Breaking News

আশাকর্মীদের এক হাজার টাকা ভাতা বৃদ্ধি, সঠিক নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলনের ফল

স্বাস্থ্য দপ্তরের অধীন ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে কর্মরত ৫০ হাজার আশাকর্মী পশ্চিমবাংলার গ্রামে গ্রামে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা রাত দিন উপেক্ষা করে কাজ করে চলেছেন প্রসূতি মা ও শিশু এবং গ্রামীণ জনসাধারণের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য৷ কিন্তু কাজ করার জন্য এই কর্মীদের কোনও বেতন নেই, রয়েছে ক্ষতিপূরণ নামক সান্ত্বনা৷ পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার নির্দিষ্ট বেতন ৮০০ টাকা বাতিল করে ২০১১ সালে এক সার্কুলার দিয়ে ফরম্যাট প্রক্রিয়া চালু করে৷ এলাকায় যেমন যেমন কাজ থাকবে, তেমনই পয়সা জুটবে– অনেকটা কমিশনের মতো৷ এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আশাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি করা হল বৈষম্য৷

আশাকর্মীরা সরকারি মান্যতাপ্রাপ্ত কিন্তু সরকারি কর্মী নন৷ স্বাস্থ্য দপ্তর ছাড়াও নানা সরকারি দপ্তরের এবং কেন্দ্র–রাজ্যের নানা প্রকল্পের কাজকে রূপায়িত করা এঁদের কাজ৷ তাতে কেউ পান সাত–আটশো টাকা, কেউ এক হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা যা সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরিকেও লজ্জা দেয়৷ এই টাকায় সংসার চলে?

১২ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল, কেন্দ্র বা রাজ্য– কোনও সরকারই তাঁদের সরকারি কর্মীর মর্যাদা ও বাঁচার মতো ন্যূনতম বেতনের ব্যবস্থা করেনি৷ পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা বলে দপ্তর বহির্ভূত ভাবে অসংখ্য রকমের কাজ করিয়ে নিচ্ছে৷ কাজের নির্দিষ্ট কোনও সময়সীমা নেই, ২৪ ঘন্টাই প্রস্তুত থাকতে হবে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য৷ আইটেম অনুযায়ী কাজ এমনভাবে প্যাকেজ করা হয়েছে যাতে সমস্ত ধরনের কাজ করতে তারা বাধ্য থাকে৷ পারিশ্রমিক পাওয়া শর্তসাপেক্ষ৷ ফরম্যাটের প্রতিটি পয়েন্টেই এরকম শর্ত৷ এই প্যাকেজ যেন পারিশ্রমিক না দেওয়ার মতলবেই তৈরি হয়েছে

সরকারের চাহিদা মতো আশাকর্মীদের হতে হবে ভলান্টিয়ার, ডাক্তার, নার্স, ট্রেন্ড ধাই৷ সব দায়িত্বই তাঁদের সামলাতে হবে৷ প্রয়োজনে মাঝরাতে রোগীর বাড়ি বা হাসপাতালে যেতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে৷ কোথাও কোনও নিরাপত্তা নেই৷ উপরন্তু সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই চরম অব্যবস্থার জন্য কোনও কাজ যদি আশাকর্মীরা সুষ্ঠুভাবে করতে না পারেন তাহলে তাঁদের প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা অনাবশ্যক হয়রানি করেন৷ এর ফলে আজ বহু কর্মী মানসিক চাপের শিকার৷

এই অসহনীয় অবস্থা মোকাবিলার জন্য পশ্চিমবঙ্গ আশাকর্মী ইউনিয়ন দীর্ঘ আন্দোলন গড়ে তুলেছে৷ জেলায় জেলায় ডেপুটেশন, ঘেরাও, অবরোধ, অবস্থান সহ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বেশ কিছু দাবি বিভিন্ন সময়ে আদায় হয়েছে৷ গত ১৮ ডিসেম্বর জেলায় জেলায় বিক্ষোভের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি রাজ্যপাল এবং রাজ্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কলকাতায় এক বৃহৎ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়৷ তার আগে জেলায় জেলায় বিক্ষোভ মিছিল দেখে রাজ্য সরকার ও প্রশাসন আশাকর্মীদের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করতে থাকে৷ ১৮ ডিসেম্বরের কর্মসূচি বানচাল করার জন্য প্রশাসনিকভাবে বহু বিপিএইচসি–তে মিটিং, ট্রেনিং ইত্যাদি ডেকে দিয়ে নানা ভাবে কর্মীদের আটকে দেওয়ার চেষ্টা হয়৷ কিন্তু কোনও কিছু দিয়েই তারা কর্মীদের নিরস্ত করতে পারেনি৷ ওই দিন কলকাতায় প্রায় ৩৫ হাজার আশাকর্মীর দৃপ্ত মিছিল রাজপথ উত্তাল করে দেয়৷ রাজ্য সরকার আশাকর্মীদের ন্যায্য দাবি পূরণের চেষ্টা না করে এই আন্দোলন স্তব্ধ করতে নেমে যায়৷ এনএইচএম–এর ডিরেক্টর সমস্ত জেলায় সিএমওএইচ–দের নির্দেশ দেন, যাঁরা মিছিলে অংশ নিয়েছেন তাঁদের তালিকা তৈরি করে  যেন বিএপি এবং ডিএপি–দের কারণ দর্শানোর নোটিস দিতে বলা হয়৷ এই মর্মে কারণ দর্শাতে হবে যে, ১৮ তারিখ আগাম অনুমতি ছাড়া কেন আশাকর্মীরা বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নিল৷ সমাবেশের পর বিভিন্ন জেলায় আশাকর্মীদের উপর ভীষণ দমন–পীড়ন ও অত্যাচার শুরু করে৷

এই বিষয়কে কেন্দ্র করে কর্মীদের মধ্যে চূড়ান্ত অসন্তোষ ও বিক্ষোভ সৃষ্টি হয় এবং তাঁরা মনে করেন, এই অপমানজনক আচরণ তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর আঘাত৷ সমাবেশ পরবর্তী সময়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও নানা সভায় আশাকর্মীদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত হুমকির সুরে কথা বলতে থাকেন৷ অনৈতিক ভাবে স্কিম তুলে দেওয়া, ভাতা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও প্রকাশ্য সভায় দিয়েছেন তিনি৷ এত কিছু সত্ত্বেও এই আন্দোলনকে দমানো যায়নি৷ সংগ্রামী শ্রমিক সংগঠন এআইইউটিইউসি অনুমোদিত পশ্চিমবঙ্গ আশাকর্মী ইউনিয়নের নেতৃত্বে আন্দোলন অব্যাহত ভাবে চলছে৷ এ রাজ্যের সরকার আশাকর্মীদের বেশ কিছু দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে এবং প্যাকেজের পাশাপাশি ফিক্সড ভাতা ২০০০ টাকা করা হয়েছে৷ গত ২১ মে রাজ্য সরকার এক ঘোষণার মধ্য দিয়ে আশা ও আইসিডিএস কর্মীদের আরও ১০০০ টাকা ভাতা বৃদ্ধির ঘোষণা করেছে৷ পশ্চিমবঙ্গে আশাকর্মীদের নির্ভীক দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের জন্যই এই জয় সম্ভব হয়েছে৷

দেরিতে হলেও এই ঘোষণা প্রমাণ করল সঠিক নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলনই শুধু জয় আনতে পারে৷

(৭০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ১জুন, ২০১৮)