মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশের পর কারা শীর্ষ স্থান পেল তা নিয়ে যখন সরকার থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যমের মাতামাতি বা উন্মাদনায় চারদিক সরগরম, তখন একটি দৈনিক সংবাদপত্র সম্পাদকীয়তে শিক্ষার মূল কিছু প্রশ্নের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষার একটি মারাত্মক ব্যাধিকে তুলে ধরেছে৷
সেই ব্যাধির ডায়াগনোসিস করতে হলে কিছু সংখ্যাতত্ত্বের দিকে তাকাতে হবে৷ ২০০৬ সালে ১৮ লক্ষের বেশি শিশু প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল৷ ২০১৩ সালে অষ্টম শ্রেণিতে সেই পডুয়ার সংখ্যা কমে দাঁড়াল ১৫ লক্ষ৷ ২০১৬ সালে তারা যখন মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসে তখন তা আরও কমে দাঁড়াল সাড়ে এগারো লক্ষ৷ ২০১৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে ওই সংখ্যা আরও কমতে কমতে নেমে এল ৮ লক্ষে৷ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতেযেতে যেতে ৫৬ শতাংশের বেশি পডুয়াই ঝরে গেল৷
আবার ২০১৬–র মাধ্যমিকে ২ লক্ষ ও ২০১৮–র উচ্চ মাধ্যমিকে দেড় লক্ষ পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছিল৷ অথচ বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে যখন ২০০৯ সালে শিক্ষার অধিকার আইন চালু করা হয়েছিল এবং তার মাধ্যমে গালভরা ‘নিরবচ্ছিন্ন সার্বিক মূল্যায়ন’ ব্যবস্থার নামে প্রচলিত পাশ–ফেল প্রথাটি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিলোপ ঘটানো হয়েছিল তখন কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নির্ধারকদের দাবি ছিল ‘এই নীতি চালু হলে স্কুলছুটের সংখ্যা কমবে’৷ কোথায় কমল?
পশ্চিমবঙ্গে পাশ–ফেল ব্যবস্থাটি চতুর্থ শ্রেণি পর্য়ন্ত অবলুপ্ত হয়েছে ১৯৮১ সালে– সিপিএম সরকারের আমলে৷ অর্থাৎ পড়ুয়াদের গিনিপিগ বানানোর প্রক্রিয়া চলছে এ রাজ্যে গত ৩৭ বছর ধরে, অন্য রাজ্যে তা চলছে ৮ বছর৷ তাই সরকারি পরীক্ষা–নিরীক্ষা বা ভ্রান্ত শিক্ষানীতির সর্বাপেক্ষা বেশি শিকার হয়েছে এ রাজ্যের শিশুরা৷
পাশ–ফেল তুলে দিয়ে শিক্ষার ভিত্তি দুর্বল করে দেওয়ার পর নানা ফিকিরে নম্বর পাইয়ে দেওয়ার শত ব্যবস্থা আনা হয়েছে বিদ্যালয় শিক্ষায়৷ তা সত্ত্বেও মাধ্যমিকে ২ লক্ষের বেশি পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হওয়ার নূ্যনতম নম্বর পেল না৷ কেন এই অবস্থা? প্রায় কিছু না পডে, না শিখে, না জেনে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে ওই পড়ুয়াদের শিক্ষার ভিত্তিটি যে দুর্বল হল তার জন্যই এই পরিণতি৷ অথচ প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কারওরই এদের নিয়ে কোনও ভাবনা নেই৷
সম্প্রতি প্রকাশিত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্টে যে পরীক্ষার্থীরা ‘high rank’ করেছে, মুখ্যমন্ত্রী থেকে সংবাদমাধ্যম সবাই তাদের পিছনে দৌড়চ্ছে৷ মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের সম্মানে কয়েক হাজার টাকা করে উপঢৌকন দিয়েছেন৷ তাঁরা নিশ্চয়ই অভিনন্দনযোগ্য৷ কিন্তু এই ‘ফার্স্ট’, ‘সেকেন্ড’দের মধ্যে ব্যতিক্রমী কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগই যে পরিবেশে গডে উঠেছে, যে সমস্ত বিদ্যালয়ে পডেছে, যত সংখ্যক গৃহশিক্ষকের সাহায্য নিয়েছে বা যে আকাশছোঁয়া বেতনের কোচিং সেন্টারে টেস্টের পর টেস্টের চৌকাঠ পেরিয়ে পরীক্ষার জন্য নিজেদের তৈরি করেছে, তাদের কাছে নিজেদের বিদ্যালয়গুলিতে পাশ–ফেল আছে কি নেই তার কোনও গুরুত্ব নেই৷ বাস্তবে তাদের কাছে বিদ্যালয় ছিল পরীক্ষায় বসার রেজিস্ট্রেশন নম্বর পাওয়ার সেন্টার মাত্র৷ এই চিত্র সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার দৈন্যদশাকে প্রকট করে দেয়৷ এই দীনতা কাটাতে হলে শিক্ষার অধিকার নামক আইনটির সংশোধন করে সাবেক পাশ–ফেল ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে, পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে৷ দলীয় আনুগত্যের পরিবর্তে মেধাকে করতে হবে নিয়োগের মাপকাঠি৷ সরকারি নানা কমিশন পাশ–ফেল পুনঃপ্রবর্তনের সুপারিশ করলেও সরকার করছি, করব বলে কালহরণ করছে৷ শিক্ষা নিয়ে সরকারের এই ছেলেখেলা আর চলতে দেওয়া যায় কি?
(৭০ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা ২২ জুন, ২০১৮)