Breaking News

শ্রমিক-অধিকার রক্ষায় ২০ মে সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটের ডাক

আবারও একটা মে দিবস চলে গেল। সারা বিশ্বের খেটে-খাওয়া মানুষ মহান মে দিবসে শপথ নেন অর্জিত অধিকার রক্ষার সংগ্রামে নিয়োজিত হওয়ার। এই বছর মে দিবসে ভারতের শ্রমিক কর্মচারীরা শপথ নিলেন– শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় তাঁরা ২০ মে ধর্মঘটকে সর্বাত্মক সফল করে তুলবেন। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার মালিকের হাতে যথেচ্ছ শ্রমিক শোষণের অধিকার তুলে দিতে আনছে শ্রমিক স্বার্থবিরোধী ৪টি শ্রম কোড, দিনে ১২-১৪ ঘন্টা থেকে শুরু করে যতক্ষণ মালিকের মর্জি ততক্ষণই শ্রমিককে খাটানোর আইন আনছে। এর বিরুদ্ধেই এ আই ইউ টি ইউ সি সহ ৯টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ডাক দিয়েছে এই ধর্মঘটের।

যত দিন যাচ্ছে ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলি মালিক শ্রেণির স্বার্থে শ্রমিকদের সমস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়ার আইন আনছে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ৫১টি শ্রম আইনের মধ্যে ২৯টি শ্রম আইন বাতিল করে ৪টি শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী কালা শ্রম কোড এনেছে। এই ভাবে তারা শ্রমিকদের বহু লড়াই ও আন্দোলনের ফলে অর্জিত অধিকারগুলি একের পর এক কেড়ে নিচ্ছে। ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্টের নীতি এনে স্থায়ী কাজই আর রাখছে না। স্থায়ী কাজে স্থায়ী কর্মী নিয়োগ না করে ঠিকা কর্মী দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। ‘ফ্লোর ওয়েজ’ এনে ন্যূনতম মজুরি পাওয়ার অধিকার থেকে শ্রমিকদের বঞ্চিত করছে।

পিএফ, পেনশন, ইএসআই, গ্র্যাচুইটি সহ সামাজিক সুরক্ষা থেকেও শ্রমিকদের বঞ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অসংগঠিত ক্ষেত্র সহ গিগ-প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক ও স্কিমে কর্মরত কর্মীরা নূ্যনতম মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা থেকে আজও বঞ্চিত এবং দিনের পর দিন তাদের উপর বাড়ছে শোষণ, নিপীড়ন ও অত্যাচার। বিজেপি সরকারের বিরোধী বলে যারা ভোটের বাজারে গলা ফাটায় সেই দলগুলিও যেখানে সরকারি গদিতে আছে, সেখানেও একই শ্রম নীতি গ্রহণ করছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার মুখে মোদি সরকারের আইনের বিরোধিতা করেও ঘুরপথে এই শ্রমনীতি চালু করছে।

এই আক্রমণের সামনে এ বছর মে দিবসে লড়াইয়ের শপথ তাই নতুন করে নিয়েছেন ভারতের শ্রমজীবী মানুষ। মে দিবস দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণিকে শিখিয়েছিল সংগ্রাম করেই ছিনিয়ে আনতে হয় অধিকার। ১৮৮৬ সালের ৪ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকরা এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী সংগ্রাম করেছিল। ৮ ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবিতে ১ মে থেকে শুরু হওয়া এই শ্রমিক বিক্ষোভে ৩ মে ম্যাককর্মিক রিপার কারখানার ধর্মঘটী শ্রমিকদের সমাবেশে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৬ জন শ্রমিককে হত্যা করে। পর দিন হে মার্কেটের শ্রমিক সমাবেশেও পুলিশ লাঠি গুলি চালিয়ে ৪ জন শ্রমিককে নৃশংসভাবে হত্যা করে। মালিক শ্রেণির স্বার্থে পরিচালিত সরকার বিচারের নামে প্রহসন করে ৪ জন নেতাকে ফাঁসি দেয়, একজন নেতার জেলের অভ্যন্তরে রহস্যজনক মৃত্যু হয় এবং তিনজন নেতার কারাবাস হয়। এই ঘটনা সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিভিন্ন দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক এই আন্দোলনে সামিল হন। ১৮৮৯-এ মহান মার্ক্সের সুযোগ্য সহযোদ্ধা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের নেতৃত্বে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রতি বছর ১ মে দিনটি সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করার। আজ ভারতের শ্রমজীবী মানুষের রক্ত-ঘাম-টাকায় তৈরি প্রতিরক্ষা, রেল, ব্যাংক, বিমা, বিদ্যুৎ, কয়লা, ইস্পাত, তেল, বিমান, বন্দর সহ সকল সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে জলের দরে দেশি-বিদেশি মালিকদের কাছে বিক্রি বা লিজ দেওয়ার ব্যবস্থা করছে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। নতুন কলকারখানা তৈরি দূরের কথা, চালু কারখানা বন্ধ হয়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেকার বাহিনীতে নাম লিখিয়েছেন। ৪৬ বছরের মধ্যে আজ এ দেশে সবচেয়ে বেশি বেকার। নতুন কাজ দূরের কথা, করোনা অতিমারির সময়েই ১৮ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের নির্মম শোষণ আজ সকলেরই জানা। অন্যদিকে মালিকদের মুনাফার পাহাড় বাড়ছে। আর্থিক বৈষম্য আজ আকাশছোঁয়া। এই সরকার শুধু শ্রমিকদের নয়, কৃষকদের মারার জন্য তিনটি কালা কৃষি আইন এনেছিল। দিল্লি অবরোধ করে কৃষকরা ১ বছরের বেশি দৃঢ়পণ সংগ্রাম করে ৭১৫ জন কৃষকের আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে সরকারকে বাধ্য করেছে তিনটি কৃষি আইন বাতিল করতে। কিন্তু ধূর্ত মোদি সরকার এখন নাম পাল্টে কুখ্যাত কৃষিনীতি, কৃষি বিপণন আইনের নামে চালু করতে চাইছে। যার বিরুদ্ধে কৃষকরা আবার আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই ধর্মঘটে তাঁরাও সামিল হয়েছেন।

সারা বিশ্বই আজ বাজারসংকটে দীর্ণ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফা অটুট রাখতে গিয়ে মালিকরা চরম শোষণ নামিয়ে এনেছে। যতদিন বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক শিবির ছিল ততদিন শ্রমিকদের ওপর লাগামছাড়া শোষণ চাপাতে গেলে পুঁজিবাদী শাসকদের ওপর একটা নিয়ন্ত্রণ কাজ করত, এখন সেটুকু বাধ্যবাধকতাও কোনও শাসকদের সামনে নেই। ফলে শোষণ-বঞ্চনা তীব্র। এর বিরুদ্ধে দেশে দেশে লড়ছে শ্রমজীবী মানুষ। এই শ্বাসরোধকারী অবস্থা নিরসনের জন্য সারা বিশ্বের সাথে ভারতের শ্রমিকরাও আজ আন্দোলনের পথে। ৯টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের যুক্ত মঞ্চ ২০ মে সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। এই যুক্তমঞ্চের অন্যতম শরিক এ আই ইউ টি ইউ সি-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক অশোক দাস আহ্বান জানিয়েছেন, শুধু একদিনের ধর্মঘট নয়, আন্দোলনকে বিজয়ের লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য ‘মে দিবস’-এর শিক্ষানুযায়ী আন্দোলনের হাতিয়ার ‘শ্রমিক সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে ঐক্যবদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তুলুন।

লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা ২-৮ মে ২০২৫ এ প্রকাশিত