শারীরিক সুস্থতা, দৈহিক শক্তিবৃদ্ধি এবং মানসিক আনন্দের অন্যতম উৎস খেলাধূলা। প্রায় তিন হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রিসে সংগঠিত খেলাধূলার সূচনা বলে জানা যায়। সেই সময় প্রধানত সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও শিকারি হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য খেলা ব্যবহৃত হত। ক্রমাগত সমাজের অগ্রগতির সাথে সাথে খেলাধূলার নানা বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন দেখা যায়। বর্তমানে বিশ্বে ফুটবল, ক্রিকেট, লন-টেনিস, হকি, রাগবি, বাস্কেটবল প্রভৃতি খেলা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এ ছাড়াও গোটা বিশ্ব জুড়ে আরও অসংখ্য খেলা রয়েছে, প্রতিটি খেলারই নিজস্ব শৈলী ও সৌন্দর্য আছে।
প্রতিটি মানুষই জীবনের কোনও না কোনও পর্যায়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে খেলাধূলার সাথে যুক্ত থাকেন। নিজে খেলোয়াড় না হলেও অসংখ্য মানুষের কাছে খেলার মাঠের লড়াই, সুস্থ প্রতিযোগিতা একটি আনন্দময় বিনোদন। মহাদেশ বা দেশভেদে আবার কোনও কোনও খেলার বেশি জনপ্রিয়তা দেখা যায়। যেমন ক্রিকেট দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয়, ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে ফুটবল, আমেরিকার দেশগুলোতে বাস্কেটবল প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। কপিলদেবের নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপ জয়কে কেন্দ্র করে ক্রিকেট নিয়ে দেশের মানুষের আবেগ এক অন্য মাত্রায় পৌঁছায়। ২০১১-তেও ভারতবর্ষ ক্রিকেট বিশ্বকাপে জয়ী হয়।
ক্রিকেটের এই জনপ্রিয়তাকে আমাদের দেশের তথাকথিত ভোটসর্বস্ব দলগুলো ও শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য বারবার ব্যবহার করে এসেছে, ইদানিং যার নিকৃষ্ট চেহারা আবার দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি চ্যাম্পিয়ন ট্রফি ২০২৫-এ ভারত বনাম পাকিস্তানের ম্যাচকে কেন্দ্র করে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে গোটা দেশ জুড়ে ধর্মীয় উন্মাদনা, বিদ্বেষ, হিংসার বাতাবরণ তৈরি করা হল, যা কখনই খেলাধূলার ক্ষেত্রে যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে না। কথাতেই আছে, ‘স্পোর্টসম্যান ইজ জেন্টলম্যান’। খেলাধুলো যেমন লড়াই করতে শেখায়, পাশাপাশি একতা, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, সম্মানের সম্পর্কও গড়ে তোলে। খেলোয়াড়দের নিজেদের মধ্যে সুন্দর সংস্কৃতির আদান প্রদান হয়। খেলার ময়দানে এরকম বহু ঘটনার সাক্ষী থেকেছে ইতিহাস।
কিন্তু এখন ভারত বনাম পাকিস্তান ম্যাচগুলোকে শাসক শ্রেণি ও তাদের দ্বারা পরিচালিত সংবাদমাধ্যম এমন ভাবে তুলে ধরছে তাতে মনে হবে, এ যেন দুটো দেশের সাধারণ মানুষের যুদ্ধ। এক-একটা ম্যাচকে কেন্দ্র করে উগ্র হিন্দুত্বের, বিদ্বেষের জিগির তোলা হচ্ছে। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ এলেই কিছু কিছু মিডিয়া হিন্দু-মুসলিম দ্বৈরথের মানসিকতা উসকে দিয়ে উত্তেজনা তৈরি করতে চায়, যা বিজেপি জমানায় নিঃসন্দেহে আরও বাড়ছে। অথচ এর আদৌ কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। ভারতীয় দলে শুধু হিন্দু ধর্মের খেলোয়াড়রাই খেলেন এমন তো নয়। এখানে বিভিন্ন ধর্ম, রাজ্য, ভাষা, সংস্কৃতির খেলোয়াড়রা ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। ধর্ম, জাত-পাত এসবের প্রসঙ্গ তো খেলার মাঠে আসারই কথা নয়। তা হলে একটা ম্যাচকে কেন্দ্র করে এরকম ধর্মীয় উন্মাদনা কেন?
আসলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির রাজনীতির আওয়াজই আজ খেলার ময়দানেও শোনা যাচ্ছে। এ বারের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে পাকিস্তান পরাজিত হওয়ার পর এখানকার মুসলমান ধর্মের মানুষদের নানা ভাবে আক্রমণের লক্ষ্য করা হয়েছে। বিখ্যাত গীতিকার জাভেদ আখতার ভারতবর্ষের জয় নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করায়, তাঁকেও নানা ভাবে হেনস্থা করা হয়েছে। মহারাষ্টে্র ভাঙা হয়েছে সংখ্যালঘু মানুষের দোকানঘর। একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে ভারত বনাম বাংলাদেশ ম্যাচ নিয়েও একই ভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করার চেষ্টা হয়েছে।
তবে শত অপচেষ্টা সত্ত্বেও খেলার মাঠের স্বাভাবিক সৌজন্য, বন্ধুত্বের ছবি পাওয়া গেছে এবারও। ভারত বনাম বাংলাদেশ ম্যাচে ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মা সযত্নে বাংলাদেশের এক খেলোয়াড়কে জুতোর ফিতে বেঁধে দিলেন। আবার ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে দেখা গেল, ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বর্তমানের সেরা খেলোয়াড় বিরাট কোহলি পাকিস্তানের খেলোয়াড় নাসিমের কিংবা পাকিস্তানের হায়দার ভারতের হার্দিক পান্ডিয়ার জুতোর ফিতে সযত্নে বেঁধে দিচ্ছেন। আবার এই ম্যাচেই যখন বিরাট কোহলির অসাধারণ সেঞ্চুরির পর পাকিস্তানের ইসলামাবাদে শত শত জনতা একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়, ম্যাচের শেষে খেলোয়াড়রা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব বিনিময় করে, সেইসব মুহূর্তে জয় হয় স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের। মনে হয়, শাসকের ছড়ানো ঘৃণা এবং বিদ্বেষ খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতাকে, মানুষের স্বাভাবিক সৌজন্য বোধকে আজও পুরোপুরি নষ্ট করে দিতে পারেনি।
ইতিহাস ও বিজ্ঞানের শিক্ষা বলে, যুগে যুগে শাসকরা নিজেদের দ্বারা সংগঠিত শোষণ অত্যাচারকে ভোলাতে বারবার উগ্র ধর্মান্ধতার জিগির তোলে, ধনকুবেররা নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে খেলাধূলাকে পণ্যে পরিণত করতে চায়। এরা সকলেই খেলাধূলার আসল প্রাণসত্তাকে ধ্বংস করতে চায় নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে। আজও চারিদিকে খেলাধূলার নামে চলছে অনলাইন জুয়ার ব্যবসা, কোটি কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত সর্বস্বান্ত হচ্ছে। আজ প্রতিটি ক্রীড়াপ্রেমী মানুষের উচিত এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, প্রতিবাদে সামিল হওয়া। একমাত্র এই পথেই আমরা খেলাধূলার প্রকৃত তাৎপর্যকে বাঁচিয়ে রেখে তাকে আরও সুন্দর ও বিকশিত করতে পারব।