Breaking News

কুম্ভমেলার আকাশে-বাতাসে আকুল আর্তি ‘আমার মাকে কেউ ফিরিয়ে দাও’

দেশ জুড়ে জমকালো প্রচার, বিশ্বমানের ব্যবস্থাপনার আশ্বাস, আর কোটি কোটি সাধারণ মানুষের মনে ফেনিয়ে তোলা ধর্ম-জিগির– এই ত্রিবেণী সঙ্গমে কতগুলি মানুষের তাজাপ্রাণ যে নিথর হয়ে গেল— কে-ই বা তা জানে! হতাহতের সংখ্যা কত তাও জানা নেই। মহাকুম্ভ মেলা আয়োজনকারী উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার চায় না সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে। শাহি স্নানের ব্রাহ্ম মুহূর্তে ২৯ জানুয়ারি মধ্যরাত এবং ৩০ জানুয়ারি ভোরে সঙ্গম ঘাট সংলগ্ন রাস্তায় ও ঝুসি এলাকায় দফায় দফায় পদপিষ্ট হওয়া ও মৃত্যুর ঘটনাকে স্রেফ অস্বীকার করতে চেয়েছিল তারা। সমস্তপ্রশাসন ও প্রচারযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে সোচ্চারে বলতে চেয়েছিল, ‘তেমন কিছুই হয়নি, ভিড়ে একটা ধাক্কাধাক্কির মতো ঘটনা ঘটেছিল, এখন সামলে নেওয়া গেছে।’ কিন্তু ঘটনা প্রবাহ এমন ভাবে এগিয়েছে যে, পুরো বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার সব রকম চেষ্টা সত্তে্বও শেষপর্যন্ত তা কার্যকর করা গেল না। পরিস্থিতি বুঝে প্রায় একদিন পর সরকার হিসেব দিল মৃতের সংখ্যা ৩০! নিকটবর্তী মতিলাল নেহেরু হাসপাতালের মর্গের ইনচার্জকে প্রশ্ন করা হলে তাঁর ধোঁয়াশাজনক উত্তর পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে আরও নিশ্চিত আভাস দেয়। তিনি বলেন, ‘আমার সরকার যখন বলেছে সংখ্যা ৩০, তখন আমি এর বাইরে যাব না। অন্য কে কী বলছে জানি না, আমি আমার সরকারের পক্ষে।’

৪৫ দিন ব্যাপী মেলায় প্রায় ৪০ কোটি মানুষ আসার প্রত্যাশা এবং প্রচার ছিল সরকারের। কিন্তু কেন যথাযথ অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না? একাধিকবার আগুন লেগে সেক্টর ১৯ ও সেক্টর ২২-এর প্রায় ২০০টি তাঁবু পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ছিল না প্রয়োজনীয় সংখ্যায় স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশ-প্রশাসনের দিক থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্যের ব্যবস্থা। বিপর্যয় মোকাবিলা টিম ছিল না, ছিল না অ্যাম্বুলেন্স চলাচলের পরিসর। ভিভিআইপিদের সঙ্গম ঘাটে নির্বিঘ্নে পৌঁছে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করতে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের চলবার পথ হয়েছে সংকীর্ণ। সাধারণ পুণ্যার্থীদের দীর্ঘ পথ হেঁটে স্নান ঘাটে পৌঁছতে হচ্ছিল। প্রয়াগরাজ থেকে বারাণসী– আড়াই ঘণ্টার পথ পেরোতে গাড়ির সময় লাগছিল সাড়ে দশ ঘণ্টা। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিজ্ঞতা– সর্বত্রই সম্পূর্ণ অব্যবস্থায় ভরা এই মেলা।

উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারের ‘বিশ্বমানের ব্যবস্থাপনা’ কেন ‘ব্রাহ্ম মুহূর্তে’ এমনভাবে পদপিষ্ট হল, তার পিছনে উঠে আসছে অনেক কথা। সরকারি মতে, সঙ্গম যাওয়ার পথে আখড়া মার্গের কাছে ব্যারিকেড ভেঙে ভিড় এগোতে থাকে এবং পথে শুয়ে থাকা পুণ্যার্থীদের পিষে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান কিন্তু অন্যরকম। তাঁরা জানিয়েছেন, পথের পন্টুন ব্রিজগুলি আটকে পুণ্যার্থীদের এগোতে বাধা দেয় পুলিশ। লাঠিচার্জও করা হয়। ফলে আতঙ্কিত মানুষ দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটাছুটি শুরু করলে পদপিষ্ট হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ঝুসির ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক দোকান-কর্মী নেহা ওঝা বলেন, ‘চারদিকে মৃতদেহ পড়েছিল। ওঁরা সকালবেলা মারা গিয়েছেন, দুপুর দেড়টা নাগাদ দেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কেউ ভিডিও করতে গেলে তাদের বাধা দিচ্ছিল পুলিশ’। একাধিক সংবাদসংস্থার ভিডিও ফুটেজে ধরা পড়েছে ঝুসির সেই দৃশ্য। পড়ে থাকা জামাকাপড়, জুতো ট্র্যাক্টর দিয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে। ঘটনার সত্যাসত্য হয়তো শেষপর্যন্ত চিরতরে হারিয়ে যাবে ওই মহাকুম্ভ মেলায় নিহত ও আহতদের হারিয়ে যাওয়া জামা জুতার মতোই।

কিন্তু শেষ সত্য হিসেবে উঠে আসছে যা, তাতে শোনা যাচ্ছে শুধুই আর্তনাদ, স্বজন হারানোর বুকফাটা কান্না– ‘আমার মাকে কেউ ফিরিয়ে দাও। মানুষটার খুব ইচ্ছে ছিল গো, একবার কুম্ভস্নান করার– এত কাছে এসেও আর হল না, সব শেষ, সব শেষ…।’ শিশুসন্তানকে কোলে আঁকড়ে পড়ে আছে মায়ের নিথর দেহ। কেউ হারিয়েছেন প্রৌঢ়া মাকে, কেউ ৩৩ বছরের তরতাজা যুবক সন্তানকে। তাদের মর্মন্তুদ হাহাকারে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস। যোগী সরকার বাধ্য হয়ে ৩০ জন পুণ্যার্থীর মৃত্যুর দায় স্বীকার করে ২৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করলেও একটি মৃতদেহেরও ময়নাতদন্ত পর্যন্ত করেনি, মৃত্যুর শংসাপত্রও পরিজনদের হাতে দেয়নি। অর্থাৎ কোনও ভাবেই মহাকুম্ভ মেলায় পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর কোনও লিখিত সরকারি নথি যাতে না থাকে, সে ব্যাপারে প্রশাসন অতি সতর্ক। মৃতের পরিজনদের কাউকে বলা হয়েছে– ‘বাড়ি চলে যান, হোয়াটসঅ্যাপে সব পেয়ে যাবেন’, কারও হাতে মৃতদেহ তুলে দেওয়ার বিনিময়ে টাকা চাওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ। এই দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণ মানুষের, নাকি পিশাচের– ভাবনা জাগে! মানুষ সম্পর্কে, মানুষের জীবন সম্পর্কে এদের মনোভাব শুধুমাত্র লাভ-লোকসানের হিসেবে মাপা।

প্রকৃত ধর্মপ্রাণ কোনও মানুষ বা সরকারের পক্ষে কি মানুষের জীবনহানির ঘটনাকে এভাবে দেখা সম্ভব! অথচ বিজেপি নেতারা বলছেন, ‘এত বড় মেলায় ছোটখাটো ঘটনা তো ঘটতেই পারে। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে’। এদের সাথে ধর্মের কি কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে! অথচ এই বিজেপি নেতাদেরই আহ্বানে, দেশেরপ্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিজেপির হিন্দুত্বের পোস্টারবয় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের দেশজোড়া প্রচারে হু হু করে মানুষ ছুটেছেন, ঝাঁপ দিয়েছেন মহাকুম্ভের অব্যবস্থার ওই অন্ধ গহ্বরে। মানুষ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করবেন কি করবেন না, কে কোন ধর্মের চর্চা করবেন, তা তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু যে ধর্ম-ব্যবসায়ীরা মানুষের আবেগের সুযোগ নিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক আখের গোছাতে চায়, তাদের পুরো কারবারটাই অধার্মিক নয় কি? উত্তরপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ২০১৯ সালের হিসেব দিয়েছেন। সেবার অর্ধকুম্ভ মেলা থেকে রাজ্যের লাভ হয়েছিল ১.২ লক্ষ কোটি টাকা। অনুমান, এবার মহাকুম্ভ মেলা থেকে উত্তরপ্রদেশ সরকারের লাভ হতে চলেছে কমপক্ষে ২ লক্ষ কোটি টাকা। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে ধর্ম গভীর বিশ্বাস ও আবেগের বিষয় হলেও মেলার আয়োজনকারীদের কাছে তা যে কেবল লাভের অঙ্ক— এ আজ প্রমাণিত সত্য। এ বছরেই দিল্লি ও বিহার দুই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। বেকার সমস্যা, নারী নির্যাতন, মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা সংকট, স্বাস্থ্য সংকট, কৃষক আত্মহত্যা ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের জীবন জর্জরিত। এ অবস্থায় নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে বিজেপির প্রয়োজন ধর্মীয় আবেগের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে বিরাট ধামাকায় পরিণত করে ভোটবাক্সে তার ফসল তোলা। তাই মহাকুম্ভ নিয়ে প্রচারের এই ঢক্কানিনাদ। তাই-ই হেলিকপ্টার থেকে পুষ্পবৃষ্টির আয়োজন করে চমক তৈরি করা। এ সবেরই বলি হতে হল এতগুলি মানুষকে।

গত অক্টোবর মাসে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির নেতারা রীতিমতো ঘোষণা করেছিলেন যে, অ-সনাতনী বা সনাতন হিন্দু ধর্মে অবিশ্বাসীদের মহাকুম্ভ মেলায় প্রবেশ নিষেধ। এমনকি অ-হিন্দুরা মেলায় দোকান পর্যন্ত খুলতে পারবেন না। অথচ সেদিন পদপিষ্ট হওয়া, ভিড়ে ঠেলাঠেলিতে অসুস্থ হয়ে পড়া, আতঙ্কগ্রস্ত হিন্দু পুণ্যার্থীরা বিপদে তাঁদের পাশে পেয়েছিলেন অন্য ধর্মের বহু মানুষকেও। মেলাপ্রাঙ্গণের বাইরের মহল্লায় দোকান খুলিয়ে পুণ্যার্থীদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন আনোয়ার শপিং কমপ্লেক্সের নিকটবর্তী বাসিন্দা মোহাম্মদ আনাস। ওই শপিং কমপ্লেক্সের অধিকাংশ দোকানদার ধর্ম-পরিচয়ে মুসলমান। কিন্তু ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি রাতে সেখানে আশ্রয় পেয়েছিলেন দেড় হাজারের মতো হিন্দু পুণ্যার্থী (সূত্রঃ দ্য হিন্দু, ১ ফেব্রুয়ারি, ’২৫)।

এক মসজিদের ইমাম সাহেব ক্লান্ত ক্ষুধার্ত পুণ্যার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এটাই তো বহু ভাষা-জাতি-ধর্মের বৈচিত্রে গড়া ভারতবর্ষের স্বাভাবিক আচরণ ও সংস্কৃতি! এই সংস্কৃতিকে যারা ভেঙে টুকরো টুকরো করতে চায়, সেই ধর্মব্যবসায়ীদের জাতির জীবন থেকে সরিয়ে দেওয়ার আহ্বান সেই ১৯৪০ সালেই জানিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। সেই আহ্বানের মূল্য কি এখনও মানুষ দেবে না!

জাতি ধর্ম সম্প্রদায়ের নামে খেপিয়ে তুলে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে লাভ কার? জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শোষণের স্টিম-রোলার চালায় যারা, সেই পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণে জর্জরিত বিচ্ছিন্ন মানুষ অসহায়। কিন্তু তারাই যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে সেই শক্তির মোকাবিলা করা দুঃসাধ্য। ঐক্যের এই শক্তিকেই ভয় পায় মুনাফালোভী পুঁজিপতি শ্রেণি আর তাদের সেবাদাস ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলি। এরাই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে কলুষিত করতে চায় দেশের আকাশ বাতাস। কেন্দে্র ও বিভিন্ন রাজ্যে শাসন ক্ষমতায় থেকে বিজেপি মালিক শ্রেণির দেওয়া এই দায়িত্ব পরম নিষ্ঠায় পালন করে চলেছে। ধর্ম তার কাছে শুধুমাত্র একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। প্রকৃত ধর্ম সাধনার সঙ্গে বিজেপির যে সত্যিকার কোনও সম্পর্ক নেই, মহাকুম্ভ মেলার আয়োজন এবং বিপর্যয়-পরবর্তী সরকারি ভূমিকা তা আবারও দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করে দিল।