পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা আইন–২০১৭ মোতাবেক যে রুল বা বিধি–২০১৮–র খসড়া রাজ্য সরকার প্রস্তুত করেছে তা এক কথায় শিক্ষাক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা জারির সমতুল্য৷ উক্ত শিক্ষা আইনটি বিল হিসাবে বিধানসভায় পেশ করার পর গণদাবীতে (৬৯ বর্ষ, ২১ ও ২৮ সংখ্যা) বিস্তারিতভাবে ওই বিলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখে মন্তব্য করা হয়েছিল, ‘‘ওই বিল আইন হিসাবে গৃহীত হলে উচ্চশিক্ষায় স্বাধিকারের ছিটেফোটা যতটুকু অবশিষ্ট আছে তা আর থাকবে না৷’’ এই অবস্থায় ওই আইনের রুল বা বিধির খসড়া হিসাবে রাজ্য উচ্চশিক্ষা দপ্তর যা প্রস্তুত করেছে তা স্বৈরতান্ত্রিক ঐ আইনকেও বহুদিক দিয়ে ছাডিয়ে গেছে৷
এই খসড়া বিধির প্রতিলিপি শিক্ষকদের নজরে আসার পর এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে৷ কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষক সংগঠনগুলো তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে৷ ১৬ এপ্রিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষাকর্মী–ছাত্র-গবেষক-আধিকারিকরা যৌথ কনভেনশন সংগঠিত করেন৷ ২৬ এপ্রিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌথ বিক্ষোভ কর্মসূচি রয়েছে৷ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংগঠন আবুটা রাজ্যস্তরের শিক্ষক সংগঠনগুলোকে একত্রিত করে যুক্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়েছে৷
কী আছে সেই বিধিতে? উক্ত বিধির মূল ধারাগুলি হল – (১) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সহ সকল কর্মীর চাকরিতে নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিটি (কলেজ শিক্ষকের ক্ষেত্রে কলেজ সার্ভিস কমিশন) যাঁদের নাম সুপারিশ করবে সেই নামের অনুমোদনের দায়িত্ব ছিল এতদিন পর্যন্ত উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল বা সিন্ডিকেটের৷ এখন থেকে ওই নাম রাজ্য সরকারের অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হবে এবং সেই অনুমোদনের আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়োগের ব্যাপারে কিছু করতে পারবে না৷
(২) এত কিছুর পরে নিয়োগ হলেও তাঁর চাকরির অস্থায়ী পর্ব (প্রোবেশন পিরিয়ড) থাকবে তিন বছর – যা এতদিন ছিল এক বছর৷ এই অস্থায়ী পর্বে কর্তৃপক্ষ নির্বাচিত ব্যক্তির কর্মক্ষমতা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও অতীত কার্যকলাপ সংক্রান্ত পুলিশ রিপোর্ট সংগ্রহ করবে৷ এই রিপোর্টগুলি সন্তোষজনক হলেই কেবল তাঁর চাকরি স্থায়ী হবে৷
(৩) শিক্ষক সহ সকল কর্মীকে প্রতি বছর বার্ষিক গোপন রিপোর্ট, কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন রিপোর্ট এবং বিষয় সম্পত্তির বার্ষিক রিপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে দাখিল করতে হবে – যা সরকার যেকোনও সময় দেখতে চাইবে৷
(৪) কর্তৃপক্ষের আগাম অনুমতি ছাড়া কেউ সংবাদমাধ্যমে মত প্রকাশ করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে৷ কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের নীতি বা কার্যক্রম সম্বন্ধে কোনও সমালোচনা সংবাদমাধ্যমে করলে তার জন্য শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে রাজ্য৷ যদি সরকার মনে করে কোনও শিক্ষক বা কর্মীর আচরণ রাষ্ট্রের পক্ষে অনিষ্টকর, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে৷ সেক্ষেত্রে তিনি বরখাস্ত হতে পারেন৷ আবার কোনও শিক্ষক বা কর্মী যদি ৪৮ ঘন্টার বেশি বিচারবিভাগীয় বা পুলিশি হেফাজতে থাকেন তাহলেও তিনি বরখাস্ত হবেন৷
(৫) শাস্তিপ্রাপ্ত কোনও শিক্ষক বা কর্মচারী বিচার প্রক্রিয়ায় সন্তুষ্ট না হলে তাঁকে আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে পুনরায় বিচার চাইতে হবে৷ সরকার তিন জন সরকারি আধিকারিককে দিয়ে এই আপিল ট্রাইবুনাল গঠন করবে৷ কিন্তু এই বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন তিনি সিভিল কোর্টে যেতে পারবেন না৷ এমনকী এই প্রক্রিয়ায় তিনি কোনও আইনজ্ঞের সাহায্যও নিতে পারবেন না৷
(৬) এছাড়া কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সহ সকল স্তরের কর্মচারীর উপস্থিতি বায়োমেড্রিক পদ্ধতিতে রেকর্ড করা হবে৷ শিক্ষকদের সপ্তাহে ৬ দিন ৭ ঘন্টা করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতিও হবে বাধ্যতামূলক ইত্যাদি৷
খসড়া বিধিটির সমগ্র পরিকল্পনা থেকে পরিষ্কার রাজ্য সরকার উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান কেবল নয়, শিক্ষক সহ সকল স্তরের কর্মীদের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে৷ সরকার কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারের উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করছে তাই নয়, শিক্ষকদের নূ্ন্যতম মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারেরও বিরোধিতা করছে৷ যে সরকারের শিক্ষামন্ত্রী অবলীলায় দম্ভোক্তি করতে পারেন যে, ‘অর্থ দিই, তাই কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে নাক গলাব’, সেই সরকারের কাছ থেকে আর কী প্রত্যাশা করা যেতে পারে? টাকা কি তাঁর ব্যক্তিগত, না সরকারের? অধ্যাপক হওয়ার সকল শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করে ও নির্বাচন কমিটির কঠোর মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েও একজন শিক্ষককে চাকরিতে স্থায়ী হওয়ার জন্য তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে কেন? কেন নির্বাচন কমিটির সুপারিশ রাজ্য সরকারের অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হবে? মূল আইনে তা ছিল না৷ এর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনের ছিটেফোটাও কি অবশিষ্ট রইল? সরকারের দূরভিসন্ধি বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়– হয় সদ্য নিযুক্ত শিক্ষককে শাসকের দলদাস খাতায় নাম লেখাতে হবে অথবা চাকরির মায়া পরিত্যাগ করতে হবে৷ পুলিশ রিপোর্ট, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এসব অছিলা আসলে শাসকের হাতে শিক্ষককে নিয়ন্ত্রণে রাখার অস্ত্র৷ সম্পত্তির বার্ষিক রিপোর্ট শিক্ষকদের জমা দিতে হবে কেন? তাঁরা কি কালো টাকার কারবার করেন? সম্পত্তির রিপোর্ট যদি কারও দিতে বাধ্যতামূলক করতে হয় তা শাসক দলের নেতা–মন্ত্রীদের জন্যই করা উচিত– যাঁদের অবাধে ঘুষ নিতে বা তোলাবাজি করতে বাধে না৷
বিধির সর্বাপেক্ষা আপত্তিজনক ধারাটি হল, শিক্ষকরা এখন থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত কোনও বিষয় বা রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের নীতির বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমে মুখ খুললে বা প্রবন্ধ লিখলে তা অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে৷ অন্য এক ধারায় বলা হচ্ছে, শিক্ষকদের আচরণ যদি কেবল সরকারের চোখে অনিষ্টকর মনে হয় তাহলেই তিনি বরখাস্ত হতে পারেন৷ অর্থাৎ এই সরকার আইন করে শিক্ষকদের মুখ বন্ধ করতে চাইছে৷ মতপ্রকাশের অধিকার মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার৷ যুগে যুগে দেশে দেশে এই অধিকারের পক্ষে লড়াই হয়েছে৷ আমাদের দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনে তার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে৷ ব্রিটিশ সরকার যখন কার্লাইল সার্কুলার জারি করে শিক্ষক ও ছাত্রের মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিল তখন ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কলেজের শিক্ষক–পডুয়ারা দেশবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন৷ রাজ্য সরকারে আসীন দলটি যদি তখন ক্ষমতায় থাকত তাহলে রবীন্দ্রনাথদের কী দশা হত তা ভেবে আমরা আশঙ্কিত?
তাঁরা উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের ১০টা ৫টা কাজের ঘন্টায় বাঁধতে চাইছেন৷ তাঁদের কি এই ন্যূনতম ধারণা আছে যে, একজন এই স্তরের শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষে ঢোকার আগে পঠন–পাঠনের বিষয়বস্তু প্রস্তুত করতে কত সময় দিতে হয়? বা গবেষকের পরিদর্শক হিসাবে একজন অধ্যাপককে গ্রন্থাগার, রেফারেন্স জার্নাল বা বইয়ের সঙ্গে কত ঘন্টা নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হয়? বায়োমেট্রিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে শিক্ষকদের সাত ঘন্টা কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে আবদ্ধ রাখলে এই কাজ সম্ভব হবে? ঠিকই কিছু কালো ঘোড়া আছে, যারা এর সুযোগ নেয়৷ তাদের জন্য অন্য ব্যবস্থা হোক৷ কিন্তু তার জন্য সমস্ত পঠন–পাঠন–গবেষণার পরিবেশকে ধ্বংস করা হবে কেন? বর্তমান সামাজিক অবক্ষয়ের যুগে ‘শিক্ষকদের উপস্থিতি বাড়াতে চাইছি, দায়বদ্ধ করতে চাইছি’– কথাগুলো আপাতত শুনতে ভাল হলেও এর কুফল সুদূরপ্রসারী৷ এর ফলে যাঁরা বিষয়গুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন তাঁদের মনে শিক্ষকদের সম্পর্কে অশ্রদ্ধা সৃষ্টি করা যাবে, দেখানো যাবে সরকার শিক্ষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কত চিন্তিত৷ কিন্তু শিক্ষার মঙ্গল কিছু হবে না৷
এসব কিছুর উপরেও গুরুত্বপূর্ণ হল, এই বিধির ধারাগুলোর মাধ্যমে শিক্ষকদের চরম অবমাননা করা হচ্ছে৷ শিক্ষকতা পেশা যে অন্য যেকোনও পেশার থেকে অন্য মাত্রার, শিক্ষক–গবেষকরা যে জ্ঞানের স্রষ্টা, তাঁরাই যে ভবিষ্যৎ নাগরিককে লালন–পালন করে সমাজের প্রয়োজনে গড়ে তোলেন – এই স্বীকৃতি না দিয়ে তাঁদের ভাবমূর্তিকে যদি ধূলায় মিশিয়ে দেওয়া হয় তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সচল রাখবে কে? বোঝাই যায় সমগ্র বিষয়টি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত৷ চাপে পড়ে শিক্ষামন্ত্রীর ‘কিছু–জানি না’, ‘জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া হবে না’ প্রভৃতি মন্তব্যের মধ্যে কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই৷ নিশ্চয় স্মরণে আছে ২০১৭–র শিক্ষা আইন ২০১৬–র ডিসেম্বরে একবার পেশ করার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবাদের ফলে তা সম্ভব হয়নি৷ বিলের কপি বিধায়কদের মধ্যে বিতরণ করার পরেও তা বিধানসভায় পেশ হয়নি৷ তখনও মন্ত্রী বলেছিলেন, এমন বিল যে পেশ হবে তা নাকি তিনি জানতেন না৷ পরে ২০১৭–র ফেব্রুয়ারিতে ২–১টি শব্দ পরিবর্তন করে প্রায় হুবহু ওই বিলকে আইনে পরিণত করা হয়েছিল৷ এই পরিস্থিতিতে শিক্ষক তথা শিক্ষার মর্যাদা রক্ষার্থে শিক্ষক–ছাত্র–অভিভাবক-শিক্ষানুরাগী সমস্ত মানুষেরই এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন৷
সেভ এডুকেশন কমিটির প্রতিবাদ অল বেঙ্গল সেভ এডুকেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক কার্তিক সাহা ১৬ এপ্রিল এক বিবৃতিতে বলেন, রাজ্য সরকার কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদে জন্য নয়া আচরণবিধির যে খসড়া প্রণয়ন করেছে–তা এক কথায় গণতন্ত্র হত্যার নয়া ফরমান৷ স্কুল শিক্ষকদের মতো একই কায়দায় কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদে যতটুকু গণতান্ত্রিক অধিকার এখনও বজায় আছে তাকেও গলা টিপে হত্যা করতে উদ্যত রাজ্য সরকার৷ আমরা অবিলম্বে সরকারকে এই গণতন্ত্র হত্যার ফরমান বাতিলের দাবি জানাচ্ছি৷ পাশাপাশি সমগ্র শিক্ষক– শিক্ষাকর্মী সমাজকে একযোগে রুখে দাঁড়িয়ে তীব্র আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি৷ |
(৭০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৭ এপ্রিল, ২০১৮)