৭০ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা ২৭ জুলাই, ২০১৮)