২৪ এপ্রিল ২০২৫। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর ৭৮তম প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে কলকাতার শহিদ মিনার ময়দানে সমাবেশ। বৈশাখের প্রখর রোদে পুড়ে যাচ্ছে মাঠ– গোটা দেশের তপ্ত হয়ে ওঠা পরিস্থিতিরই প্রতিফলন যেন। তারই মধ্যে রাজ্যের প্রান্ত-প্রত্যন্ত থেকে আসা ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ ধীরে ধীরে নিজেদের জায়গা নিলেন। কেউ পেতে রাখা চেয়ারে, কেউ নীচে ঘাসের উপর, মাটিতে কাগজ বিছিয়ে। কেউ বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন আগের দিন, কেউ বা এ দিন ভোরে। সঙ্গে আনা চিঁড়ে-মুড়ি-বাদামভাজা খেয়ে খিদে মিটিয়ে দ্রুত তাঁরা তৈরি হয়েছেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষের বক্তব্য শুনবেন বলে।
বিকেল তিনটে থেকেই মঞ্চ সোচ্চার ছিল উচ্চকিত স্লোগানে। এ যুগের অন্যতম মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক, এস ইউ সি আই (সি)-র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তা সংবলিত উদ্ধৃতি প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন পলিটবুরো সদস্য কমরেড গোপাল কুণ্ডু। পাশেই বুকস্টলে ছিল উপচে পড়া ভিড়। মঞ্চে দলের সঙ্গীত গোষ্ঠী একের পর এক গণসঙ্গীত পরিবেশন করে চলেছেন। শুরু হল কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রতিকৃতিতে মাল্যদানের অনুষ্ঠান। কমরেড প্রভাস ঘোষের পর প্রবীণ পলিটবুরো সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্য এবং সভার সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড মানব বেরা মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান। উপস্থিত ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃবৃন্দ। প্যারেড করে এসে কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রতিকৃতিতে গার্ড অফ অনার জানাল দলের কিশোরবাহিনী কমসোমল। শুরু হল সভার মূল কাজ।
সভাপতির উত্থাপিত প্রস্তাবে উঠে এল কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী হামলা, প্যালেস্টাইনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট ইজরায়েলের আক্রমণ ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের তীব্র প্রতিবাদ। অভয়া হত্যাকাণ্ডে যুক্ত দোষীদের চিহ্নিতকরণ ও শাস্তি, যোগ্য শিক্ষকদের চাকরি ফেরানো ও সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তির দাবি করা হয়েছে প্রস্তাবে। ওয়াকফ সংশোধনীর নিন্দা করে ও মুর্শিদাবাদে দাঙ্গার জন্য রাজ্য সরকারকে দায়ী করে প্রস্তাবে জনসাধারণের কাছে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়। সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় প্রস্তাব। কাশ্মীরের পহলগামে নৃশংস সন্ত্রাসবাদী হামলার তীব্র নিন্দা করে বক্তব্য শুরু করেন কমরেড প্রভাস ঘোষ। বলেন, এই মর্মান্তিক ঘটনা কাশ্মীর সহ গোটা দেশের প্রবল ক্ষতি করল। এ ঘটনায় শুধু প্রাণহানি হল তাই নয়, কাশ্মীরের পর্যটন শিল্প সহ গোটা অর্থনীতি বিপদগ্রস্ত হল। তিনি প্রশ্ন তোলেন, যে কাশ্মীরকে সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনী দিয়ে মুড়ে রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার, সেখানে পহলগামে কী করে এই ঘটনা ঘটতে পারল, তার জবাব দিতে হবে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকেই। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এরপর কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কাশ্মীরে সেনা তৎপরতা আরও বাড়াবে, কাশ্মীরের নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার বাড়বে। এমনিতেই শাসক দল বিজেপি দেশে মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়ে চলেছে। পহলগামের এই ঘটনাকে তারা সেই কাজেই ব্যবহার করবে। অথচ এ দিন সন্ত্রাসীদের হাত থেকে হিন্দু পর্যটকদের বাঁচাতে শহিদের মৃত্যু বরণ করেছেন এক গরিব মুসলমান যুবক। ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছবার আগে দীর্ঘ সময় ধরে আহতদের সেবা-শুশ্রুষা করেছেন স্থানীয় কাশ্মীরী মানুষ, ধর্মে যাঁরা মুসলমান। ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলি পহলগামের ঘটনা নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার যে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছে, তা থেকে সাবধান থাকার জন্য জনসাধারণের কাছে আহ্বান জানান কমরেড প্রভাস ঘোষ।
তিনি বলেন, দেশ জুড়ে ধর্মের রাজনীতি চলছে। শুধু বিজেপি নয়, রাজ্যে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসও এ বিষয়ে বিজেপির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক ধর্মীয় অশান্তির উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে পুলিশকে সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে নিষ্ক্রিয় রেখে দাঙ্গা চলতে দেওয়া হয়েছে। এ ভাবে তারা মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক সংহত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আবার তারা হিন্দু ভোটব্যাঙ্কের জন্য মন্দির নিয়ে মাতছে, বিজেপির সঙ্গে মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে। এ সবই চলছে ভোটের লক্ষ্যে। ক্ষমতালোভী, নীতিহীন রাজনৈতিক নেতারাই এখন ধর্মপ্রচারক। নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উৎসাহদান, ক্লাবগুলিকে দেদার টাকাপয়সা দেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে তারা কার্যত ভোটের জন্য বিনিয়োগ করছে।
দেশে সাম্প্রদায়িকতার প্রসারের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে কমরেড প্রভাস ঘোষ দেখিয়েছেন, আপসমুখী নেতৃত্বের কারণে রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখ নবজাগরণের মনীষীদের সেকুলার মানবতাবাদী আদর্শের পথ ধরে পরিচালিত হতে পারেনি এ দেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন। কংগ্রেস হয়ে পড়ে উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতাদের দ্বারা পরিচালিত সংগঠন। ফলে গোটা স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দেশের দলিত সমাজ, মুসলমান ধর্মের মানুষ অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। আজও এর খেসারত দিয়ে চলেছি আমরা।
কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশের পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। জীবনের এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যেখানে মানুষ যন্ত্রণায় ছটফট করছেন না। সমস্ত সরকারি দল দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হল আর জি কর হাসপাতালের চিকিৎসক-ছাত্রী অভয়াকে। আজও সেই ঘটনার ন্যায়বিচার মেলেনি। কিন্তু তাতে হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা দেশের মানুষ যে ভাবে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন, তারই ফলশ্রুতিতে রাজ্যের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার ভয়াবহ দুর্নীতির ছবি সামনে এসেছে। সরকার বাধ্য হয়েছে অভিযুক্তদের গ্রেফতার সহ অনেকগুলি পদক্ষেপ নিতে। শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক দুর্নীতির মাশুল দিয়ে আজ হাজার হাজার চাকরিহারা শিক্ষক আন্দোলনে রাস্তার নেমেছেন। শিক্ষকের অভাবে এমনিতেই রাজ্যের ধুঁকতে থাকা স্কুলগুলি ভয়ানক দুর্বিপাকে পড়েছে। কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি এখন সিবিআই, ইডি-র মতো সংস্থাগুলিকে বিরোধীদের শায়েস্তা করতে কাজে লাগাচ্ছে। অথচ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির দুর্নীতি নিয়ে তাদের মুখে কুলুপ।
কমরেড প্রভাস ঘোষ দেখিয়েছেন, এই অসহনীয় পরিস্থিতির মূল উৎস পচা গলা দুর্গন্ধময় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ্যে এই পুঁজিবাদ খেটে-খাওয়া মানুষের উপর শোষণ-উৎপীড়ন ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। নীতি-আদর্শ কোনও কিছুরই ধার ধারে না অবক্ষয়ী এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। আর এই ব্যবস্থারই সেবাদাসত্ব করে চলেছে শাসক রাজনৈতিক দলগুলি।
দেশের ভয়ঙ্কর আর্থিক বৈষম্যের চেহারা তাঁর ভাষণে তুলে ধরে কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ দখল করে রেখেছে দেশের মোট সম্পদের ৭৭ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ৬৭ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের মাত্র ১ শতাংশ। প্রতিদিন অসংখ্য শিশু অনাহারে মারা যায়। কোটি কোটি বেকার, ছাঁটাই শ্রমিক। স্থায়ী কাজের ধারণা বাস্তবে উঠে গেছে। পেটের দায়ে ঘর ছেড়ে অন্য রাজ্যে, বিদেশ-বিভুঁইয়ে পাড়ি দিচ্ছেন লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক। গিগ শ্রমিকদের দুর্দশা অবর্ণনীয়।
রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দের বক্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি দেখান, আরএসএস-বিজেপিকে মানার অর্থ, বিবেকানন্দের শিক্ষা অমান্য করা, রামমোহন-বিদ্যাসাগর-নবজাগরণের মনীষীদের চেতনাকে নস্যাৎ করা। ইতিহাস উল্লেখ করে তিনি দেখান আরএসএস চিরদিন স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। তাদের চোখে নেতাজি সুভাষচন্দ্র, ভগৎ সিং, ক্ষুদিরামরা দেশপ্রেমিক নন।
কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই আজ ধসে পড়তে চলেছে। আমেরিকা সহ ধনী পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির অর্থনীতি আজ অস্ত্র ব্যবসা ছাড়া অচল। তাই অবলীলায় প্যালেস্টাইনকে ধ্বংস করে সেখানে বিনোদনের জায়গা করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। অথচ বিশ্বে কোথাও প্রতিবাদ নেই। বাস্তবে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে আজ জনগণকে সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ।
তিনি বলেন, এই পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হলে চাই পুঁজিবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। প্রতিটি দেশে জনজীবনের সমস্যা সমাধানের দাবিতে এই বিপ্লবের পরিপূরক গণআন্দোলন গড়ে তোলার পথে এগিয়ে চলতে হবে। জনগণকে সক্রিয় করে স্তরে স্তরে তৈরি করতে হবে অজস্র গণকমিটি। বামপন্থী দল হিসাবে সিপিআইএম-এর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এদের প্রতি আমাদের কোনও বিদ্বেষ নেই। এস ইউ সি আই (সি) চায় সিপিআইএম আন্দোলনে আসুক। কিন্তু তার আগে জনসাধারণের সামনে প্রকাশ্যে তাদের ভুল স্বীকার করতে হবে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, যে কংগ্রেস জরুরি অবস্থা জারি করেছে, টাডা, মিসা, আফস্পার মতো আইন চালু করেছে, অজস্র দাঙ্গা বাধিয়েছে, তাকে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সাজিয়ে তার সঙ্গে জোট গড়ে তোলা কি সুবিধাবাদী আচরণ নয়? এই আচরণ ত্যাগ করে সত্যিকারের আন্দোলনে এগিয়ে আসার জন্য সিপিএম-এর কর্মী-সমর্থকদের কাছে আহ্বান জানান তিনি।
উপস্থিত জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, আপনাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রাজনীতি বুঝতে হবে। কারণ, আপনাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র ব্যাপ্ত করে রয়েছে রাজনীতি। যতদিন আপনারা তা না বুঝবেন, ততদিন ভোটলোভী, ক্ষমতালোভী নেতাদের প্রতারণার শিকার হতে হবে। তিনি বলেন, নামে যতগুলিই হোক, বাস্তবে দেশে দুটি মাত্র দল আছে– একদিকে পুঁজিবাদের স্বার্থের রক্ষক দলগুলি, অন্যদিকে পুঁজিবাদ উচ্ছেদের লক্ষ্যে প্রকৃত সংগ্রামে রত বিপ্লবী দল।
এই প্রসঙ্গে তিনি এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলটির কার্যকলাপকেও প্রতি মুহূর্তে বিচার করে দেখার আবেদন করেন। পাশাপাশি, এলাকার নানা দাবি নিয়ে এগিয়ে এসে গণকমিটি গঠনের উপর জোর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন কমরেড প্রভাস ঘোষ, যে গণকমিটিগুলির নেতৃত্বে থাকবেন রাজনৈতিক নেতারা নন, সাধারণ মানুষই। তাঁরাই নিজেদের দাবি-দাওয়া বুঝে নিতে আন্দোলনের রাস্তা ঠিক করবেন।
কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, এলাকার শিশু-কিশোরদের বাঁচান। তাদের মনীষীদের শিক্ষার সাথে পরিচয় ঘটানোর দায়িত্ব নিন সকলে। তিনি আরও বলেন, দাবি আদায় না হলেই হতাশ হয়ে পড়ার কারণ নেই। প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যায় সহ্য করে যাওয়াও একটা অপরাধ। ভোটমুখী রাজনৈতিক দলগুলির ছড়ানো ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাতের প্ররোচনায় পা না দিয়ে অত্যাচারিত, শোষিত, খেটে-খাওয়া মানুষকে নিজেদের জীবনের প্রতিটি দাবি নিয়ে আন্দোলনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেন কমরেড প্রভাস ঘোষ।
আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মূর্চ্ছনায় তখন ভরে উঠছে ময়দানের আকাশ-বাতাস। শপথদৃঢ় হৃদয়ে একে একে এলাকায় ফিরে চললেন অন্যায় প্রতিরোধে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার উৎসাহে উজ্জীবিত গণআন্দোলনের হাজারো সৈনিক।