যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির ধাক্কায় ছাত্রের আহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে ৩ মার্চ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট ডেকেছিল এআইডিএসও। স্কুল এবং সমস্ত ক্ষেত্রের পরীক্ষা ছিল ধর্মঘটের আওতার বাইরে। মেদিনীপুর বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের আশেপাশে কোথাও উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের পরীক্ষার সেন্টার ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল গেট অন্য দিন বন্ধ থাকলেও সে দিন ছিল একেবারে হাট করে খোলা। সামনে মোতায়েন বিশাল পুলিশবাহিনী। সঙ্গে মহিলা কম্যান্ডো বাহিনী। এআইডিএসও-র ছাত্রছাত্রী স্লোগান দিয়ে গেটের সামনে পৌঁছতেই পুলিশ ও কম্যান্ডোবাহিনী তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লাঠিচার্জ শুরু করে দেয়। টেনে হিঁচড়ে চ্যাংদোলা করে প্রিজন ভ্যানে তোলে। এই কাজে পুলিশ বাহিনীকে বিরাট প্রতিরোধের সামনে পড়তে হয়নি। কারণ এক একজন ছাত্র পিছু অন্তত দশজন পুলিশ মোতায়েন ছিল। যে ভিডিও ক্লিপস ও ছবি ইতিমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে, তাতে যে কেউ এটা বুঝে নিতে পারবেন। মহিলা কম্যান্ডো বাহিনী ছাত্রীদের পিঠে বুটের লাথি, চুলের মুঠি ধরে টানাটানি ও হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশি নির্যাতনে অজ্ঞান হয়ে পড়া এক ছাত্রীকে তাঁর সহকর্মী জল দেওয়ার জন্য আবেদন করলেও তাতে কর্ণপাত করা দূরের কথা, উল্টে আঘাত করেছে পুলিশ। ধর্মঘটের দিন এই ছিল পুলিশের ভূমিকা।
এরপর পুলিশ লকআপে ছাত্রীদের উপরে যে নির্যাতন চালানো হয়েছে তা এতই বর্বরোচিত যে, পরাধীন ভারতে ব্রিটিশের অত্যাচারের কথা মনে করায়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেওয়া মেয়েদের উপর থানার মধ্যে এ রকম অত্যাচারের নজির কোনও সভ্য দেশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তনুশ্রী বেজ, সুশ্রীতা সরেন, রানুশ্রী বেজ, বর্ণালী নায়ক এই চারজন ছাত্রীকর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে তুলে আনার পর, থানায় সিসি ক্যামেরার আওতার বাইরে একটি জায়গায় নিয়ে গিয়ে শুরু হয় নির্যাতন। উল্লেখ্য, তনুশ্রী বেজ এআইডিএসও-র পশ্চিম মেদিনীপুর উত্তর সাংগঠনিক জেলার সম্পাদিকা ও সুশ্রীতা সরেন জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। মহিলা থানার ওসি স্বয়ং কোমরের বেল্ট খুলে মারা, চুলের মুঠি ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে বেত মারা, উত্তপ্ত গলিত মোম গায়ে ঢেলে দেওয়া, মেঝেতে ফেলে পায়ের উপর দু-তিন জন দাঁড়িয়ে এমন জায়গায় আঘাত করা যাতে বাইরে থেকে টের না পাওয়া যায়–এই ধরনের পাশবিক অত্যাচারে হাত লাগান। এত করেও নাকি তাঁর মারার ‘জোশ’ আসছিল না! ধর্ষকামী উল্লাসের তখনও আরও কিছু বাকি। সুশ্রীতা সরেন, আদিবাসী সম্প্রদায়ের শুনে ওসির রক্ত আরও গরম হয়ে ওঠে। থানার মধ্যে মেরে পুঁতে ফেলার হুমকি দিয়েও যখন কাজ হয় না, উচ্চস্বরে বলিউডি মিউজিক চালিয়ে উল্লাস প্রদর্শন করতে করতে, মুড চাঙ্গা করে আবার আসরে নেমে পড়েন। এ সব কুকীর্তি যাতে প্রকাশ না পায়, জোর করে স্নান করিয়ে কীর্তির দাগ মুছে ফেলার চেষ্টা হয়। তারপর রাত দুটোয় যানবাহনহীন শুনশান রাস্তায় এই ছাত্রীদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
পরের দিন মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে চিকিৎসা করতে অস্বীকার করা হয়। এই সব কিছু থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে পুলিশ, প্রশাসন, দুর্নীতির কারবারিদের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ ও গভীর বোঝাপড়া। আর জি কর থেকে মেদিনীপুর হাসপাতালের স্যালাইন কাণ্ড কিংবা যাদবপুর– ঘটনা আলাদা আলাদা, কিন্তু যোগসূত্র একই। দুর্নীতি, থ্রেট কালচার, দাদাদের দাপাদাপি, গণতন্তে্রর টুঁটি চেপে ধরা, প্রতিবাদ করলে চূড়ান্ত হয়রানি এমনকি জীবন সংশয়। দুর্নীতি ঢাকতে সহকারী ভূমিকায় কে? পুলিশ, প্রশাসন, আমলা-মন্ত্রীরা। প্রতিবাদী স্বরকে দমাবে কারা? এরাই। গুন্ডামিকে প্রশ্রয় দেবে কারা? এরাই। শাসকের পায়ের কাছে সমস্ত মানবিকতার জলাঞ্জলি দিয়ে এরা নোকরি করে ক্রীতদাসের মতো। গোলামিই যাদের জীবন, গোলামিতেই তাদের শেষ। এই মেদিনীপুরের মাটিতেই তো ক্ষুদিরাম জন্মেছিলেন। একশো বছর পরেও যাঁকে স্মরণ করে এগিয়ে চলেছে ছাত্র-যুবরা। এই মাটিতেই তো বিপ্লবী বিমল দাশগুপ্ত, শহিদ প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য জন্মেছিলেন। অসংখ্য বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের পীঠস্থান এই মেদিনীপুর। তাঁদের অনুসারী ছাত্রীরা তো প্রীতিলতাদের আকাঙক্ষায় বেড়ে উঠবেই। তারা শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলবেই। শিক্ষামন্ত্রীর কনভয়, তাঁর গাড়ি যদি ছাত্রদের দাবি না মেনে, বেপরোয়া হয়ে ছাত্র পিষ্ট করে চলে যায়, তারা প্রশ্ন তুলবেই। নিশ্চেষ্ট না থেকে প্রতিবাদ, প্রতিরোধে শামিল হবে। প্রতিবাদের অন্যতম হাতিয়ার ধর্মঘটে তারা শামিল হবেই।
শিক্ষাঙ্গনের যিনি অভিভাবক, ছাত্রদের অভাব-অভিযোগ, দাবি, অধিকার কীভাবে মেটাবেন সে আলাদা কথা, কিংবা আদৌ তাঁর সে ক্ষমতা বা এক্তিয়ার আছে কি না, নাকি তিনি ঠুঁটো জগন্নাথ, তার হাত পা বাঁধা সে সব পরের কথা। কিন্তু সর্বাগ্রে সন্তানসম ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক হওয়ার কথা তো তাঁর! ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে তাঁর এই ভাবে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে দেওয়া, সমস্যা সমাধানের কোনও চেষ্টা না করে পরিস্থিতিকে ঘোরালো করে তোলার দায় তিনি কোনও ভাবে এড়াতে পারেন না।
শিক্ষার মতো এমন একটি গুরুদায়িত্বে থেকে, যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়, সে ক্ষেত্রে তিনি কতটা দায়িত্বশীল? শিক্ষাঙ্গনে দিনের পর দিন চলা নৈরাজ্য থামাতে তিনি আজ পর্যন্ত সত্যিই কোনও সদর্থক ভূমিকা পালন করেছেন নাকি কেবল একজন সার্থক দলদাসের ভূমিকা পালন করে চলেছেন? দিনের পর দিন চলা এ হেন পরিস্থিতির প্রতিকার ছাত্রসমাজ চাইবেই!

হাইকোর্টে মামলা
মেদিনীপুর কোতোয়ালি মহিলা থানায় পুলিশি হেফাজতে গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের চার কর্মী সুশ্রীতা সরেন, তনুশ্রী বেজ, রানুশ্রী বেজ, বর্ণালী নায়কের উপর নৃশংস অত্যাচারের বিষয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের হয়েছে ৭ মার্চ। বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষের এজলাসে মামলা ওঠে ১০ মার্চ। বিচারপতি ঘোষ মামলাটি ১১ মার্চ শুনবেন বলে জানান। মামলার মূল পিটিশনার সুশ্রীতা সরেন জানিয়েছেন, জনজাতি পরিচয় উল্লেখ করে তাঁর উপর অত্যাচার ও অবমাননা বিষয়েও তিনি আইনি পদক্ষেপ নেবেন।