কেন্দ্রীয় সার নীতিতে কৃষকের সর্বনাশ

সারের কালোবাজারির বিরুদ্ধে গোটা দেশ জুড়ে কৃষক বিক্ষোভ ক্রমাগত বাড়ছে। কৃষকরা সস্তা দরে সারের দাবিতে নানা ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলছেন। সম্প্রতি কোচবিহার সহ প্রায় সমস্ত জেলাতেই কৃষকরা সার-ডিলারদের ঘেরাও করেছেন, পথ অবরোধ করেছেন। হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি সব রাজ্যেও একই অবস্থা। সমস্ত জায়গাতেই কৃষকরা সারের দাবিতে পথে নেমেছেন। কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নির্বিকার। তারা তাদের কৃষকবিরোধী নীতি সমানেই চালিয়ে যাচ্ছে।

সারের দাম কী ভয়ানক গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে সেই পরিসংখ্যানের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। ২০০৯-’১০ সালে টন প্রতি মিউরিয়েট অব পটাশের (এমওপি) দাম ছিল ৪ হাজার ৪৫৫ টাকা। ২০২৩-এর আগস্টে তার দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৬৪৪ টাকা। ২০০৯-’১০ সালে ডিএপি-র দাম ছিল টন প্রতি ৯ হাজার ৩৫০ টাকা। ২০২৩-এর আগস্টে তার দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার টাকা।

অন্য দিকে গত তিন বছরে সারের ভর্তুকি কমানো হয়েছে ৮৭ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা। ২০২২-’২৩ সালে কেন্দ্রীয় বাজেটে সারের ক্ষেত্রে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল ২ লক্ষ ৫১ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা, আর ২০২৩ সালে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ১ লক্ষ ৮৮ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা। ২০২৪-’২৫ সালে কেন্দ্রীয় বাজেটে সারের ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ১ লক্ষ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। সারের ক্ষেত্রে ভর্তুকি যে ক্রমাগত লাফিয়ে লাফিয়ে কমছে, উপরের পরিসংখ্যানই তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এক সময় সারের উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। কিন্তু নয়া আর্থিক নীতি গ্রহণের পর, ১৯৯০ সালের পর থেকে, দেশকে ধীরে ধীরে আমদানি-নির্ভর করে ফেলা হয়েছে। ফসফেট ও পটাশের ক্ষেত্রে দেশ এখন পুরোপুরিই আমদানি-নির্ভর। প্রয়োজনীয় ডিএপি-র ৬০ শতাংশ এবং এমওপি-র ১০০ শতাংশ এখন আমদানি করতে হয়। এখন, সার তৈরির জন্য যে সব উপাদানের প্রয়োজন হয় তার প্রায় সবটাই কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। এই সব উপাদানের দাম তারা ইচ্ছামতো বৃদ্ধি করে। তারা ইচ্ছামতো সারের দাম নির্ধারণ করে। দুনিয়ায় যত এমওপি সারের প্রয়োজন হয়, তার ৮৪ শতাংশ সরবরাহ করে মাত্র ৭টা কোম্পানি। এদের মুনাফার ক্ষুধা সারের দাম আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞমহল বলছে, এই সব কোম্পানিগুলির মুনাফার হার বর্তমানে (২০২২-’২৩ সালে) প্রায় ৩৬ শতাংশ।

বহুজাতিক কোম্পানির এই মুনাফার ক্ষুধা ছাড়াও আরও একটা বিষয় সারের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাজ করে। যেহেতু সার বিদেশ থেকে কিনতে হয়, তাই তা কিনতে হয় ডলারে। এই ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম ক্রমাগত কমতে থাকায় একই পরিমাণ সার কিনতে বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। ফলে সারের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কালোবাজারি। সব মিলিয়ে কৃষকের নাভিঃশ্বাস উঠছে। তা হলে সমাধান কী? সমাধান হল, সারের আমদানি নির্ভরতা কমানো, সারের ভর্তুকি বৃদ্ধি করা, সরকারি সার কারখানাগুলোর পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে এই ক্ষেত্রে বহুজাতিক পুঁজির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা। কিন্তু একচেটিয়া কোম্পানির সেবাদাস সরকারগুলো কি সেই পথে পা বাড়াতে পারবে?