বিশ্ববিদ্যালয়ের কণ্ঠ রোধ করতে চাইছেন ট্রাম্প

লস এঞ্জেলেসে ট্রাম্প বিরোধী মিছিল। ১৪ জুন

কলম্বিয়ার পর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুদান বন্ধের হুলিয়া জারি করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মানুষের শত্রু, তারা ‘শৃঙ্খলাভঙ্গ’ করেছে– খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্টের মুখে শোনা গেছে এমন অভিযোগ। কারণ কী? ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে, প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের গণহত্যার় প্রতিবাদে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আন্দোলন চলছে, তাতে সেখানকার ইহুদি ও ইজরায়েলপন্থী ছাত্রছাত্রীদের সুরক্ষা নিয়ে তারা চিন্তিত। তার উপর ট্রাম্প প্রশাসনের হুমকি অগ্রাহ্য করে হার্ভার্ডে প্রান্তিক, বৈষম্যের শিকার ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহিত করতে ‘ডাইভার্সিটি, ইক্যুইটি অ্যান্ড ইনক্লুশন’ (ডিইআই) অর্থাৎ ‘বৈচিত্র্য, সাম্য, অন্তর্ভুক্তি’ প্রকল্প চালু রয়েছে। হার্ভার্ডের মতো প্রতিষ্ঠানগুলি সরকারের একেবারেই অনুগত নয়! অতএব অনুদান বন্ধ করে তাদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে। আসলে গাজার উপর ইজরায়েলের একতরফা নৃশংস আক্রমণে স্বার্থ আছে মার্কিন অস্ত্র লবির, ট্রাম্প সাহেব নিজেও গাজা দখল করে সেখানে হোটেল ব্যবসা চালু করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। ফলে এই গণহত্যায় আমেরিকার সামরিক ও আর্থিক মদতের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদে সরব হচ্ছে। তাতেই শাসকদের চোখে ‘শৃঙ্খলাভঙ্গ’ হয়েছে।

বিশ্বে এক নম্বর শক্তিধর দেশ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের প্রধান কাজ মার্কিন পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন অস্ত্রশস্তে্রর বৃহৎ কারবারিরা। ইজরায়েল এই অস্ত্র ব্যবসার জন্য বর্তমানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য খরিদ্দার। পাশাপাশি এই ইজরায়েলই হল পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিশ্বস্ত স্যাঙাৎ। তাই তার বিরুদ্ধতা বন্ধ করাটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ হিসাবে ট্রাম্প সাহেবের কর্তব্য। তা ছাড়া, ফ্যাসিবাদী শাসক হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে চালু থাকা মুক্ত চিন্তার পরিসর গায়ের জোরে বন্ধ করে দেওয়াটা ট্রাম্প সাহেবরা গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য বলে মনে করেন। তাই ট্রাম্প সাহেবের ফতোয়া– বিশ্ববিদ্যালয়ে কী পড়ানো হবে, কারা পড়বে, কারা পড়াবেন, কোন ক্ষেত্রে গবেষণা হবে, পরিচালনা কী ভাবে হবে, প্রশাসনিক কাজকর্ম কীভাবে চলবে– তার সবকিছুই সরকারি অনুমোদিত হতে হবে। ভর্তি প্রক্রিয়া, প্রশাসনিক রদবদল, সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের মতো শর্তগুলি পূরণ না করলে হার্ভার্ডের মতো ৬০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এক কথায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে শাসকের অনুগত হওয়ার নিদান দিয়েছে তারা।

কিছু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুদান বন্ধের হুমকিতে ট্রাম্প প্রশাসনের শর্ত মেনে নিলেও হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষ বলিষ্ঠতার সঙ্গে জানিয়েছে, স্বাধীন, স্বনির্ভর একটি প্রতিষ্ঠানকে সরকারের এই হুমকি চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার এবং সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করতে দিতে রাজি নন। তারা সরকারের দেওয়া শর্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, গোটা বিশ্বের ছাত্রছাত্রীদের নিয়েই হার্ভার্ড। সেখানে নানা দেশ থেকে আসা শ্রেষ্ঠ ছাত্রদের জ্ঞানের আদানপ্রদানের মাধ্যমে চিন্তা ও গবেষণার ধারা তৈরি হয়। সে ক্ষেত্রে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার, পছন্দমতো বিষয়ে গবেষণার অধিকার, প্রয়োজন মতো শিক্ষক নিয়োগের অধিকার অবশ্যই থাকবে প্রতিষ্ঠানের। না হলে সেটা আর বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে না। এর পরই উদ্ধত ট্রাম্প সরকার হার্ভার্ডের ২০০ কোটি ডলার আর্থিক অনুদান বন্ধ করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের করমুক্ত মর্যাদাও প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

হার্ভার্ডের মতো বিশ্বের ঐতিহ্যমণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথিবীর সমস্ত প্রান্ত থেকে সেরা ছাত্রছাত্রীরা পড়তে ও গবেষণা করতে আসেন এবং সেখানকার শিক্ষকরাও পাণ্ডিত্যে, জ্ঞানে বিশ্ববন্দিত। এই প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করে অনেকে নিজের দেশে ফিরে আরও উচ্চস্তরের গবেষণা ও নিত্যনতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে মানবসমাজে বহু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এই অবস্থায় সরকারের অনুদান বন্ধে গবেষণা বন্ধ হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। ৬০ শতাংশের বেশি বিদেশি ছাত্র গবেষণা সহ উচ্চশিক্ষার জন্য আসে হার্ভার্ড ও আমেরিকার এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। শিক্ষাক্ষেত্র তো বটেই, অনুদান বন্ধে মার্কিন নাগরিকদের স্বাস্থ্য বিষয়ক বহু গবেষণা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। টিবি, ক্যান্সার, অ্যালঝাইমার্স সহ বহু অসুখ থেকে সেরে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের গবেষণা বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হয়েছে পরিবেশ দূষণ, পেশাগত সমস্যা, খাদ্য ও জনস্বাস্থ্যের সম্পর্ক বিষয়ক নীতি ও কর্মসূচি নির্ধারণের কাজও। মার্কিন নাগরিকরা সহ বিশ্বের নানা দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ উপকৃত হতে পারত এই কর্মকাণ্ডে। কিন্তু সে সবের তোয়াক্কা না করে মার্কিন নাগরিকদেরই টাকায় তৈরি সরকারি তহবিল থেকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া অনুদান কলমের এক খোঁচায় বন্ধ করে দিল ট্রাম্প সরকার।

শিক্ষা ও গবেষণায় বিশ্বে নেতৃত্বকারী ভূমিকা ছিল আমেরিকার। ট্রাম্প সরকারের নানা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা ক্ষেত্রে অনুদান বন্ধের পদক্ষেপে সেই মর্যাদাও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

প্রশ্ন উঠেছে, শাসকের অনুগত না হলেই কি কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম শত্রু তালিকায় উঠে যাবে? স্বায়ত্তশাসিত একটি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের কী কোনও ক্ষমতাই থাকবে না কোন ছাত্ররা পড়বে, কারা পড়াবেন, কী পড়াবেন, কোন ক্ষেত্রে গবেষণা হবে তা ঠিক করার? বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সঙ্গেই যুক্ত হয়ে আছে তার স্বাধিকারের প্রশ্ন। শিক্ষাবিদরা সিদ্ধান্ত নেবেন পড়ানোর সিলেবাস ও শিক্ষার অন্যান্য বিষয়ে। শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কহীন কোনও প্রশাসকের ফতোয়ায় তা পরিবর্তন করতে হলে শিক্ষা হয়ে পড়ে নিছক ট্রেনিং। তাতে সেই প্রতিষ্ঠান আর যথার্থ বিশ্ববিদ্যালয় থাকে না। কারণ, সৃষ্টিশীলতা ধ্বংস হয় এই ফতোয়ায়। স্বৈরাচারী শাসকরা শিক্ষাকে মারতে চায়, স্বাধীন চিন্তা ও গণতান্ত্রিক ভাবনা-ধারণাকে পিষে মারতে চায় বলেই প্রশাসনিক ফতোয়া দিয়ে, টাকার জোর দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারের গলা টিপে ধরে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদান বন্ধ করে ট্রাম্প সাহেব সেই পথেই হাঁটলেন।

এ বিষয়ে আমেরিকার সাথে ভারতের হুবহু মিল রয়েছে। ওখানে হার্ভার্ড, কলম্বিয়া, মিশিগান, এখানে জেএনইউ, হায়দরাবাদ কিংবা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শাসকের রক্তচক্ষু দেখছে বারবার। প্রশ্ন করলে বা কোনও বিষয়ে বিরোধিতা করলেই জুটেছে ‘দেশদ্রোহী’র তকমা, কারাবাসও জুটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ছাত্রেরা তো বটেই, গবেষক শিক্ষকদের দায়িত্বই হল– প্রশ্ন তোলা। প্রচলিত ব্যবস্থাকে, শাসককে প্রশ্ন করতে শেখাতে পারেন না যিনি, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনভোগী কর্মচারী হতে পারেন, যথার্থ শিক্ষক হতে পারেন না। এটাই সারা বিশ্বের বরেণ্য শিক্ষাবিদরা দেখিয়েছেন।

পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, যুগে যুগে ছাত্ররাই সমাজে ঘটে চলা অন্যায়ের বিরুদ্ধে এগিয়ে এসেছে। যুক্তির নিরিখে ন্যায়-অন্যায় বিচার করে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। সব রকম পিছুটান অতিক্রম করে শাসকের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ জানিয়েছে। শাসকের নিপীড়ন সহ্য করেছে, প্রত্যাখ্যান করেছে আপসকে। আরব বসন্ত, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট হোক কিংবা দিল্লিতে নির্ভয়ার নৃশংস হত্যা ও কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে অভয়ার নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন হোক– ছাত্ররাই এই ঐতিহাসিক আন্দোলনগুলির মূল প্রাণশক্তি। সেজন্যই হার্ভার্ডের মতো বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্যালেস্টাইনের ওপর সাম্রাজ্যবাদী ইজরায়েলের নৃশংস বর্বরতার প্রতিবাদ করলে ভয় পায় শাসকরা। প্রতিবাদের কণ্ঠ রোধ করতে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের গলায় প্রশাসনিক ফাঁসের দড়ি টেনে ধরে।

শাসক চায় ছাত্ররা তার অনুগত বাহিনীতে পরিণত হোক, যারা কোনও প্রশ্ন করবে না, তর্ক করবে না। তা হলে শাসকের অন্যায় কাজের জবাবদিহি করতে হবে না। অঙ্কুরেই প্রতিবাদের বীজকে ধ্বংস করে জনগণের প্রতিবাদের শক্তিকে শেষ করতে চায় সরকার। এমনিতেই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে দেশের সর্বত্র। তা সামলাতে ব্যর্থ মার্কিন প্রশাসন। আশার কথা, এখনও বহু গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন মানুষ আছেন, যারা এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ছাড়াও প্রাক্তনীরা পথে নেমেছেন শিক্ষাকে বাঁচাতে।

এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা  ২০ – ২৬ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত