মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভোটে জেতার আগে স্লোগান তুলেছিলেন– আমেরিকা ফার্স্ট। বলেছিলেন ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’। তখন অনেকেই বুঝতে পারেননি দেশপ্রেমের এই স্লোগানের পিছনে কী লুকিয়ে আছে। এই স্লোগান ছিল তাঁর হয়ে কোমর বেঁধে নামা কর্পোরেট পুঁজির কর্ণধারদের তৈরি করে দেওয়া। বেকার, চাকরিহারা, ফুড কুপনে বেঁচে থাকা কয়েক লক্ষ মানুষকে ধোঁকা দিতে এই স্লোগান তারা ছড়িয়ে দিয়েছিল।
ট্রাম্প সাহেব গদিতে বসার কিছু দিনের মধ্যেই শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাইয়ের বন্যা বয়ে যায়। জনগণ এখন আওয়াজ তুলছে– ‘গ্রেট’ চাই না, আমেরিকাকে ‘নর্মাল’ করুন। এই স্লোগান দিয়েই গত ৬ এপ্রিল আমেরিকার ৫০টি প্রদেশের ১২০০ জায়গায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড Cাম্প ও তাঁর পরামর্শদাতা ধনকুবের এলন মাস্কের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ল।
আমেরিকায় এযাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয় ওইদিন। ‘রক্তপিপাসু ট্রাম্প দুনিয়া থেকে হাত ওঠাও’, ‘স্বৈরাচার বন্ধ করো’ স্লোগানে মুখরিত হয় নিউইয়র্ক, লস এঞ্জেলেস, ওয়াশিংটন, ওরেগো, পোর্টল্যান্ড সহ নানা শহরের রাজপথ। ট্রাম্পের কার্টুন নিয়ে মিছিল করে আমেরিকার হাজার হাজার মানুষ প্রতিবাদ জানালেন। এই আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে ‘৫০৫০১’ গ্রুপ। এর অর্থ হল ৫০টি প্রদেশে, ৫০টি বিক্ষোভ ১টি দিনেই। এই গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ১৯ এপ্রিল আবার আর একটি বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছে। সংগঠকরা বলছেন তাতে ১১ মিলিয়ন (১ কোটি ১০ লক্ষ) মানুষ অংশ নেবেন। সেই বিক্ষোভও ব্যাপক রূপ নিয়েছে। সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ এবং অভিবাসীদের লাগাতার মানবাধিকার লঙ্ঘন, অভিবাসীদের বিতাড়নের নামে নির্যাতন, সরকারি দপ্তরে ব্যাপক ছাঁটাই, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প থেকে সরকারের হাত তুলে নেওয়া এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বরাদ্দ ছাঁটাই, অন্য দিকে ধনকুবেরদের জন্য ঢালাও আর্থিক সুবিধার বন্দোবস্ত– এর বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মীদের সংগঠন সহ অন্যান্য সংগঠন এবং সাধারণ মানুষ এতে সামিল হয়েছেন।
বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আসল পরিচালক যে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি তা জানাই ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্রের ঠাটবাটটুকুকেও তোয়াক্কা না করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বকলমে কাজ করে চলেছেন ধনকুবের এলন মাস্ক। কোনও স্তরে নির্বাচিত না হয়েও ট্রাম্প সাহেবের নির্বাচনী তহবিলে টাকা ঢেলে তাঁকে জেতানোর ব্যবস্থা করে মাস্ক জিতে নিয়েছেন আমেরিকাকে আবার ‘মহান’ করে তোলার মহা দায়িত্ব! ট্রাম্প সাহেবের উদ্দেশে একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের অর্পিত দায়িত্ব ছিল জনগণের দুর্দশার জন্য কোনও বিশেষ জনগোষ্ঠীকে দায়ী করে দেশের মানুষকে তাদের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়া। তাদের একটাই লক্ষ্য শোষণের জন্য মূল দায়ী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাতে জনগণের বিক্ষোভ পরিচালিত না হয়। সেই লক্ষ্যেই ট্রাম্প সাহেব তাঁর নির্বাচনী প্রচারে ক্রমাগত বর্ণ-ধর্ম-জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় তুলে কৃষ্ণাঙ্গ, মুসলিম, হিসপানিক, ল্যাটিনো, এশিয়ান, অ্যাফ্রো-আমেরিকান ইত্যাদি হিসাবে চিহ্নিত করে নানা জনগোষ্ঠীকে আক্রমণ করতে থাকেন। জেতার পর বেকার, অর্ধবেকার, ঋণগ্রস্ত নিম্নবিত্ত, ঋণের দায়ে ঘরবাড়ি হারানো মানুষ এই রকম এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে খুশি করতে ট্রাম্প সাহেব তাঁর নির্বাচনী অ্যাজেন্ডা পূরণে অভিবাসীদের জোর করে ফেরত পাঠানোর আয়োজন করেছেন। তিনি কত কড়া তা দেখাতে অভিবাসী বিতাড়নকে কত নিষ্ঠুর করা যায় সে চেষ্টায় এবং তার প্রচারে তিনি খামতি রাখেননি। এদিকে তাঁর দোসর মাস্ক সাহেব মার্কিন ফেডারেল সরকারের খরচ কমানোর জিগির তুলে তাঁর দায়িত্বে থাকা ‘ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি’ (ডিওজিই)-র মাধ্যমে হাজার হাজার সরকারি কর্মচারীকে পত্রপাঠ ছাঁটাই করেছেন। কেন্দ্রীয় ফেডারেল সরকারের শিক্ষা দপ্তরটাই তিনি বিলুপ্ত করে দিয়েছেন। এই খরচ কমানোর কথা বলে আন্তর্জাতিক বহু সংস্থা থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা করছে মার্কিন প্রশাসন।
মার্কিন অর্থনীতি প্রবল মন্দার শিকার। অর্থনীতির চূড়ান্ত সামরিকীকরণ করে, একের পর এক দেশে যুদ্ধ জারি রেখে, যুদ্ধাস্তে্রর ব্যবসাকে বিপুল বাড়িয়েও দেশের বাজারকে আর চাঙ্গা রাখতে পারছে না সরকার। মন্দার ধাক্কা সামলাতে সে দেশের ফেডারেল ব্যাঙ্কের কাছে সুদ কমানোর আবেদন জানিয়েছে প্রশাসন। মন্দার আশঙ্কা যে বাড়ছে তা জানিয়েছে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সংস্থা গোল্ডম্যান স্যা’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ এপ্রিল, ‘২৫)। সাধারণ মানুষ ভোগ্যপণ্যের কেনাকাটা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজের বাইরে অন্য খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছে। বেড়েছে সংস্থাগুলির দেউলিয়া ঘোষণার সংখ্যা। এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প সাহেব মার্কিন অর্থনীতিকে বাঁচানোর দাওয়াই হিসাবে প্রায় সমস্ত দেশের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে জনগণকে খোয়াব দেখানোর চেষ্টা করছেন এতে দেশের শিল্প চাঙ্গা হবে। বলছেন, সব চাকরি সস্তা শ্রমের দেশগুলো নিয়ে চলে যাচ্ছে। এবার এই দাওয়াইতে তারা শায়েস্তা হবে, মার্কিন বেকাররা চাকরি পাবে, আভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়ে মন্দা কাটবে। কিন্তু সে দেশের জনগণের একটা বড় অংশকেই এই দাওয়াই যে গেলাতে পারেনি ট্রাম্প-মাস্ক জুটির প্রশাসন, তা এই বিক্ষোভেই বোঝা যাচ্ছে।