Breaking News

পাঠকের মতামতঃ মুনাফা লুঠের চক্করে রেলও

কিছুদিন আগেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার স্টেশনে স্টেশনে চলছিল মিছিল, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ। মাঝে মাঝে উচ্চকণ্ঠে স্লোগান– ‘অস্বাভাবিক লেটে ট্রেন চালানো চলবে না।’ ‘সময় সারণি মেনে ট্রেন চালাতে হবে, রেলের বেসরকারিকরণ করা চলবে না’, ইত্যাদি। আমার মতো অনেকেই এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের জন দশেক স্বেচ্ছাসেবক গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করছিলেন খড়গপুরে ডিআরএম-কে ডেপুটেশন দেওয়ার জন্য। ওই ঘটনার কয়েকদিন পর দেখা গেল চলন্ত ট্রেনের ভেতরেই ওঁরা হ্যান্ডমাইক নিয়ে প্রচার করছেন। প্রচার শুনেই কয়েকজন যাত্রী বলে উঠলেন, ‘আরে দাদা, ডেপুটেশনের ডেটটা ভাল করে বলুন, আমরা যাব।’ আরও জানতে চাইলেন ‘আপনাদের জমায়েতটা কোথায়, কখন’? আমার পাশেই একজন হকার ভাইকে বলতে শুনলাম ‘আমাদেরও সর্বনাশ হচ্ছে, আমরাও আপনাদের পাশে আছি’। কেউ কেউ আবার আন্দোলন তহবিলের সাহায্যে দেওয়ার জন্য বক্সের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।দেখা গেল পুরো কম্পার্টমেন্টেই যাত্রীরা তাঁদের নিত্যদিনের কষ্টের কথা, ক্ষোভের কথা পরস্পরের মধ্যে শেয়ার করতে শুরু করেছেন।

কিন্তু এই সমস্যার কথা সংবাদমাধ্যমে নেই কেন? শাসক-বিরোধী তরজায় যে সব দলের নেতাদের মুখ রোজ টিভিতে ভাসে– সেই দলগুলোকে তো দেখা যাচ্ছে না! আসলে ভোট রাজনীতির বাইরে এদের তেমন দেখা যায় না। এরা সেই হিসেব কষেই চলে। করোনা সংক্রমণের পরে সমস্ত কিছু স্বাভাবিক হল। ট্রেন চলাচলটা স্বাভাবিক হল না! আর সে কারণেই হাজার হাজার রেলযাত্রীর ভোগান্তির শেষ নেই। একেবারে নিম্ন আয় থেকে শুরু করে উচ্চ আয়ের বহু মানুষের জীবন জীবিকা আজ ভীষণভাবে এই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে। বাস্তবে এদের জীবনে ‘আচ্ছে দিন’ ‘জুমলা’-ই থেকে গেল। শুধু ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক কিংবা চাকরিজীবীরাই নয় পরিচারিকা, ঠিকা শ্রমিক, দিনমজুর, পরিযায়ী শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি, ছোট-বড় কারখানার শ্রমিক, ফুল-ফল-মাছ সব্জি বিক্রেতা সকলেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্ল্যাটফর্মে আটকে প্রতিদিন অস্থির হয়ে ওঠেন। রেলের উপর নির্ভরশীল লোকগুলি, এমনকি রেল কর্মচারীরাও ঠিক সময়ে কর্মস্থলে প্রায় কোনও দিনই পৌঁছাতে পারেন না। যাত্রীরা আর্থিক ও মানসিক সমস্ত দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হন। সময় থাকতে স্টেশনে পৌঁছেও উৎকণ্ঠা– ‘সময় মতো পৌঁছতে পারবো তো’? ‘আজ কাজে যোগ দিতে পারব তো’? ‘আজ আবার কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে না তো’? মাঝখানে কয়েকটা দিন দেখা গেল বেশ কিছু ট্রেন খানিকটা রাইট টাইমে চলাচল করছিল। কিন্তু দু-চার দিন যেতে না যেতেই আবার সেই আগের অবস্থা। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল ওদের ডেপুটেশনের চাপেই দিন কয়েক রেলকর্তারা এভাবে ট্রেন চালাচ্ছিলেন।

রেল চালিয়ে সরকারি কোষাগারে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা আয় হয়। তবুও রেল পরিষেবা ঠিক মতো দিতে কেন্দ্রীয় সরকার এত উদাসীন কেন? কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাঙ্ক, বিমা, বিদ্যুৎ ইত্যাদি পরিষেবা ক্ষেত্রগুলির মতো এই রেল পরিষেবাতেও মুনাফালোভী কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিচ্ছে। সেই রাস্তাটা প্রস্তুত করতে দেরিতে ট্রেন চালানো, যখন তখন ট্রেন বাতিল করা, কিছু লোকাল ট্রেনের গায়ে এক্সপ্রেসের তকমা লাগিয়ে কয়েকগুণ ভাড়াবৃদ্ধি, লোকাল ট্রেন দাঁড় করিয়ে মালগাড়ি ও বন্দে ভারত পাস করানো ইত্যাদি করে চলছে রেলদপ্তর। এ ধরনের হয়রানিতে যাত্রীরা যাতে বিরক্ত হয়ে সরকারি পরিষেবার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়, এটাই হচ্ছে সরকারের মূল অভিসন্ধি। যাত্রীরা যাতে বিভ্রান্ত হয়। তারা যাতে ব্যাপকভাবে বলতে শুরু করে রেলের বেসরকারিকরণ হলেই ভাল! দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজিপতিদের সেবাদাস সরকারের এটা যে একটা চক্রান্ত তাঁরা অনেকেই ধরতে পারছেন না। ভাবা দরকার, অধিকাংশ বাসই তো এখন বেসরকারি। তাতে যাত্রীদের কী সুবিধা হয়েছে? সরকারি বিএসএনএল দুর্বল করে জিয়ো কোম্পানিকে বাজার ধরিয়ে দিয়ে টেলিফোন গ্রাহকদের কোন উপকারটি করেছে সরকার? রেলে সাধারণ হকারদের তুলে দিয়ে, স্টেশনে ফুড প্লাজা, শপিং মল করলে– রেল পরিষেবার কোন উন্নতি হবে? কারই বা লাভ হবে? অতীতে রেলে যে পরিমাণ মানুষ চাকরি করত সেই সংখ্যা আজ অর্ধেকে কমে দাঁড়িয়েছে।

স্থায়ীপদগুলোকে তুলে দেওয়া হচ্ছে, কর্মসংস্থানের সমস্ত রকম সুযোগ প্রায় বন্ধ। হকাররা জীবিকা হারাচ্ছে, যাতায়াত ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে, ১৪ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কর্মচারীদের খাটানো হচ্ছে, সামান্য বেতনে ঠিকাপ্রথায় নিয়োগ বাড়ছে, নানা ধরনের সুরক্ষা ও ছাত্র থেকে শুরু করে প্রবীণ মানুষ এমনকি রোগীদের বিশেষ ছাড়ও তুলে দেওয়া হচ্ছে। রেল আর সরকারের দৃষ্টিতে পরিষেবা নয়, বিপুল মুনাফা লোটার ক্ষেত্র।

দীনেশ মেইকাপ, পশ্চিম মেদিনীপুর

লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা ২-৮ মে ২০২৫ এ প্রকাশিত