মহারাষ্ট্রের নাগপুরে ১৩ মে একটি অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ-এর ‘হম দেখেঙ্গে’ কবিতাটি আবৃত্তি করার জন্য তিন জনের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। টিভিতে উক্ত অনুষ্ঠানের খবর দেখে ওই এলাকার জনৈক ব্যক্তি থানায় অভিযোগ জানান যে, ‘ভারত যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ছে তখন ভারতে এই কবিতা আবৃত্তি করা দেশবিরোধী কাজ’। এ হেন অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ওই তিন জনের বিরুদ্ধে বিএনএস-এর ১৫২ ধারায় দেশদ্রোহিতার মামলা দায়ের করেছে।
ফয়েজের ‘হম দেখেঙ্গে’ কবিতাটি বছর পাঁচ-ছয় আগেও ভারতে ব্যাপক মাত্রায় পরিচিত ছিল না। এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনের সময় কবিতাটি আলোচ্য হয়ে ওঠে এবং সেই থেকে প্রায়শই তর্ক-বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। আশির দশকে গজল গায়িকা ইকবাল বানো-র কণ্ঠে কবিতাটির গান হয়ে ওঠার রোমহর্ষক ইতিহাসও মূলত তখন থেকেই জনচর্চায় আসে।
আরএসএস-বিজেপি এই কবিতাটিকে হিন্দুবিরোধী তথা ভারতবিরোধী হিসাবে চিহ্নিত করেছে এবং সেই মতো সুযোগ পেলেই নানা জনের বিরুদ্ধে পরপর আইনি পদক্ষেপ করছে। সাম্প্রতিক নাগপুরের ঘটনাটি সেই পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা। এই প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপগুলির মাধ্যমে সমালোচকদের হয়রান করা, আতঙ্কিত করা, বিনা বিচারে জেলে আটকে রাখা এবং জনগণের মধ্যে ধর্মের নামে বিদ্বেষ ছড়ানো ইত্যাদিই যে বিজেপি পরিচালিত সরকারের উদ্দেশ্য, এতে কোনও সংশয় নেই। কারণ, কবিতাটি কোনও ভাবেই হিন্দুবিরোধী বা ভারতবিরোধী নয় বরং মৌলবাদ ও স্বৈরাচারী শোষণ বিরোধী।
পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জিয়াউল হক ক্ষমতা দখল করেন (১৯৭৭) এবং তাঁর সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে সেই সময় ধর্মীয় মৌলবাদ মারাত্মক ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতির প্রতিবাদে বামমনস্ক মানবতাবাদী কবি ফয়েজ ‘হম দেখেঙ্গে’ কবিতাটি লেখেন (১৯৭৯)। একটা সময়ে সরকার মহিলাদের শাড়ি পরাকে হিন্দুয়ানি বলে দাগাতে চায়। এর প্রতিবাদে তখন ইকবাল বানো বরাবরের মতোই শাড়ি পরেই কবিতাটি গান হিসাবে পরিবেশন করেন। এইসব প্রতিবাদের জন্য ফয়েজকে তো বটেই, বানোকেও পাকিস্তান সরকারের চরম রোষানলে পড়তে হয়।
এই ইতিহাস বহু প্রচারিত হওয়া সত্ত্বেও আরএসএস-বিজেপির অভিযোগ, ‘হম দেখেঙ্গে’ কবিতাটির মাধ্যমে হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তি ধ্বংস করে ভারতে ইসলামি শাসন কায়েম করার উস্কানি দেওয়া হয়েছে’।
মূল উর্দু ভাষায় লেখা কবিতাটিতে কবি সম্বোধন করেছেন তৎকালীন পাকিস্তানের মৌলবাদী স্বৈরাচারী শাসককে। সেখানে ‘ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানতে’ গিয়ে তিনি ধর্মীয় অনুষঙ্গই ব্যবহার করেছেন। এক জায়গায় বলেছেন, ‘জব অর্জ-এ-খুদা কে কাবে সে/সব বুত উঠওয়ায়ে জায়েঙ্গে/হম অহল-এ-সফা মরদুদ-এ-হারাম/ মসনদ পে বিঠায়ে জায়েঙ্গে।’ এর অর্থ বুঝতে গেলে, ইসলামের কাহিনী না জানলে, বিভ্রান্তির শিকার হওয়া স্বাভাবিক। কাবায় একসময় ৩৬০টি মূর্তি (বুত) স্থাপিত হয়েছিল যা ইসলামের নিরাকার একেশ্বরবাদের পরিপন্থী। তাই পরবর্তীকালে সেই সমস্ত মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ ধর্ম পালনের ভ্রান্ত পথ ত্যাগ করে সঠিক পথে ফিরে আসা হয়েছে। সেই অনুষঙ্গ ব্যবহার করে ফয়েজ মৌলবাদী শাসককে বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, কাবারূপী ঈশ্বরের এই দুনিয়া (অর্জ) থেকে একদিন সমস্ত ভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষেরাই একদিন সিংহাসনে বসবে বা জগতকে পরিচালনা করবে। তারপর ফয়েজ বলেছেন, ‘সব তাজ উছালে জায়েঙ্গে/ সব তখ্ত গিরায়ে জায়েঙ্গে/বস নাম রহেগা আল্লা কা।’ অর্থাৎ, একদিন সব স্বৈরতান্ত্রিক চিহ্ন (তাজ বা মুকুট) মাটিতে লুটিয়ে পড়বে। একাধিপত্যের সাম্রাজ্য (তখত) উজাড় হয়ে যাবে। থাকবে শুধু ঈশ্বরের (আল্লাহ্) নামটুকু।
সমস্ত ধর্মের এই মূল কথাটুকু ফয়েজ স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ধর্মীয় মৌলবাদে মত্ত তৎকালীন পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসককে। কিন্তু এই মূল কথাটুকু মেনে চলতে গেলে শাসক শ্রেণির বড় অসুবিধা। শোষণের জন্য তাদের দরকার শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে লাগাতার অনৈক্য, বিদ্বেষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধানো। তাই তারা ধর্ম বর্ণ জাত গোত্র ইত্যাদিকে ব্যবহার করে শোষণের রাজনীতিতে। সেই কারণেই স্বাভাবিক ভাবে ‘হম দেখেঙ্গে’ নিষিদ্ধ হয়। যুগে যুগে এ ব্যাপার ঘটেছে। বহু কবিই ধর্মতন্ত্রের, শোষণতন্ত্রের শিকার হয়েছেন। আরএসএস-বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিও ভারতের শোষিত জনগণের মধ্যে অনৈক্য বাড়াতে বদ্ধপরিকর। ধর্মের মূল নির্যাসকে অর্থাৎ, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ, কল্যাণ কামনা ইত্যাদিকে পাঠ্যক্রম সহ সব জায়গা থেকে তারা ছেঁটে ফেলছে এবং ইতিহাসকে বিকৃত করে গণমাধ্যম সহ সর্বত্র, বিশেষত মুসলিম বিদ্বেষকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা ৬ – ১২ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত