আর জি করের ঘটনার পর ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি হারানোর মধ্য দিয়ে আরও একবার পরিষ্কার হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গে সরকারি মদতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি কোন গভীর স্তরে পৌঁছেছে! অথচ এই ঘটনায় যাদের সবচেয়ে বেশি লজ্জিত হওয়ার কথা, সেই তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকারের নেতা মন্ত্রীদের এ নিয়ে কোনও লজ্জাবোধ আছে বলে তাঁদের বিবৃতি এবং আচরণে বোঝা যাচ্ছে না! চাকরিহারা শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীরা সল্টলেকের এসএসসি দপ্তর এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অফিসের সামনে একটানা অবস্থান চালিয়েছেন। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টে মধ্য শিক্ষাপর্ষদের আলোচনার ভিত্তিতে আপাতত যোগ্য শিক্ষকদের স্কুলে যাওয়া এবং বেতন পাওয়ার রায়কে তুলে ধরেই মুখ্যমন্ত্রী থেকে শিক্ষামন্ত্রী বলে চলেছেন– আপনারা রাস্তায় কেন, স্কুলে চলে যান। অথচ কারা স্কুলে যাবার যোগ্য বলে বিবেচিত এবং কারা অযোগ্য সেই তালিকাটা না দিলে শিক্ষকরা যাবেন কিসের ভিত্তিতে? সেই তালিকাটা দিতেও তারা বহু টালবাহানার পর অবশেষে একটা তালিকা পাঠিয়েছেন স্কুলে স্কুলে। কিন্তু তা নিয়েও নানা সংশয়। মুখ্যমন্ত্রী মেদিনীপুরে বসে বলে দিলেন, আমি এক মিনিটে সমস্যার সমাধান করে দিতে পারি। আশ্চর্যের বিষয় হল, তা হলে তিনি তাঁর সরকারের শিক্ষা দপ্তরকে দু-বছর আগেই তো নির্দেশ দিতে পারতেন, আসল ওএমআর সিটগুলো প্রকাশ করে দিয়ে প্রকৃত যোগ্যদের চাকরি নিশ্চিত করতে। বলতে পারতেন, যারা টাকার বিনিময়ে চাকরি বেচেছে এবং যারা তা কিনেছে তাদের কড়া শাস্তির পথে তৃণমূল দল এবং তার সরকার বাধা দেবে না।
এই দুটি কাজ করলে তো এই সমস্যা তৈরিই হত না! কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তখন কী করেছেন? শুধু চুপ করে থেকেছেন তাই নয়, দুর্নীতি ঢাকার সব রকম ষড়যন্ত্র চলতে দিয়েছেন। তাঁর দলের একেবারে উঁচু থেকে নিচু স্তর পর্যন্ত দুর্নীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছে। শুধু স্কুলের চাকরি বেচা তো নয়, সরকারি কাজের এমন একটা ক্ষেত্র নেই যেখানে এই দুর্নীতি শিকড় গাড়েনি! আর জি করের ঘটনায় দুর্নীতি এবং তাকে ঘিরে ক্রিমিনাল চক্রের ভয়াবহ চিত্র রাজ্যের মানুষ দেখেছে। যে দুর্নীতির কথা নবান্ন সভাঘরে আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রীর সামনে সরাসরি তুলে ধরেছিলেন জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের নেতা অনিকেত মাহাতো। মুখ্যমন্ত্রী সেদিনও তাকে ঢাকতে দুর্নীতিবাজ এবং থ্রেট কালচারের নায়কদের রক্ষা করতেই সচেষ্ট হয়েছিলেন। কেন? আজ তাঁর বলা ‘একটা মিনিট’ যে হাত থেকে বেরিয়ে গেছে, তা তিনি বুঝতে পারছেন না কি? এখন তাঁদের কাজ ছিল আর ক্ষতি বাড়তে না দিয়ে যোগ্যদের তালিকা দ্রুত প্রকাশ করে দেওয়া। দুর্নীতির কালি লাগা শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের চিহ্নিত করে নিজের দলের দুর্নীতিবাজদের স্বরূপ ফাঁস করে দেওয়া ও দুর্নীতির দায় শিরোধার্য করে নিঃশর্তে জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া।
অন্য দিকে স্কুল শিক্ষার এই লণ্ডভণ্ড পরিস্থিতির সুযোগে রাজ্যের সরকারি গদি দখলের প্রত্যাশী বিজেপি এবং সিপিএম নেতৃত্ব যোগ্যদের পক্ষে এখন খুব গলা ফাটালেও তারা হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে কী ভূমিকা নিয়েছে? বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালিত সিবিআই এবং ইডি শিক্ষা দুর্নীতির তদন্তে প্রচুর কালক্ষেপ করলেও তাদের পদক্ষেপ থেকেছে কেন্দ্রীয় শাসক দলের নির্দেশমাফিক। দুর্নীতি ধরবার জন্য সচেষ্ট হলে দেশের সর্বোচ্চ তদন্ত সংস্থা অযোগ্যদের চিহ্নিত করতে পারত না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ওএমআর শিটের প্রতিলিপি খুঁজে বার করা, ধৃতদের থেকে তথ্য বার করে দুর্নীতির মূলে পৌঁছানোর কোনও ইচ্ছাই সিবিআই দেখায়নি। সিবিআই যে কেন্দ্রীয় সরকারের পোষা খাঁচার তোতা, এই কথা তো সুপ্রিম কোর্টই বার বার বলেছে। সিবিআই একই ভূমিকা নিয়েছে আর জি কর মামলার ক্ষেত্রে। দুর্নীতির শিকড়ে পৌঁছানোর, এই চক্রকে ভাঙার কোনও চেষ্টাই তারা করেনি। আর জি করের ঘটনায় সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট আজও পেশ হয়নি। বিজেপির হয়ে বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা– এই দুর্নীতি শুরুর কালে ছিলেন তৃণমূলের অন্যতম প্রধান নেতা। তাঁর দায়িত্বে থাকা জেলাগুলোতে চাকরি দুর্নীতি ব্যাপক বলে দেখা যাচ্ছে। তিনি কি কিছুই জানতেন না? বিজেপি নেতারা তাঁকে একবার প্রশ্ন করে দেখতে পারতেন! তাদের বর্তমান সাংসদ প্রাক্তন বিচারপতি প্রথমে ৬ হাজারের মতো সন্দেহজনক চাকরির কথা বললেও পরে বিচার ছেড়ে নেমে পড়লেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে নিজের সংসদীয় আখের গোছাতে। বিজেপিও তদন্ত এবং বিচারের কথা শিকেয় তুলে একটা এমপি বাড়াতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আর সিপিএম সাংসদ আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য প্রথম থেকেই ‘অল ফ্রড’ তত্ত্বে অনড় ছিলেন। যোগ্য অযোগ্য আলাদা করার চেষ্টারই বিরোধিতা করেছেন তিনি। তাঁর দলও ভেবেছে চরম অনিশ্চয়তা আর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারলে ভোটের বাজারে তাদের লাভ হবে। যদিও এখন সেই দলের নেতা-নেত্রীরা ‘যোগ্যদের পাশে দাঁড়ানো’র কথা বলে চাকরিহারাদের অবস্থানে পৌঁছে টিভিতে মুখ দেখাতে ছুটছেন। অবশেষে আদালতও সিবিআই, এসএসসি এবং রাজ্য সরকারকে দুর্নীতিগ্রস্তদের চিহ্নিত করতে বাধ্য করার বদলে ‘পিটুনি কর’-এর কায়দায় সব শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মচারীদেরই চাকরি বাতিল করে দিয়েছে। দাঁড়াল যা, যোগ্যদেরও আবার পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। দুর্নীতিবাজ নেতা-মন্ত্রীদের গায়ে আঁচড়ও পড়বে না। শাসক দলগুলির দুটি স্বার্থ এখানে কাজ করেছে। প্রথমত তারা সকলেই যখন যেখানে ক্ষমতায় থাকে সেখানেই দুর্নীতির সাথে জড়ায়। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকট থেকে দুর্নীতির জন্ম হয়, যে দল সেই ব্যবস্থার রক্ষক হিসাবে কাজ করে তারা দুর্নীতিতে জড়াতে বাধ্য। বিজেপি জানে সিবিআই বেশি দূর পর্যন্ত তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে এগোলে বিজেপির নিট পরীক্ষার দুর্নীতি, ব্যাপম দুর্নীতি নিয়ে জনমানসে নাড়াচাড়া হবে। উত্তরপ্রদেশে ২০১৯-এ ৬৯ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল নিয়ে কথা উঠবে। সিপিএম জানে এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে তাদের আমলে টাকার বিনিময়ে চাকরি, দলবাজি-স্বজনপোষণ নিয়ে নাড়াচাড়া হবে। ২০১২ তে হাইকোর্টের রায়ে ২২০০ প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিলের প্রশ্ন উঠবে। ত্রিপুরায় ১০ হাজারের বেশি শিক্ষকের চাকরি বাতিল নিয়ে টানাটানি হবে। ফলে এরা কেউই আরজিকর নিয়ে যেমন সত্য উদঘাটনের দাবিতে বেশিদূর যেতে চায়নি। শিক্ষকদের প্রশ্নেও তাই। যতটা করলে তাদের ভোট প্রচারের সুবিধা হবে, দলীয় সংকীর্ণ রাজনীতিতে সুবিধা হবে, তার বেশি তারা আন্দোলনকে এগোতে দেবে না।
অত্যন্ত স্বস্তির কথা যে, জনগণ এই সব ভোটবাজ দলগুলির নেতা-নেত্রীদের কথায় বিশ্বাস করেন না। তাই এই সব দলগুলি যখন আর জি কর আন্দোলনকে ভোট-রাজনীতির রাস্তায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল, জনগণ তাতে সায় দেননি। তাঁরা আন্দোলনের রাস্তাতেই দৃঢ়পণ ছিলেন। এবারও শিক্ষকদের আন্দোলনে জনসাধারণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রশাসন যখন খাবার জল, মহিলাদের জন্য শৌচাগারের সুযোগটুকুও দিতে রাজি হয়নি, তখন স্থানীয় নাগরিকরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। যে কোনও আন্দোলনে এই সচেতন জনগণই সবচেয়ে বড় ভরসা।
এ ক্ষেত্রে আর জি কর আন্দোলন শিখিয়েছে, দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে জড়িয়ে গণকমিটির ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোলাটাই রাস্তা। নিছক ভোটের খোয়াব দেখানো নয়, এই গণকমিটির ভিত্তিতে আন্দোলনই পারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।